স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী যুগে ভারতীয় রাজনীতির মূল ভিত্তিভূমিই ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা।
অমিতাভ গুপ্তের ‘পাশাপাশি ধর্ম ও রাজনীতি’ (২৪-৮) শীর্ষক প্রবন্ধ বিষয়ে কিছু বক্তব্য সংযোজন করতে চাই। আজ অধিকাংশ মানুষই বোধ হয় বিস্মৃত হয়েছেন যে, ধর্ম ছাড়াও বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকা যায়। ধর্মকে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে যেমন সংশয়বাদ, অজ্ঞেয়বাদ বা চার্বাকবাদের সূত্রপাত হয়েছে, এর বিপ্রতীপে ধর্মনিরপেক্ষতাকেও সংশয়ের গণ্ডির মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে।
এ সম্পর্কে মাননীয় অমর্ত্য সেন রচিত ‘সেকুলারিজ়ম এবং সে সম্পর্কে বিবিধ আপত্তি’ শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রণিধানযোগ্য। উনি সরাসরি ব্যাখ্যা করেছেন যে, “ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্দেশে করা আক্রমণের অধিকাংশ এসেছে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী কর্মীদের তরফ থেকে...। তবুও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি যে মননশীল সংশয় রয়েছে, তা কেবলমাত্র সক্রিয় রাজনীতিকদের মধ্যেই সীমায়িত থাকেনি। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিদগ্ধ তাত্ত্বিক আলোচনায় এই সংশয়ের সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে।... যদি আজ বহুধর্মী ভারতবর্ষের ভাবাদর্শের মূলভিত্তি স্বরূপ ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিবর্ণ এবং ক্লান্ত ও নিঃশেষিত বলে মনে হয়, তা হলে এই নির্ধারণকে ভুল বোঝা হবে ও গুরুত্বহীন করে দেওয়া হবে...। ধর্মনিরপেক্ষতার যাজক প্রদত্ত অর্থ না নিয়ে যদি রাজনৈতিক অর্থ গ্রহণ করা হয়, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে যে-কোনও বিশেষ একটি ধর্মপ্রবৃত্তি থেকে পৃথক রাখতে হবে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপে কোনও একটি বিশেষ ধর্মকে সুবিধাজনক স্থান দেওয়া স্বীকৃত হবে না। এটা স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, সুবিধাজনক স্থান না দেওয়া বলতে কী অর্থ বহন করে, আর কী করে না। এর জন্য যে রাষ্ট্রকে সমস্ত প্রকার ধর্মীয় প্রসঙ্গের সংস্রব বাঁচিয়ে চলতে হবে, তা আবশ্যক নয়। বরং রাষ্ট্রকে যত ক্ষণ অবধি বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়, তা যেন মূলত সমদর্শী ব্যবহারের ভিত্তিতে হয়, তা সুনিশ্চিত করতে হবে।”
এখানে ‘সমদর্শী ব্যবহারের ভিত্তি’ কথাটি বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র স্বয়ং যখন জনগণের প্রতি সম-দর্শন থেকে বিচ্যূত হয়, তখন তা সাধারণের পক্ষে বিপজ্জনক বার্তা বহন করে বইকি। আসলে এটা সেই বহুচর্চিত কথা যে, মানুষ ধর্ম ছাড়া বেঁচেবর্তে থাকতে পারবে, কিন্তু রাষ্ট্র পারবে না। আধুনিক ভারতীয় রাজনীতি বারংবার প্রমাণ করছে যে, ধর্মই তার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। ভারতে বর্তমানে সেকুলারিজ়ম মানে এক সোনার পাথরবাটির মতো ধারণা। অথচ, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী যুগে ভারতীয় রাজনীতির মূল ভিত্তিভূমিই ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। আজ ক্রমশ যে ধর্মনিরপেক্ষতা এক ধূসর পাণ্ডুলিপিতে পরিণত হচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখের।
বিশ্বদীপ ভট্টাচার্য, কল্যাণগড়, উত্তর ২৪ পরগনা
নাস্তিকতা নয়
‘পাশাপাশি ধর্ম ও রাজনীতি’ প্রবন্ধটির আলোচনা অত্যন্ত যথাযথ লাগল। সেই প্রসঙ্গে বলি, পরধর্মে সহিষ্ণুতার কথা গুণী-জনে নানা ভাবে বার বার বলেন। রবি ঠাকুরের ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’, কিংবা রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’। কোনও কথার কথা নয়, বা চমক দেওয়ার কথা নয়। তাঁদের এই চিন্তাপ্রসূত ভাবনাই সর্বনাশ থেকে সমাজকে রক্ষা করার একমাত্র পথ। সংবিধানে তাই ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে পরধর্ম সহিষ্ণুতার কথাই বলে। পরধর্মের ছিদ্রান্বেষণ না করেও যে নিজ ধর্মের উন্নয়ন ঘটানো যায়, এ কথা জানা চাই, মানা চাই। রাজনীতিতে নৈতিকতার অভাব দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। তাই রাজনীতিকে ধর্মের বাইরে না রাখলে যে বিপদ, তা এ দেশের মানুষ বারে বারে এবং হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
আচার-বিচারে, খাদ্যে, পোশাক-পরিচ্ছদে, অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে তফাত থাকবে এবং সেটাই উপভোগ্য হওয়ার কথা। কিন্তু তা যে হয়নি, সে আমাদের দুর্ভাগ্য। বরং সেই তফাতকে কৌশলে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে লড়িয়ে দিয়ে জ্বলন্ত সমস্যা তৈরি করা হয়েছে এবং আক্ষরিক অর্থেই। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত মানুষদেরও পইপই করে বোঝাতে হচ্ছে। প্রবন্ধকার ঠিকই বলেছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে নাস্তিকতা হিসেবে দেখানো খুব সহজ এবং সেটাই হচ্ছে। এটা খুবই সত্য যে, নিজের ধর্মের প্রতি যাদের সত্যিকারের বিশ্বাস রয়েছে, তারা অন্য ধর্মের স্বার্থহানির কথা কখনও ভাবে না। গান্ধীজির মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ধর্মীয় ভাবনায় সেটা যে ধরা আছে, তা লেখক সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন।
দুর্গেশকুমার পান্ডা, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
‘হিন্দু রাষ্ট্র’ কী?
অমিতাভ গুপ্তর ‘পাশাপাশি ধর্ম ও রাজনীতি’ বিষয়ক প্রবন্ধে বর্ণিত কয়েকটি বিষয়ে প্রবন্ধকারের সঙ্গে সহমত পোষণ করতে পারলাম না। হিন্দু রাষ্ট্র বলতে তিনি কোনও এক শঙ্করাচার্য পরিষদের হিন্দু রাষ্ট্র পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভারতবর্ষ আদি অনন্ত কাল থেকে সনাতন হিন্দু সমাজের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস, পরম্পরা, ভাষা, বেদ, উপনিষদ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদির উপর নির্ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রের কল্পনা কিন্তু ধর্মহীন হতে পারে না। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীন নয়। এখানে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে কোনও বাধা নেই।
কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ দঁাড়িয়েছে ধর্মহীনতা। স্বামীজি বলেছেন, শাশ্বত সনাতন ধর্মই হল ভারতের আত্মা। হিন্দুরাই বলতে পেরেছে ‘সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ’। অর্থাৎ, সকলের সুখ ও নিরাময়ের কথা বলা হয়েছে। অমৃতের পুত্র আমরা সকলে। সুতরাং, হিন্দু রাষ্ট্র ভাবনায় সঙ্কীর্ণতার কোনও স্থান নেই।
হিন্দুত্ব হিন্দু রাষ্ট্রের মূল মন্ত্র। হিন্দুত্ব হল জীবন পদ্ধতি। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হিন্দুত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলেছেন এটি হল ‘ওয়ে অব লাইফ’। সেই প্রাচীন কাল থেকে সনাতন সংস্কৃতি ও জীবন পদ্ধতি চলে আসছে। হিন্দু রাষ্ট্রের অধিবাসী হিসেবে শুধু মুসলিম, খ্রিস্টান কেন, যাঁরা এই দেশকে নিজের মাতৃভূমি, পুণ্যভূমি, ধর্মভূমি মনে করবেন, তাঁরাই এখানকার বাসিন্দা। এটাই একমাত্র শর্ত। সুতরাং, অপপ্রচারের শিকার না হয়ে ভারতের মূল সত্তাকে স্বীকার করতেই হবে। না হলে ভাবের ঘরে চুরি করার শামিল হবে। হিন্দু রাষ্ট্রের কল্পনায় সকলের সমান অধিকার থাকবে না, এমনটা সত্যের অপলাপ ছাড়া অন্য কিছু নয়। সেই জন্য আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত যথার্থই বলেছেন, সকল ভারতবাসীর মধ্যে একই ডিএনএ রয়েছে।
প্রবন্ধকার আরএসএস সম্পর্কে যা বলেছেন, তার সঙ্গে আমি একমত নই। বেশির ভাগ মানুষই অপপ্রচারের শিকার হয়ে আরএসএস-কে দোষারোপ করেন। নিকট থেকে দেখার সুযোগে বলতে পারি, এটি একটি বিশুদ্ধ দেশপ্রেমিক সংগঠন যারা রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ স্থানে রেখেছে। স্বামীজির আদর্শে মানুষ তৈরির শিক্ষাই এই সংগঠনের উদ্দেশ্য। এদের শিক্ষা শিবির দেখেছি, বক্তৃতা শুনেছি, পুস্তক পড়েছি, সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে দেখেছি। ডাক্তার, অধ্যাপক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, উচ্চপদে আসীন সরকারি কর্মচারী, উকিল-সহ সাধারণ মানুষই এই সংগঠনের কারিগর। এই সংগঠনের যাঁরা সর্বক্ষণের কর্মী, সকলেই সর্বস্ব ত্যাগ করে দেশের সেবায় নিজেকে যুক্ত করেছেন। আরএসএস একটি অরাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন। এঁরা নীরবে কাজ করেন। মূলত তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে সংগঠন করেন— ১) লোক সংগ্রহ ২) লোক নির্মাণ এবং ৩) লোক নিয়োজন।
এঁরা প্রচারবিমুখ বলে মানুষ এঁদের সম্পর্ক জানতে পারে কম। এঁদের সংগঠনের কোনও উচ্চ-নীচ-জাতি ভেদাভেদ নেই। প্রবন্ধকার কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের অপপ্রচারের শিকার হয়ে অজানতে আরএসএস সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করেছেন বলেই মনে করি।
আনন্দ মোহন দাস, উত্তরপাড়া, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy