সূচনা: সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দিনে ভোট দিয়ে আসছেন ভারতীয় নাগরিক। আলিপুরদুয়ার, ১১ এপ্রিল। রয়টার্স
এক ঝাঁক পুলিশ অফিসারকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া কেন্দ্র করে রাজ্যের নির্বাচনী আবহ সহসা এক অন্য রকম চেহারা নিয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে ভোট-রাজনীতি তা নিয়ে যথেষ্ট আলোড়িত, উত্তপ্ত। নরেন্দ্র মোদী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সকলেই মুখ খুলেছেন। চলছে পারস্পরিক দোষারোপ, চাপানউতোর। এমনকি এক বিরল নজির সৃষ্টি করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা দেশের নির্বাচন কমিশনকে চিঠি লিখে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। কমিশন আইনকানুন ব্যাখ্যা করে সেই চিঠির জবাব দিলেও রাজনীতি তাতে থেমে নেই।
রাজ্যের পদস্থ পুলিশ ও আমলাদের একাংশের বিরুদ্ধে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ নিয়ে বিজেপি কিছু দিন ধরেই সরব। ওই শ্রেণির অফিসারেরা নানা ঘটনায় রাজ্যের শাসক দলের পক্ষে পদক্ষেপ করেন বলে বাম এবং কংগ্রেসের মুখেও অভিযোগ শোনা যায়। কার্যকারণ খতিয়ে দেখলে তার সবই হয়তো উড়িয়ে দেওয়ার নয়। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়েও এমন বহু অভিযোগ সামনে এসেছিল।
কিন্তু এই সব যে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই হয় বা মমতার আমলেই হচ্ছে, সে কথা বললে অতি সরলীকরণ হবে। সর্বত্রই যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, পুলিশ-আমলাদের উপর প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে সেই দলের একটা ‘চাপ’ এসে পড়ে। সোজা কথায় একে ‘অলিখিত নিয়ন্ত্রণ’ বললেও খুব ভুল হবে না। কে কী ভাবে সেই সব পরিস্থিতি সামলাবেন বা মাথা বন্ধক রাখবেন কি না, সেটা যার যার নিজস্ব ব্যাপার। তবে এর পিছনে সব সময় খুব যে কিছু রাজনৈতিক অভিসন্ধি থাকে, তা নয়। আসলে যা বেশি থাকে তা হল ‘ঝামেলা’ এড়ানোর তাড়না। মেনে বা মানিয়ে নিয়ে কার্যসমাধার সহজ পন্থা অবলম্বন।
তাই এই বঙ্গে আমাদের চার পাশেও এমন আইএএস, আইপিএস-দের দেখা মেলে, বাম-আমলে যাঁরা ‘সিপিএমের দালাল’ বলে চিহ্নিত হতেন। আর এখন জমানা বদলের পরে তাঁদেরই কারও কারও গায়ে ‘মমতার দালাল’ তকমা লাগানো! হতে পারে, এর কোনওটিই তাঁদের আসল পরিচয় নয়। চাকরির জার্সিমাত্র। যখন যেমন, তখন তেমন। ‘বস’কে তুষ্ট রাখার চেনা ফর্মুলা!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
তবে এর বাইরেও নিজেদের খোলাখুলি শাসকের বশংবদ বা স্তাবক প্রতিপন্ন করার মতো আমলা এবং পুলিশ অফিসার খুব বিরল নন। সব কালেই তেমন মুখের দেখা মেলে। এই রাজ্যেই এক উর্দিধারী পুলিশকর্তা তাঁর আমলের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ‘মনীষী’ বলে শোরগোল তুলে দিয়েছিলেন। আর এক জন অধুনা রাজনীতিতে নাম লেখানো মহিলা তো উর্দিধারী আইপিএস থাকাকালীন মমতাকে ‘জঙ্গলমহলের মা’ পর্যন্ত ডেকে ফেলেন! এখন অবশ্য তিনিই উল্টো গান গাইছেন!
একই রকম ধারাবাহিকতায় পুলিশ ও প্রশাসনে এমন স্তাবক, বশংবদ অফিসার এখনও যে নেই, তা নয়। ক্ষমতাসীনদের নজরে তাঁরা দক্ষ এবং বিশ্বস্ত বলেই অভিহিত হন। আর বিরোধীরা তাঁদের ‘দলদাস’ বলে কটূক্তি করে থাকেন। এই শ্রেণির অফিসারেরা অনেক সময় অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে পদক্ষেপ করতে অভ্যস্ত। তাঁদের বিভিন্ন কার্যকলাপ নানা জটিলতা তৈরি করে, এটাও ঘটনা।
তবে আবার বলছি, এ জিনিস একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বেই ঘটছে না। চোখ-কান খোলা রেখে দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে ঘুরলে এর থেকেও গুরুতর স্তাবকতা এবং দলদাসত্বের ভূরি ভূরি নজির মিলবে। লোক বেছে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে বসানোর ক্ষেত্রে মোদী-সরকারের জুড়ি মেলা ভার। শুধু বড় সরকারি পদেই নয়, দেশের বিভিন্ন স্বশাসিত এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিতেও বশংবদদের বসিয়ে দেওয়ার প্রবণতা গত পাঁচ বছরে নজির গড়েছে। দেশের আমজনতা তা ভালই জানেন।
কিন্তু এখন ভোটের সময় নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে পুলিশ অফিসারদের বদলি করার যে প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, সেই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। এই লেখার সময় পর্যন্ত কলকাতা ও বিধাননগরের দুই পুলিশ কমিশনার-সহ তিন জেলার পুলিশ সুপারকে বদল করেছে নির্বাচন কমিশন। তাঁদের ভোটের কোনও কাজে লাগানো যাবে না। তাঁদের জায়গায় পরবর্তী অফিসারদের নামও কমিশনই স্থির করে রাজ্য সরকারকে জানিয়ে দেয়।
নির্বাচনী আচরণবিধি চালু হওয়ার পর কমিশন এই রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ জন্য রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শ করার কোনও বাধ্যবাধকতা তাদের নেই। সেই দিক থেকে বিচার করলে কমিশন অবশ্যই আইন বহির্ভূত কিছু করেনি। বস্তুত এর আগে ২০১১ এবং ২০১৬-র দুই বিধানসভা ভোটের সময়েও নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে কলকাতার পুলিশ কমিশনারদের সরতে হয়েছিল। সরানো হয়েছিল কয়েক জন
এসপি-কেও। এবং তখনও এ বারের মতোই কমিশনের এক তরফা নির্দেশে অফিসারদের বদলি হয়। তবে এ বার কমিশনের সিদ্ধান্তগুলি সম্পর্কে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ জোরালো হয়েছে বলেই বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পাচ্ছে।
এই অভিযোগের সবচেয়ে বড় কারণ বিজেপির ভূমিকা। ভোটের দামামা বেজে উঠতেই দেশের শাসক এবং রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির বড়-মেজো-সেজো নেতারা হুঙ্কার দিয়েছিলেন, নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী সবাই মিলে এ বার তৃণমূল সরকারকে ‘শায়েস্তা’ করে দেবে। মমতার কোনও ‘জারিজুরি’ চলবে না। আর সেই ‘কাজ’ করতে গিয়ে যে ভাবে গোটা প্রক্রিয়াটি সামনে চলে এল, তাকেও নির্লজ্জ দলবাজির প্রকাশ বলা চলে।
প্রথমে দুই পুলিশ কমিশনারের কথা ধরা যাক। বিজেপির অভিযোগ অনুযায়ী ‘মমতার বশংবদ’কে সরিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদে যাঁকে বসানো হল সেই আইপিএস অফিসারের সঙ্গে তৃণমূল থেকে আসা বিজেপি নেতা মুকুল রায়ের ‘ঘনিষ্ঠতা’ সুবিদিত। তৃণমূলের মুকুল যখন কেন্দ্রে জাহাজ এবং রেলের মন্ত্রী ছিলেন, ওই আইপিএস তখন দুই মন্ত্রকেই তাঁর সঙ্গে ছিলেন। পরে রাজ্যে ফিরে তিনি সিআইডি-র এডিজি হন এবং ঘটনাচক্রে তাঁকে ওই পদ থেকে সরানো হয় ঠিক তখনই, যখন মুকুল বিজেপিতে যোগ দেন। সমাপতনটি বড় অদ্ভুত! বাম আমলে নন্দীগ্রাম কাণ্ড এক কলঙ্কিত ইতিহাস। সেই সময় মেদিনীপুর রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন যিনি, তাঁকে বিধাননগরে কমিশনার করেছে নির্বাচন কমিশন। এটিও বেশ চোখে লাগার মতো! নির্বাচন কমিশন এ সব ক্ষেত্রে ‘সিনিয়রিটি’র যুক্তি দিতেই পারে। কিন্তু একতরফা বাছাইগুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ থেকেই যায়।
অনুব্রত মণ্ডলের জেলা বীরভূম এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী এলাকা ডায়মন্ড হারবারের পুলিশ সুপারদের বদলি করার পিছনেও রাজনৈতিক বার্তা স্পষ্ট। তবে সবাইকে টেক্কা দিয়েছে ভোটের দু’দিন আগে কোচবিহারের এসপি-র বদলি। মুকুল এখানেও এক ‘বিতর্কিত’ নেপথ্য নায়ক! কারণ তিনিই তিন দিন আগে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সভার মঞ্চ থেকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছিলেন, ‘‘উনি কত বড় এসপি, আমরা দেখব।’’ কমিশন সেই এসপি-কে সরাতে দেরি করেনি! ঠিক যেমন, মেদিনীপুর কেন্দ্রে লোকসভার প্রার্থী তথা বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ নির্বাচনী সভায় দাঁড়িয়ে রীতিমতো শাসাচ্ছেন, পুলিশ বিজেপির লোকেদের ‘ভয়’ দেখালে তিনি নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে তাদের কোচবিহারের এসপি’র মতো ‘গ্যারাজ’ করে দেবেন। আর, তৃণমূলের লোকেরা ‘ভয়’ দেখালে ভোটার তালিকা থেকে তাঁদের নাম কাটিয়ে দেবেন। মেঠো বক্তৃতায় এ সব বলে হাততালি হয়তো মেলে। কিন্তু যে ধরনের সঙ্কেত ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে, তার পরে এমন হুমকিতে মনে হতেই পারে, নির্বাচন কমিশনকে ‘নাচানো’র সুতো নিশ্চিত ভাবে তাঁদেরই হাতে। কমিশনের নিরপেক্ষতা নামক বস্তুটি কি তা হলে সত্যিই সোনার পাথরবাটি!
ভোটের জল এখনও অনেক গড়াবে। আরও কত কী হবে, বলা কঠিন। আপাতত তথ্যের খাতিরে বলে রাখা যায়, চাকরিতে দু’বছরের এক্সটেনশন পাওয়া তামিলনাড়ু পুলিশের বর্তমান ডিজি-র বিরুদ্ধে একটি গুটখা নির্মাতা সংস্থার কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ছিল। সিবিআই তাঁর বাড়ি তল্লাশিও করেছিল। তাঁর কর্তৃত্বেই কিন্তু ভোট হতে যাচ্ছিল ওই রাজ্যে। প্রাক্তন আমলারা এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরেই হঠাৎ ‘বোধোদয়ে’ কমিশন তাঁকে ভোটের কাজ থেকে সরিয়ে ডিজি (নির্বাচন) বলে এক নতুন পদ তৈরি করে দিল। তামিলনাড়ুতে ক্ষমতাসীন এআইডিএমকে এ বার বিজেপির ভোট-সঙ্গী! মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy