স্বস্তি: মাধ্যমিক ফল প্রকাশের পর খোশমেজাজে। বুধবার মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ বালিকা বিদ্যালয়ে। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল
মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ পাওয়ামাত্রই বাৎসরিক হল্লাটি আরম্ভ হইয়া গিয়াছে— এই বৎসরও তবে জেলাগুলির নিকট কলিকাতা পরাজিত হইল! মেধা তালিকা জুড়িয়া জেলার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নাম। দশক দুয়েক পূর্বেও ছবিটি বিপরীত থাকিত। তখন কলিকাতাময় তালিকায় ইতিউতি কিছু জেলার ঠাঁই হইত। প্রতি বারই মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ পাইলে গবেষণা আরম্ভ হয়, কোন মহামন্ত্রে প্রান্ত আসিয়া কেন্দ্রকে এমন দশ গোল দিয়া গেল। জেলার যে ছেলেমেয়েগুলি ভাল ফল করিয়াছে, তাহাদের কৃতিত্বকে খাটো করিবার কোনও প্রশ্ন নাই। তাহারা খাটিয়াছে, ফলও পাইয়াছে। কিন্তু, অতীতের মাধ্যমিক আর আজিকার মাধ্যমিকের মধ্যে তুলনা অপ্রাসঙ্গিক, কারণ পরীক্ষা দুইটি কোনও অর্থেই এক নহে। অর্থনীতি বদলাইয়াছে, শিক্ষার বাজার বদলাইয়াছে। মাধ্যমিকই বা না বদলাইয়া যায় কোথায়? এখন কলিকাতা তো বটেই, রাজ্যের অন্যান্য মাঝারি শহরেও অবস্থাপন্ন, শিক্ষিত ঘরের কয়টি শিশু মাধ্যমিক বোর্ডের স্কুলে ভর্তি হয়? শহরাঞ্চলে মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে এখন প্রধানত প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভিড়। অস্বীকার করা চলে না, পরীক্ষায় চোখধাঁধানো ফল করিবার সম্ভাবনা তাহাদের তুলনায় কম। পরিপার্শ্বই তাহাদের পিছনে টানিয়া রাখে। কলিকাতায় যাহাদের ভাল ফল করিবার সম্ভাবনা বেশি, তাহারা ঝাঁক বাঁধিয়া আইসিএসই বা সিবিএসই বোর্ডের স্কুলে পড়িতে যায়। সাম্প্রতিক কালে এই দুই বোর্ডের পরীক্ষায় কলিকাতার ছেলেমেয়েদের ফল রীতিমতো ভাল। তুলনায় জেলাগুলিতে এখনও মাধ্যমিক স্কুলে যাওয়ার চল বেশি। অতএব, মাধ্যমিকে কলিকাতার তুলনায় জেলার ফল ভাল, তাহাতে বিস্ময়ের অবকাশ নাই।
জেলার কৃতী ছাত্রছাত্রীদের শুভেচ্ছা জানাইয়াও বলা প্রয়োজন, শহরের সেরাদের সহিত তাহাদের প্রতিযোগিতা হয় নাই। অতএব, মাধ্যমিকের সাফল্য যেন তাহাদের মাথা ঘুরাইয়া না দেয়। মফস্সল হইতে যখন সদরে আসিয়া পড়িতে হইবে, তাহার অভিঘাত সামলাইবার মতো জোর অর্জন করা ভাল। সত্য কথা বলিতে, গত দুই দশকে তেমন সাফল্যের সংবাদ নেহাতই কম। মাধ্যমিকে দুর্দান্ত ফল করিবার পর সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সেই সাফল্য বজায় রাখিতে পারিয়াছে, পেশাগত ভাবে তুমুল সাফল্য অর্জন করিয়াছে, এমন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নেহাতই মুষ্টিমেয়। এবং, তাহাই বলিয়া দেয়, রাজনীতির স্রোত মাধ্যমিক নামক পরীক্ষাটিকে কোথায় টানিয়া লইয়া গিয়াছে। পরীক্ষাটি এখন নেহাতই জেলাস্তরের। অথচ, কিছু বৎসর পূর্বেও ছবিটি এমন ছিল না। এক কালে আইসিএসই বা সিবিএসই-র তুলনায় মাধ্যমিক কঠিনতর ছিল, তাহার কদরও বেশি ছিল। তাহার পরও সর্বভারতীয় বোর্ড ও মাধ্যমিক তুল্যমূল্য ছিল। সেই দিন গিয়াছে।
এই বাস্তবটিকে স্বীকার করিয়া যদি রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার মান ফিরাইতে উদ্যোগ করা হইত, লাভ হইত ছাত্রছাত্রীদের। বিশেষত জেলার ছাত্রছাত্রীদের, যাহারা বিকল্পের অভাবে মাধ্যমিক বোর্ডের স্কুলেই পড়িতে বাধ্য হয়। কিন্তু, তাহার পরিবর্তে মাধ্যমিকের ফলকে কলিকাতার উপর জেলার জয়ের মোড়কে বেচিতে চাহিবার প্রবণতাটি বিপজ্জনক। কাজটিতে রাজনৈতিক লাভ আছে, অনস্বীকার্য। মাধ্যমিক স্কুলে যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে সরকার যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়াছে, এবং পকেটে যথেষ্ট রেস্ত না থাকিলে যথার্থ স্কুলশিক্ষা ক্রয় করা আর সম্ভব নহে, এই কথাগুলি খোলসা করিয়া বলা শাসক দলের স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক। অবস্থাপন্নরা কেন আর মাধ্যমিক স্কুলে পড়িতে আসে না, তাহা বলিয়া দিলে মুখরক্ষা করা মুশকিল হয়। অতএব একটি ভুল তুলনা টানিয়া মন ভুলাইবার খেলা চলিতেছে। তাহাতে ছেলেমেয়েদের কতখানি ক্ষতি, রাজনীতি সেই হিসাব কষে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy