Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

সংখ্যালঘুদের বাঁচাতেই এই চুক্তি

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে বক্তৃতা করতে উঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হঠাৎ সত্তর বছরের পুরনো, ১৯৫০ সালে সই হওয়া নেহরু-লিয়াকত চুক্তির কথা উল্লেখ করলেন।

জওহরলাল নেহরু ও লিয়াকত আলি।

জওহরলাল নেহরু ও লিয়াকত আলি।

অন্বেষা সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৩০
Share: Save:

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে বক্তৃতা করতে উঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হঠাৎ সত্তর বছরের পুরনো, ১৯৫০ সালে সই হওয়া নেহরু-লিয়াকত চুক্তির কথা উল্লেখ করলেন। তাঁর মতে, পাকিস্তান এই চুক্তিকে যথাযথ মান্যতা দেয়নি। সেখানে সংখ্যালঘুরা ক্রমাগত নিপীড়িত হয়ে এসেছেন। তাই মহানুভব ভারত সরকার এত দিনে সেই নিপীড়িত হিন্দু-শিখ-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-জৈনদের নাগরিকত্ব দিতে উদ্যোগী হয়েছেন এই সংশোধনী আইনের মাধ্যমে।

ইতিহাসকে ইচ্ছেমতো বিকৃত করে ব্যবহার করায় এই সরকারের পারদর্শিতা প্রশ্নাতীত। তাই মাঝে মাঝে ইতিহাস ঝালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। মূল কথাটা বলা দরকার প্রথমেই— নেহরু-লিয়াকত চুক্তি দুই বাংলা, অসম ও ত্রিপুরার ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের দেশে থাকা, দেশ ছাড়া ও সর্বোপরি দেশে ফেরার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে খুলনা জেলার কালশিরা গ্রামে স্থানীয় পুলিশ ও কিছু কমিউনিস্ট সমর্থক নমশূদ্র পরিবারের মধ্যে সংঘাত দিয়ে শুরু হয় ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই দাঙ্গা দ্রুত পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিপুল উদ্বাস্তু-স্রোত আছড়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তান ও পূর্ব ভারতে। এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি কী ভাবে সামলানো যায়, এবং কী ভাবে দুই দেশের সংখ্যালঘু মানুষের ও উদ্বাস্তুদের প্রাণ ও সম্পত্তি সুরক্ষিত করা যায়, তা নিয়ে নেতা ও আমলারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেন। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেও চিঠির আদান-প্রদান শুরু হয়। এপ্রিল মাসের গোড়ায় দিল্লিতে বৈঠকে বসেন জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি। ৮ এপ্রিল সই হয় তাঁদের চুক্তি, যা দিল্লি চুক্তি নামেও পরিচিত।

এই চুক্তি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল পূর্ব ভারতের তিন রাজ্য বাংলা, অসম ও ত্রিপুরা এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। দাঙ্গাবিধ্বস্ত এই অঞ্চলের সংখ্যালঘু ও উদ্বাস্তুদের আশ্বস্ত করাই ছিল এই চুক্তির উদ্দেশ্য। নেহরু ও লিয়াকত আলি এই চুক্তির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান ও পূর্ব ভারতের সংখ্যালঘুদের প্রতিবেশী দেশে অভিবাসনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেন ও তাঁদের যাত্রাকালীন নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেন। উদ্বাস্তুরা যথাসম্ভব অস্থাবর সম্পত্তি ও মাথাপিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ টাকা নিয়ে যেতে পারবেন, এ কথাও বলা হয়। গয়না বা টাকা সঙ্গে না নিতে চাইলে ব্যাঙ্কে রেখে রসিদ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। তাঁরা যদি বছর ঘোরার আগে ফিরে আসেন, তা হলে সরকারের দায়িত্ব তাঁদের স্থাবর সম্পত্তিতে ও জীবিকায় পুনর্বাসিত করা, এমন কথাও বলা হয়। একান্ত অপারগ হলে সমমানের বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা করার কথাও ছিল এই চুক্তিতে। তাঁরা না ফিরলে সেই সম্পত্তি থেকে ভাড়াবাবদ আয়ে তাঁদের সম্পূর্ণ অধিকার স্বীকার করা হয়। জমি বাড়ি বিক্রি করার ক্ষমতাও তাঁদের দেওয়া হয়। সদ্য ঘটে যাওয়া দাঙ্গার প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিশন তৈরি ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সংখ্যালঘু মানুষের মনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য একাধিক মন্ত্রী-আমলা নিয়ে এই রাজ্যগুলিতে গঠিত হয় উচ্চক্ষমতা-বিশিষ্ট মাইনরিটি কমিশন। ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক জন সাংসদকে।

পাশাপাশি, দুই দেশই যে সংখ্যালঘুদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও ধার্মিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সে কথাও পুনরায় লিপিবদ্ধ করা হয় এই চুক্তিতে। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রীরা স্বীকার করেছিলেন যে দু’দেশেই সংখ্যালঘু মানুষ ভাল নেই। তাঁদের ভাল রাখার দায়িত্ব সরকারের। একে অন্যকে দোষারোপ না করে সমাধানের পথ খুঁজেছিলেন তাঁরা।

নেহরু-লিয়াকত চুক্তিতে মানুষের, বিশেষ করে উদ্বাস্তু ও সংখ্যালঘুদের, বিশ্বাস অর্জনের একটা স্পষ্ট প্রচেষ্টা ছিল। এক অস্থির সময়কে কী ভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তাই নিয়ে আলাপ-আলোচনার ফল এই চুক্তি। এই সাম্প্রদায়িক সময় থেকে বেরিয়ে এক অন্য রকম ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি ছিল এই চুক্তিতে। কথায় কাজে তফাত দু’দেশেই ছিল। প্রতিশ্রুতি কোনও দেশই রাখেনি। ভারতীয় উপমহাদেশের এই অংশে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, ভাষাগত সংখ্যালঘুরাও) বার বার অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। তা সত্ত্বেও নেহরু ও লিয়াকতের শান্তিস্থাপনের প্রয়াসটাকে স্বীকার করা জরুরি। কোনও দেশের সরকার যদি খাতায়-কলমে সাম্প্রদায়িক হয়ে যায়, তা হলে সেই দেশ হিটলারের জার্মানির সঙ্গেই তুলনীয়। ১৯৫০-এর চুক্তি সেই পথ থেকে দুই দেশকেই বিরত রেখেছিল।

এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-সহ হিন্দু মহাসভার নেতারা। দুই পঞ্জাবের মতো তাঁরা পূর্ব পাকিস্তান ও পূর্ব ভারতের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জনবিনিময় করার দাবি করেছিলেন। আর পাশাপাশি তাঁদের অনেকের দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে আরও জমি— যাতে এ দেশে জায়গার অভাব না হয়। পাকিস্তান এই প্রস্তাবে আপত্তি করলে নেহরু সরকারের যুদ্ধ ঘোষণা করা উচিত, এই দাবি করেন হিন্দু মহাসভার নেতারা। যুদ্ধ বা জনবিনিময়ের পথে না হেঁটে যখন নেহরু সরকার এই চুক্তি সই করে, শ্যামাপ্রসাদ অবিলম্বে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। শ্যামাপ্রসাদ আদর্শগত ভাবে এই চুক্তির বিরোধী ছিলেন, তাই বাস্তবে এর ফল কী দাঁড়ায়, তা না দেখেই তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন।

লড়াইটা সত্যিই আদর্শের। এক দিকে মিলেমিশে থাকার আদর্শ, আর অন্য দিকে মিলেমিশে থাকা সম্ভব বা কাম্য নয়, এই বিশ্বাস। এক দিকে দিল্লি চুক্তি, অন্য দিকে দাঙ্গা, গৃহযুদ্ধ আর যুদ্ধ। এক দিকে নেহরু, অন্য দিকে শ্যামাপ্রসাদ। ১৯৪৭ থেকে চলে আসা এই আদর্শের লড়াইয়ে এই মুহূর্তে পাল্লা অনেকটাই ভারী শ্যামাপ্রসাদের দলবলের দিকে। হিংসা, ঘৃণা ও অবিশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁরা নতুন ভারত গড়তে চান।

ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy