Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

আসলে সময়ের দাবি

যে তৃতীয় লিঙ্গকে আমরা এত দিন ধরে ঘৃণা করেছি, অবহেলা করেছি, অপমান করেছি, গোপন করেছি অথবা পাশ কাটিয়ে গিয়েছি, তাঁরা আসলে এক অনস্বীকার্য বাস্তব।

গৌরী সাওয়ান্ত।

গৌরী সাওয়ান্ত।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৯ ০০:৩৫
Share: Save:

তাঁর মা মারা গিয়েছিলেন মাত্র ন’বছর বয়সে। দিদার কাছে মানুষ। পুলিশ অফিসার বাবা কড়া মানুষ। সন্তানের ব্যতিক্রমী স্বভাব তাঁর পছন্দ হত না। স্কুলের সহপাঠীদের কাছেও উপহাস ছিল নিত্যদিনের পাওনা। আঠারো বছর বয়সে বাবার চাপে তাঁকে বাড়ি ছাড়তে হল। পুণে থেকে সোজা মুম্বই। তার পর বেঁচে থাকার এক মরিয়া সংগ্রাম। সফল হয়েছেন তিনি। শুধু সফল নয়, রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেলেছেন। হ্যাঁ, রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষ গৌরী সাওয়ান্ত হয়েছেন ভারতের প্রথম ‘ট্রান্সজেন্ডার ইলেকশন অ্যাম্বাসাডর’। মহারাষ্ট্রের চিফ ইলেকশন অফিসার (সি ই ও) ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনে সকলকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভোটদান করতে আহ্বান জানানোর লক্ষ্যে বারো জন দূত নিয়োগ করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ওই রাজ্যের আইকন স্থানীয় মানুষজন। যেমন নিউক্লিয়ার ফিজ়িসিস্ট অনিল কাকোদকর বা খেলোয়াড় স্মৃতি মান্ধানা। গৌরী এই বিশিষ্ট বারো জনের অন্যতম। তাঁর ভাষায়, “আমার নিযুক্তির কারণ আমার কাজ, আমার লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় নয়।”

কী করেছেন গৌরী সাওয়ান্ত? মুম্বইতে এসে কাজ পেয়েছিলেন ভারতের প্রাচীনতম ‘এলজিবিটিকিউ এনজিও’তে। নাম ‘হামসফর’। তার পর ধীরে ধীরে মালাড-এ তৈরি করেছেন নিজের সংগঠন ‘সখী চার চৌঘি’। এই এনজিও যৌনকর্মী এবং লিঙ্গের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়। রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষ যাতে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসাবে চিহ্নিত হতে পারেন, ‘ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিস অথরিটি’র সেই কেসে গৌরী অন্যতম পিটিশনার ছিলেন। এই জাতীয় মানুষের হাতে শিশুদের দত্তক নেওয়ার অধিকার তুলে দেওয়ার আইনি লড়াইতেও গৌরী ছিলেন প্রথম সৈনিক।

২০০১ সালে ‘গায়ত্রী’ নামের একটি পাঁচ বছরের শিশুকে তিনি আশ্রয় দেন। তার যৌনকর্মী মা এডস হয়ে মারা যান। দিদা তাকেও বেচে দিচ্ছিলেন কলকাতার এক দালালের কাছে। সোনাগাছিতে স্থান হত গায়ত্রীর। গৌরী শিশুটিকে উদ্ধার করে তার ‘মা’ হলেন। মাতৃত্বের আইনি স্বীকৃতি পেতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২০০৮ সাল পর্যন্ত। সে কাহিনি সারা ভারত দেখেছে এক ওষুধের বিজ্ঞাপনে। অসাধারণ জনপ্রিয় হয়েছিল সেই বিজ্ঞাপন। কিন্তু আইনি স্বীকৃতির চেয়ে যা অনেক বেশি, সেই ভালবাসা আজ মা মেয়েকে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলেছে। গৌরী বলেন, “সেই সময় আমি তো জানতামই না আমি মা হব, ওকে বড় করব, তার গল্প মানুষকে শোনাব। শুধু জানতাম মাতৃহীন ছোট্ট শিশুটার নিরাপত্তা চাই, যত্ন চাই।... গায়ত্রী আমাকে ‘মা’ করেছে।”

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এ বারের লোকসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে ভোটার আছেন ১ কোটি ১৯ লাখ। এঁদের মধ্যে ২০৮৬ জন রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষ (সরকারি খাতায়)। তাঁদেরই এক জনকে কমিশন নির্বাচন করেছেন এক অদম্য লড়াইয়ের স্পিরিটকে সম্মান জানিয়ে। গৌরীর কাজ ভোট দেওয়ার জন্য গণসচেতনতা বাড়ানো। তাঁর অঙ্গীকার, “আমার সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে আমি জনগণকে সাহায্য করব শহরের পোলিং বুথগুলোতে পৌঁছতে।” ছুটির দিনে ভোট হয়। সেটা একটা বিশেষ সুবিধা। ভোট দেওয়া সব ধরনের মানুষেরই অধিকার। গৌরী বলেন, “আমি যৌনকর্মী, গৃহবধূ, সকলকেই নির্বাচনের গুরুত্ব বোঝাব। যৌনকর্মী এবং তাঁদের কল্যাণের কথা কোনও রাজনৈতিক দলের আজেন্ডার মধ্যেই থাকে না। তাই তাঁরাও ভোট দিতে উৎসাহ পান না। কিন্তু এই মনোভাবের পরিবর্তন দরকার।”

গৌরী কত জন মানুষকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারবেন, আমরা জানি না। কিন্তু ‘নির্বাচন দূত’ হিসাবে তাঁর নির্বাচন আমাদের কাছে একটি বার্তা নিশ্চয় পৌঁছে দিচ্ছে। যে তৃতীয় লিঙ্গকে আমরা এত দিন ধরে ঘৃণা করেছি, অবহেলা করেছি, অপমান করেছি, গোপন করেছি অথবা পাশ কাটিয়ে গিয়েছি, তাঁরা আসলে এক অনস্বীকার্য বাস্তব। সমাজে তাঁদের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় নেই। নির্বাচন কমিশন আসলে গৌরীকে নির্বাচিত করেননি, করেছে আজকের ভারত, করেছে আমাদের সমকাল। সময়ের এই দাবিকে এড়িয়ে যাওয়া চলে না। সে চেষ্টাও অন্যায়।

এখন দেখার বিষয় মহারাষ্ট্রের মালাড যে নগরকীর্তনে শামিল হয়েছে, সেই সুর আমাদের প্লাবিত করে কি না। হয়তো সময় লাগবে আরও, তবে এই ধরনের সব কাহিনিরই শেষ নিশ্চয়ই বিয়োগাত্মক হতে পারে না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE