Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: আমাদের জন্যই ফ্লপ

এই প্রকৃত সত্যটি আমরা কিছুতেই স্বীকার করি না যে, বিদ্যাসাগরের উদ্যোগটি ‘ফ্লপ’ করল আমাদেরই ঔদাসীন্যে, মনের ভেতরকার বিরোধিতায়।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৯ ২৩:৫৭
Share: Save:

শুভ্রাংশু কুমার রায়ের ‘মনুষ্যত্বই মূলধন’ (২৭-৯) শীর্ষক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। হয়তো অধিকাংশ আবেগপ্রবণ বাঙালির মতোই ওঁরও মনে হয়েছে যে ‘বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর’ (রবিবাসরীয়, ২২-৯) লেখাটিতে লেখক কেবল নেতিবাচক দিকটিই বড় করে দেখিয়েছেন। মনে হয় না তাঁর বোঝাটা সঠিক হয়েছে বলে। যত দূর বুঝেছি, তাতে মনে হয়েছে, লেখক বোধ হয় এটাই পত্রপত্রিকার সাহায্যে তুলে ধরেছিলেন যে আমরা বা এই সমাজ বিধবাবিবাহকে গ্রহণ করতে পারিনি। বিদ্যাসাগরের উদ্যোগকে বোধ হয় তিনি ছোট করে দেখাননি। বাস্তব চিত্রটা তুলে ধরেছেন।

এই প্রকৃত সত্যটি আমরা কিছুতেই স্বীকার করি না যে, বিদ্যাসাগরের উদ্যোগটি ‘ফ্লপ’ করল আমাদেরই ঔদাসীন্যে, মনের ভেতরকার বিরোধিতায়। পণ্ডিতমশাই নিজেও তা বুঝেছিলেন। শ্রীরায় লেখকের বক্তব্য বিধবাবিবাহে ‘‘কতটা লাভ হয়েছিল’’-র জের টেনে ‘লাভ’ শব্দটি কত দূর প্রযোজ্য তা ভেবে দেখার অনুরোধ করেছেন। শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নকে স্ত্রীর মৃত্যুর পর কেন প্রায়শ্চিত্ত করে জাতে উঠতে হয়েছিল, আর মেদিনীপুরের কেদারনাথ দাসকেও কেন ছোটভাইয়ের জন্য একই পথ বেছে নিতে হয়, শ্রীরায়কে এক বার ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। কিছু বিধবার জীবন সার্থক হয়েছিল। এই সত্যির পাশাপাশি যাদের জীবন সার্থক হল না, বৈধব্যদশা ঘুচল না, সেটাও তো ইতিহাসের মানুষদেরই দেখাতে হবে।

ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী

তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

বাস্তব বুঝুন

আমার ‘বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর’ (রবিবাসরীয়, ২২-৯) লেখাটি সম্পর্কে শুভ্রাংশু কুমার রায়ের (‘মনুষ্যত্বই মূলধন’, ২৭-৯) চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। আমার লেখায় শ্রীরায় গালগল্প আর কেচ্ছা খোঁজার চেষ্টাই দেখতে পেয়েছেন। প্রথম কথা, সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সংবাদ-সাময়িকপত্রে প্রকাশিত বাস্তব ঘটনাগুলো আমার পক্ষে কখনওই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যেখানে বিধবাবিবাহের সংখ্যা হাজারেরও অনেক নীচে, সেখানে এ ধরনের ‘গালগল্প’ হাজার হাজার। অতএব এটি বাস্তব সত্য।

দ্বিতীয় কথা, এই আন্দোলন যে সফল হল না, তা স্বীকারে এত দ্বিধা কেন? এ তো বিদ্যাসাগর মশাইয়ের ব্যর্থতা নয়। দীর্ঘ দিনের এক বন্ধ দরজা তো তিনি খুলে দিলেন দেশকালের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। ব্যর্থতা তো আমাদের, আমরা নিতে পারিনি, আজও নয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতৃদেব দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিদ্যাসাগর লিখছেন— ‘‘আমাদের দেশের লোক এত অসাড় ও অপদার্থ বলিয়া পূর্ব্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।’’ লিখছেন ‘দেশহিতৈষী’দের কথায় বিশ্বাস করে ‘‘ধনে প্রাণে মারা পড়িলাম’’। অর্থাৎ তিনি প্রবঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরই দেশের মানুষের দ্বারা।

আর ১৩৪ বছর আগেই এক জন লিখেছিলেন ‘‘অদ্য ২৯ বৎসর হইল উহার (বিধবাবিবাহের) আইন’ হয়েছে, কিন্তু ‘কী ফল হইয়াছে?’’ জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, যাঁরা তাকে উৎসাহ দেন ‘‘তাঁহারা শুক্ল প্রতিপক্ষের চাঁদের মতো উদয় হইতে না হইতেই অদৃশ্য হইলেন।’’ আর স্ববিরোধের গল্পও ছিল। যে শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে বিধবাবিবাহ করেন তিনিই তাঁর বিধবাশ্রমে থাকা একটি মেয়ে তাঁর ‘কৃতী’ সন্তানের ঔরসে গর্ভবতী হয়ে পড়লে সেই বিধবার সঙ্গে ছেলের বিবাহ দেননি।

শেখর ভৌমিক

কলকাতা-৫৫

রসবোধ

‘প্রথম ভাগ’ (২৬-৯) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে বিদ্যাসাগরের বাস্তববাদী চিন্তাভাবনা ও কাজকর্মের কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের অসম্ভব যুক্তিবাদী মন ও অসাধারণ রসবোধের কথাও বলতে হয়। এর সার্থক নিদর্শন আমরা পাই ‘ব্রজবিলাস’ (১৮৮৪) গ্রন্থে। ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে বিদ্যাসাগর এই গ্রন্থটি রচনা করেন। এই গ্রন্থের পঞ্চম উল্লাসে (অধ্যায়) বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে তিনি নিজে কী লিখেছেন তার একটা অংশ আমি পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরলাম—

‘‘পূর্বাপর যেরূপ দেখিয়া আসিতেছি, তাহাতে হতভাগার বেটার বিষয়বুদ্ধি বড় কম; এমন কি নাই বলিলেও, বোধ হয়, অন্যায় বলা হয় না। বিষয়বুদ্ধি থাকিলে, তিনি, কখনই, বিধবার বিবাহকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করিতেন না। বিধবার বিবাহে হাত দিয়া, পবিত্র সাধুসমাজে হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইয়াছেন, সকল লোকের গালাগালি খাইতেছেন, এবং শুনিতে পাই, ঐ উপলক্ষে দেনাগ্রস্তও হইয়াছেন। ইহারই নাম, আপনার নাক কাটিয়া পরের যাত্রাভঙ্গ করা। এই ঝকমারিকাণ্ডে লিপ্ত হওয়াতে, তাঁহার নিজের নাকালের চূড়ান্ত হইয়াছে; এবং পুণ্যভূমি ভারতবর্ষকে, বিশেষতঃ, পরম পবিত্র গৌড় দেশকে, সর্বোপরি, সোনার লঙ্কা যশোহর প্রদেশকে, একবারে ছারখার করিতে বসিয়াছেন। এমন বাঁদরামি, এমন পাগলামি, এমন মাতলামি, কেহ কখনও দেখিয়াছেন বা শুনিয়াছেন, আমার এরূপ বোধ হয় না। বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রেই বলিবেন, অথবা বলিবেন কেন মুক্তকণ্ঠে বলিতেছেন, তিনি, নাম কিনিবার জন্যে, দেশের সর্বনাশের পথ করিয়াছেন। দেখুন, বাটীতে বিধবা থাকিলে, গৃহস্থের কত উপকার হয়। প্রথমতঃ মিনি মাইনায়, রাঁধুনি, চাকরানি, মেথরানি পাওয়া যায়; দ্বিতীয়তঃ, সময়ে সময়ে, বাটীর পুরুষদিগের, প্রকারান্তরে, অনেক উপকার দর্শে; তৃতীয়তঃ বাটীর চাকরেরা বিলক্ষণ বশীভূত থাকে, ছাড়াইয়া দিলেও, হতভাগার বেটারা নড়িতে চায় না; চতুর্থতঃ প্রতিবাসীরা অসময়ে বাটীতে আইসেন। এটি নিতান্ত সামান্য কথা নহে; কারণ, যেরূপ দেখিতে পাওয়া যায়, অসময়ে কেহ কাহারও দিক্ মাড়ায় না। যে পাষণ্ড এই সমস্ত সুবিধা ও উপকারের পথ রুদ্ধ করিবার চেষ্টা করে, তাহার মুখদর্শন করা উচিত নয়। দুঃখের বিষয় এই, আমরা স্বাধীন জাতি নহি; স্বাধীন হইলে, এত দিন, কোন কালে, বিদ্যাসাগর বাবাজি সশরীরে স্বর্গারোহণ করিতেন।’’

সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা-৫৯

শুধু হিন্দু

বিদ্যাসাগরকে নিয়ে ইন্দ্রজিৎ চৌধুরীর ‘তাঁর ইংরেজি লেখার স্বীকৃতি কই’ (২৭-৯) শীর্ষক লেখা সম্পর্কে এ চিঠি। সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়ে (১৮৫১), রক্ষণশীল পণ্ডিতসমাজ, হিন্দুদের আপত্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্মানের কথা ভেবে বিদ্যাসাগর তাঁর কলেজে শূদ্রবর্ণের প্রবেশাধিকারের কথা সুপারিশ করতে পারেননি। তবে ১৮৫৪-তে তাঁর সুপারিশে ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ ছাড়াও নবশাখ শ্রেণির (তাঁতি, মালাকার, সদ্‌গোপ, নাপিত, বারুই, কামার, কুমোর, তিলি ও ময়রা) ছাত্রেরাও কলেজে পড়ার সুযোগ পেল। লক্ষণীয়, হিন্দু ছাড়া অন্য কোনও সম্প্রদায়ের ছাত্রের প্রবেশাধিকারের কথা বিদ্যাসাগরের মনে স্থান পায়নি।

আবার, যখন তিনি ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন, ৩৫ দফার একটি নিয়মাবলি প্রস্তুত করেন, সেখানে স্কুলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল, "...to give an efficient elementary education to Hindu youths..." অর্থাৎ, এই বিদ্যালয়ে অহিন্দুর প্রবেশাধিকার ছিল না। সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগর যে শুধুমাত্র হিন্দুসমাজ সংস্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, শিক্ষাবিস্তারে কেবল হিন্দু ছাত্রদের ভাবনাই ভেবেছেন, তা ভিত্তি পেয়ে যায়।

নির্মলকুমার নাগ

যশোর রোড (দক্ষিণ), বারাসত

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

অন্য বিষয়গুলি:

Ishwar Chandra Vidyasagar Widow Marriage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy