তৃষ্ণা বসাকের ‘কোথা অমৃত, কোথায় গরল’ (২৫-২) প্রবন্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ধর্মাচার কি প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধিকেও ভুলিয়ে দেয়? ধর্মাচার প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধিকে ভুলিয়ে দেয় কি না জানি না, তবে ধর্মাচারকে উৎসাহিত করে যাঁরা বিভিন্ন স্বার্থ সিদ্ধ করতে চান, তাঁরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধিকে দূরে না সরিয়ে তা করতে পারেন না। তাই তো দেখেছিলাম করোনা সংক্রমণের অব্যবহিত পরেই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে সব পদক্ষেপ করা হয়েছিল, তার সঙ্গে বিজ্ঞানের যোগ ছিল না, ছিল আচার-সর্বস্বতা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনকে উৎসাহিত করার প্রয়াস।
কুম্ভের জল স্নানেরও অযোগ্য— এ কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ-এর তথ্য অনুসারে, জানুয়ারির একাধিক দিন ত্রিবেণী সঙ্গমের জলে বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড বা বিওডি’র মাত্রা ছিল বিপজ্জনক। আরও বলা হয়েছিল যে, ত্রিবেণী সঙ্গমের জলে কলেরার ব্যাক্টিরিয়া (কলিফর্ম) পাওয়া গিয়েছে। ফলে পান করা তো দূর, সেই জল স্নানেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অথচ, সেখানেই ডুব দিয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। অবশ্য সরকার এ কথা মানতে রাজি হয়নি। তাদের মতে সঙ্গমের জল শুধু স্নানযোগ্যই নয়, তা পবিত্র জল যা পান করা যায়।
কুম্ভে মোট কত কোটি মানুষ স্নান করেছেন, তা কর্তাব্যক্তিরাই বলতে পারবেন। তবে, এই স্নানের জন্য রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী, সরকারি অফিসার, বিচারপতি এবং সচ্ছলদের জন্য ছিল আলাদা উন্নত ব্যবস্থা। কিন্তু ধর্মপ্রাণ আমজনতার জন্য যেমন উপযুক্ত যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না, তেমনই ছিল না থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত, স্নানের জন্য ভাল ব্যবস্থা। প্রয়াগরাজ যাওয়ার পথে এক সময় ২০০ কিমি দীর্ঘ ট্র্যাফিক-জ্যাম দেখা দেয়। একই ভাবে স্নানের লাইনও কয়েক কিমি দীর্ঘ। মাঝে মাঝে দড়ি উঠেছে আর ভক্তরা ঊর্ধ্বশ্বাসে স্নানের উদ্দেশে দৌড়েছেন। এরই মধ্যে স্নান করতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে অন্তত ৩০ জনের মৃত্যু ঘটে, আহত হন শতাধিক। যদিও বাস্তবে দু’টি সংখ্যাই আরও বেশি। এর পর নয়াদিল্লি রেল স্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান ভারতীয় রেলের হিসাব অনুযায়ী অন্তত ১৮ জন।
কুম্ভকে ‘অমৃতকুম্ভ’-এর গরিমা দিয়ে দীর্ঘ দিন থেকে এখানে সমস্ত ধর্মপ্রাণ মানুষকে জড়ো করার উদ্যোগ করেছিল বিজেপি সরকার। মেলা শেষে নানা কথা বলে প্রচারের আলো যে ভাবে রাষ্ট্রনায়করা নিজেদের উপর টেনে আনতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাতে কী উদ্দেশ্যে তাঁরা এই আয়োজনকে এত গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তা সহজবোধ্য। অথচ, এ নিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল ছিল। শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞানভিত্তিক মানসিকতা খুন করার যে উদ্যোগ দীর্ঘ দিন থেকে চলছে, এটা ছিল তারও একটা অঙ্গ। এ ক্ষেত্রে লিয়ো টলস্টয়-এর সেই কথা মনে পড়ে— সমস্ত অত্যাচারী শাসকের শক্তি নিহিত থাকে জনগণের অজ্ঞতার উপর।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
স্বার্থসর্বস্ব
তৃষ্ণা বসাকের ‘কোথা অমৃত কোথায় গরল’ প্রবন্ধটির শুরুতে প্রক্ষিপ্ত কবিতাংশ (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত ‘মীরার ভজন’)-এর মধ্যেই ফুটে উঠেছে তাঁর মূল বক্তব্যগুলির প্রধানটি— তীর্থস্নান করার এই যে হুজুগ, এর দ্বারা ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে না। প্রবন্ধে আর যে বিষয়গুলির উপর তিনি জোর দিয়েছেন, তার মধ্যে আছে— ১৯ ঘণ্টা বিলম্বে পৌঁছনো তাঁর ট্রেনযাত্রার তিক্ত অভিজ্ঞতা; মাঝরাতে কম্পার্টমেন্টে অধিকার-বহির্ভূত যাত্রীদের ভিড়ে তাঁর কন্যার ভীতি, সারা ক্ষণ বাধ্যতামূলক নামগান, তীর্থভ্রমণকারী মানুষগুলির টিকিট না-কাটা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধিকে ভুলিয়ে দেওয়া ধর্মাচরণ ইত্যাদি। আর, ‘…মনের মধ্যে যে সাতেপাঁচে না জড়ানো বুদ্ধিমান লোকটি বসে থাকেন’ তাঁর হয়ে বলতে চেয়েছেন (পরোক্ষে) এ সব ধর্মাচরণ ছেড়ে মানুষ যে কবে ‘মানুষ’ হয়ে উঠবেন! বলতে চেয়েছেন, প্রয়াগরাজে স্নান করতে যাওয়ার আনন্দের দায় ট্রেনের অন্য ভ্রমণার্থীরা কেন নেবেন?
সঙ্গত প্রশ্ন। প্রশ্নটি, মানুষের ‘মানুষ’ হয়ে ওঠা নিয়ে। প্রশ্ন— অন্যের মৌলিক অধিকার হরণ না করে জীবনযাপন করা। ট্রেনে ভ্রমণকারী অন্য যাত্রীদের অসুবিধার কথা যখন উঠল, তখন অবধারিত ভাবে এসে যায় পশ্চিমবঙ্গের লোকাল ট্রেনের প্রসঙ্গটি। অনেকেই হয়তো জানেন না, এই সব ট্রেনের নিত্যযাত্রী যাঁরা, তাঁরা অন্য কোনও অপরিচিত যাত্রীর সুবিধা বা স্বাচ্ছন্দ্যের পরোয়াই করেন না। সিট খালি থাকতেও তাতে ব্যাগ, জলের বোতল, তাসের পাতা রেখে অন্য অপরিচিত যাত্রীকে বসতে দেন না। বনগাঁ, হাবড়া লোকালের কম্পার্টমেন্টে চলে অবাধ ধূমপান। বারাসত স্টেশন এলে অপরিচিত যাত্রীদের উঠে দাঁড়িয়ে নিত্যযাত্রীদের জায়গা ছেড়ে দিতে হয়; তা না হলে বাক্যবাণে আহত করে তাঁদের তুলে দেওয়া হয়। অফিস-ফেরতা কৃষ্ণনগর কি বনগাঁগামী ট্রেনে দমদম স্টেশন থেকে ওঠা যায় না। দুপুরের দিকের খালি ট্রেনেও যে সমস্যা নেই; তা নয়। হয়তো আপনি একটি আসনে বসেছেন, সামনের সিটে এসে বসল ধোপদুরস্ত পোশাক পরা একটি ছেলে। বসেই সে তার শ্রীচরণ দু’টি সটান তুলে দিল আপনার আসনে। আরও আছে। প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রিজ দিয়ে ভারী লাগেজ নিয়ে উঠছেন, নিয়মমাফিক বাঁ দিক ঘেঁষে। হঠাৎ আবিষ্কার করলেন সেই বাঁ দিক জুড়ে দাঁড়িয়ে গল্পে মত্ত কয়েক জন।
আসল কথা, গড়পড়তা আমরা সবাই ‘লিটারেট’ হয়েছি বটে, কিন্তু ‘এডুকেটেড’ হতে পারিনি। আমরা সভ্যতায় সাজিয়েছি আমাদের বহিরঙ্গ, কিন্তু প্রকৃত ‘মানুষ’ হয়ে উঠিনি এখনও। আস্তে আস্তে হয়ে উঠছি স্বার্থপর; লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে পরার্থচিন্তা। প্রবন্ধকারের মতো সবার মনের মধ্যে কিন্তু ওই ‘সাতেপাঁচে না জড়ানো বুদ্ধিমান লোকটি’ বসবাস করেন না।
অনাদিরঞ্জন বিশ্বাস, শ্রীবিজয়পুরম, দক্ষিণ আন্দামান
প্রশ্নহীন
গত প্রায় দু’মাস ধরে প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ ২০২৫ নিয়ে যে বিপুল ঢক্কানিনাদ হয়ে চলল, তাতে মনে হল এই উপমহাদেশে একটি মাত্র কাজ অবশিষ্ট রয়েছে। তা হল— মহাকুম্ভের ‘পবিত্র স্নান’। পুণ্যলোভাতুর প্রায় অর্ধেক ভারতবাসী এই স্নানে শামিল হয়েছিলেন। সরকার থেকে ব্লগার, মিডিয়ার সমস্ত বিভাগ থেকে সমাজমাধ্যম, এমনকি ব্যক্তিগত মুঠোফোনেও এসএমএস পাঠিয়ে একতার মহাকুম্ভে পুণ্যস্নানের আহ্বান জানানো হয়েছে।
অথচ, এমন তৎপরতা তো অশিক্ষা কিংবা দারিদ্র দূরীকরণ কিংবা বিজ্ঞানমনস্কতা প্রচারের জন্য দেখা যায় না? মানুষকে অলীক পুণ্যলাভের পিছনে দৌড় করানোর জন্য রাষ্ট্রের যে অতন্দ্র উদ্যোগ, প্রশাসনিক তৎপরতা, পরিশ্রম, বিজ্ঞাপন-সহ বিবিধ খরচের বহর লক্ষ করা গেল, তার কণামাত্রও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য দেখা যায় না। আসলে, প্রশ্নহীন আনুগত্য এক প্রকার গড্ডলিকা প্রবাহের জন্ম দেয়। সবাই কুম্ভে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণে পুণ্য সঞ্চয় করে আনছে, আমার হল না। আর রাষ্ট্রের তরফে লাগাতার প্রচার চালানো হচ্ছে, ১৪৪ বছরে এই এক বার। এ বার না হলে আর এ জীবনে হবে না।
কিন্তু আসল তর্কটা হল ভারতের মানুষের জীবন সম্বন্ধে, মানুষের ভাববাদী সংস্কৃতির প্রতি আশ্লেষের সম্বন্ধে, বিজ্ঞানবিমুখতার প্রতি রাষ্ট্রের সজাগ ও সক্রিয় ইন্ধন জোগানোতে। অবাক লাগে চার্বাকের পদধূলি ধন্য এই ভারতের মানুষ কেমন অদ্ভুত ভাবে প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছেন। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জনজীবনের সকল ক্ষেত্রই আজ প্রশ্নের দ্বারা আকীর্ণ হওয়া উচিত। মানুষ তথা সমাজ আরম্ভ করবে বিচার, বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান। এরই ফলে ঘটবে আমাদের আদর্শের দ্রুত রূপান্তর। সমাজ ও রাষ্ট্রকে মুক্তবুদ্ধি মানুষই তাঁর দ্বান্দ্বিকতার কষ্টিপাথরের সত্যতায় যাচাই করে নতুন ভাবে গড়বে। অন্যথায় রাজনৈতিক আবর্তের ঘোলাজলে তৈরি ‘বিষকুম্ভ’-এ আপতিত হবে।
বিশ্বদীপ ভট্টাচার্য, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)