সান্তিয়াগোর রাস্তায় পুমা। ফাইল ছবি
‘এক দিন ঝড় থেমে যাবে/ পৃথিবী আবার শান্ত হবে’— ঝড় থামার আশায় এখন গোটা বিশ্ব। করোনা নামের অতিমারির ঝড় আছড়ে পড়েছে পৃথিবীতে। সারা বিশ্ব মুক্তির পথ খুঁজছে। করোনা আসলে সাধারণ ফ্লু-এর মতো ভাইরাস। এর পোশাকি নাম ‘কোভিড-১৯’। দেখা যাচ্ছে, ভাইরাসটি বয়স্ক এবং আগে থেকে অসুস্থ মানুষদের কাছে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। এখনও অবধি এর কোনও ওষুধ এবং প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। একমাত্র সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং পরিচ্ছন্ন থাকাতেই রক্ষা পাওয়া সম্ভব এর থেকে।
জানুয়ারির শেষ দিক থেকে ভারতে এ বিষয়ে আমরা সচেতন হতে শুরু করেছি। ভারতে প্রথম সংক্রমণের খবর আসে ৩০ জানুয়ারি উহান থেকে ফেরা কেরলের কিছু ছাত্রের রিপোর্টে। ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ‘হু’ এই রোগটিকে অতিমারি (প্যানডেমিক) বলে ঘোষণা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সামগ্রিক লকডাউন। বিশ্বের অন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও লকডাউন চালু হয় ২৪ মার্চ থেকে। সারা বিশ্বই এখন গৃহবন্দি। দিনে দিনে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ভয়ের একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সরকার ও প্রশাসন যদিও ভয় না পেয়ে, সচেতন হতে বলছে। কিন্তু উল্টো দিকে, এতে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের চারপাশের প্রকৃতি।
কয়েক হাজার বছর ধরে অন্ন ও বাসস্থানের খোঁজে মানুষ প্রকৃতিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। আমরা প্রকৃতির অন্য সন্তানদের কথা না ভেবেই ‘ধরাকে সরা’ জ্ঞান করেছি। মানুষ নিজেকে সর্বময় কর্তা ভাবার পরে এই ধরিত্রীর সব কিছুতেই থাবা বসিয়েছে। নিজের জীবনের সব শখ, আহ্লাদ পূরণ করতে গিয়ে বন, বন্যপ্রাণকে চরম বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে। বুঝতে পারিনি নিজেদের অস্তিত্বও খাদের কিনারে পৌঁছে গিয়েছে। প্রকৃতিবিদ ও বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে পেয়েছেন বেশ কিছু শিউরে দেওয়ার মতো তথ্য। অরণ্য নিধনের ফলে অরণ্যের মধ্যে থাকা হাজারো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াকে আমন্ত্রণ করেছি নিজের ঘরে। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। আর তার থেকে হাজার হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের প্রাকৃতিক শত্রুরা সব ফিরে আসছে নতুন রূপে। অভিযোজিত এবং আগের থেকে আরও শক্তিশালী হয়ে। যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো অভিজ্ঞতা বা অস্ত্র কোনটাই নেই আমাদের শরীরে।
মনে করা হচ্ছে, উহানের মাংসের বাজারে বাদুর বা প্যাঙ্গোলিন থেকে এই সংক্রমণ শুরু হয়। ইবোলা সংক্রমণের ইতিহাসও বলছে শিম্পাঞ্জি থেকে সংক্রমিত হওয়ার তথ্যের কথা। এডসের কারণ এইচআইভি ভাইরাস ছড়ানোর নেপথ্যেও সেই বন্যপ্রাণ এবং মানুষের অসংযমী আচরণ। বাঁদর থেকে শিম্পাঞ্জি হয়ে মানুষে সংক্রমণ। কোভিড-১৯-এও সেই জুনোটিক ট্রান্সমিশন থেকে হিউম্যান ট্রান্সমিশন। এ সব বাজারে আসা অধিকাংশ জীবদের আনা হয় চোরাগোপ্তা পথে, আর তাদের রাখা হয় অপ্রাকৃতিক পরিবেশে। বিশ্বব্যাপী প্রাণীজ প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে শুধু চিন নয়, বিশ্বের বহু দেশ চোরাচালানের পথে আসা বন্য জন্তুর মাংসকে ব্যবহার করছে। প্রায় ৭০ শতাংশ বন্যজন্তু এই যোগান পূরণে ব্যবহৃত হয়। এই তালিকায় আছে নেকড়ের ছানা, হরিণ, ময়ূর, শেয়াল, বেড়াল, বড় স্যালম্যান্ডার, ইঁদুর, শজারু, বাঁদর, শিম্পাঞ্জি, বিভিন্ন সাপ, প্যাঙ্গোলিন... তবে শুধু মাংস নয়, ওষুধ তৈরিতেও এদের ব্যবহার করা হয়। আসলে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে যে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ ছিল তা লঙ্ঘন করেছে মানুষ। ধ্বংস করেছে বন্য জন্তুদের আবাস, জঙ্গল থেকে তাদের এনে ফেলেছে খাবার টেবিলে আর তাতেই ঘটছে এ সব ভাইরাসদের সংক্রমণ বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।
নোভেল করোনার দাপটে তালাবন্ধ বিশ্বের প্রায় সব কর্মকাণ্ড। নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো বিপর্যস্ত। বিধস্ত জনজীবন। কিন্তু তার মধ্যেও কোথাও যেন স্বস্তি মিলেছে নীল আকাশ দেখে। সকালে ওঠার তাড়া নেই। নেই ছুটে বাস, ট্রাম ধরে অফিসে, স্কুলে পৌঁছনোর তাড়া। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আজ সঙ্গত শোনা যাবে বসন্তবৌরি, পাপিয়া আর দোয়েলের। সারা দিন সময় দেওয়া যায় পরিবার, পরিজনদের। ধুলোজমা বইয়ের র্যাক থেকে নামিয়ে বইগুলি পড়া বা পড়ে থাকা হারমোনিয়াম কিংবা তানপুরাটা ব্যবহারের ফুরসত মানুষকে করে দিয়েছে প্রকৃতি। করোনার প্রকোপে যখন সারা বিশ্বের মানুষ গৃহবন্দি তখন আমদাবাদের আকাশে দেখা গেল পাখিদের আঁকিবুঁকি। ভিড় জমানো সমুদ্র সৈকত বা মোহনাগুলি আজ খাঁখাঁ করছে। আর তাতেই খেলায় মেতেছে পাখিদের দল। শুধু পাখি কেন, ওড়িশার রুশিকুণ্ডা নদীর মুখে দেখা গেল হাজারো ‘অলিভ রিডিল টার্টল’ প্রজাতির কচ্ছপ নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ডিম পাড়ছে। কেরলের ব্যস্ত রাস্তা আজ ফাঁকা আর তাই শহুরে রাস্তার সিগন্যালকে কুছ পরোয়া নেহি ভাব দেখিয়ে দুর্লভ প্রজাতির মালাবার ভামের হেঁটে যাওয়া। আজ মানুষের বদলে নয়ডার শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে নীলগাই। শুনশান রাস্তা আর জন-মানবহীন শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইসন, চিতল হরিণ, সম্বর হরিণ, বন্য শুয়োর। রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ার ভয় নেই ব্যাঙ বা সাপদের। বর্জ্য পদার্থ মেশেনি জলে। ভেনিসের লেকে মোটরবোটের দাপাদাপি নেই। আর তাই জলের নীচের মাছের ঝাঁকেরা দ্বিধা করেনি উপরে ভেসে আসতে। রাজহাঁসেরাও বাদ নেই সেখানে। চণ্ডীগড়ের বাগানে চিতা হোক বা চিলির সান্তিয়াগোতে পুমা। বন্যেরা বন ছেড়ে শহরে। আসলে বন কেটে সাফ করে শহর বানিয়েছি আমরা। আজ বন্যপ্রাণীরা যেন ফিরিয়ে নিতে এসেছে তাদের অধিকার।
কর্মব্যস্ত মানুষেরা আজ করোনার ভয়ে ঘরের কোণে। তালা পড়েছে কারখানায়। স্তব্ধ গণপরিবহণ। শুধুমাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া আর কোনও কিছুতেই ছাড় নেই। আজ কিছুটা হলেও পরিবেশ সময় পেয়েছে নিজেকে সুস্থ করে তোলার। পৃথিবী কাটিয়ে নিচ্ছে তার ক্লান্তি। পরিবেশ দূষণের মাত্রা এখন অনেক কম। কমেছে গ্রিন হাউস গ্যাসগুলির নির্গমণের পরিমাণ। এক ধাপে বায়ুবাহিত দূষণের মাত্রা কমেছে। কমেছে শব্দদূষণও। কার্বন মনোক্সাইড-সহ অন্য ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ কমেছে ৫৩ শতাংশের মতো। আশা করি আমরা খুব শীঘ্রই করোনাকে হারিয়ে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরবে। কারণ, কোনও ভাবেই কোনও অতিমারির মূল্যে, মানুষের জীবনের মূল্যে এই পৃথিবী আমরা চাই না। তবে করোনা আমাদের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে আগামী দিনের জন্য। রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। প্রয়োজন চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নত পরিকাঠামো। পাশাপাশি, আমাদের ভাবা দরকার, প্রকৃতিরও প্রয়োজন অবসরের। করোনা যুদ্ধে জয়ী হয়ে পৃথিবীর সব দেশের মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে বছরে এক দিনের জন্য হলেও বিশ্বব্যাপী লকডাউনের। আমাদের লোভের সীমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি আমরা নিজেরাই। বন্ধ হোক বিশ্বজুড়ে চলা বন্যপ্রাণ নিধন। বন্ধ হোক উন্নয়নের নামে অরণ্য উচ্ছেদ। নিজেদের না শুধরালে কে বা বলতে পারে আগামী দিনে অন্য কোনও ‘জীবাণু যোদ্ধা’ মারক অস্ত্র নিয়ে আসবে আমাদেরই ভুলের সাজা দিতে।
শিক্ষক, সিয়ারশোল জুনিয়র
বেসিক স্কুল, রানিগঞ্জ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy