দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ ‘হিন্দি-ত্ব এবং হিন্দুত্ব’ (২৭-২) প্রসঙ্গে কিছু কথা। ভোটের দামামা বাজলেই বিভাজনের রাজনীতি, হিন্দুত্ব এবং হিন্দি-ত্ব নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু হয়, তা ঠিক নয়। সারা বছর ধরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এ কাজ চলছে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি যখন বলেন তিনি শুধুমাত্র হিন্দুদের বিধায়ক, তখন তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা হয় না। ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এ ধরনের উক্তি অত্যন্ত বেদনার, অত্যন্ত লজ্জার! সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য এখন ভোটের দিকে। কিন্তু অনেক আগেই বিভিন্ন বক্তব্যে ফুটে উঠছে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বাণী। কোনও নেতা বা নেত্রী তাঁর হিন্দুত্ব, ব্রাহ্মণত্বের পরিচয় দিয়ে হিন্দুদের প্রতি তাঁর সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি প্রকাশ করছেন। আবার কেউ বলছেন এ দেশ হিন্দুর। বাকি ধর্মের লোকেদের তাঁদের অধীনতা, বশ্যতা স্বীকার করে থাকতে হবে নতুবা দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। গ্ৰামবাংলায় পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে বাস করছেন। কিন্তু রাজনীতি ঢুকে পড়লেই লেগে যাচ্ছে দাঙ্গা। তাই বলা যায়, দেশে রাজনীতিই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের কারণ।
বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি ইত্যাদি যে কোনও ভাষা শেখার জায়গা বিদ্যালয়। রাজ্যে প্রতিনিয়ত বাংলা মাধ্যম স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অথবা বন্ধের পথে। ভাল চাকরি পেতে হলে ভাল হিন্দি জানতে হবে— এই কথাটি বিভিন্ন ভাবে প্রচার করা হচ্ছে যাতে হিন্দি মাধ্যমে পড়ার চাহিদা বাড়ে। আবার ভাষাকে অক্সিজেন জোগানোর অন্যতম জায়গা গ্ৰন্থাগারগুলিও গ্ৰন্থাগারিকের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে। ফলে পুরনো পাঠক বিরক্ত, নতুন পাঠকও সৃষ্টি হচ্ছে না। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। এখন অর্থ যার শিক্ষা তার। তলে তলে কত সরস্বতী বিদ্যামন্দির খোলা হচ্ছে, সেখানে হিন্দি, ইংরেজিই মুখ্য ভাষা। সেই বিদ্যালয়গুলিতে ছোট থেকে ছাত্রছাত্রীদের মনে হিন্দু ধর্মের প্রতি গোঁড়া মনোভাব ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র বিপুল ভাবে ভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তা সম্ভব হবে বাংলা মাধ্যম স্কুল ও গ্ৰন্থাগারের উন্নয়নের মাধ্যমে।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
যত্নের প্রয়োজন
দেবাশিস ভট্টাচার্য ‘হিন্দি-ত্ব এবং হিন্দুত্ব’ প্রবন্ধে বাংলা ভাষার অবক্ষয় এবং তার সম্ভাব্য কারণগুলি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তবে আরও কিছু কারণ সংযোজন করা দরকার। ভাষার মর্যাদা বাঁচাতে সম্প্রতি কলকাতা পুরসভা পথে নেমেছে। ভাল উদ্যোগ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-সহ বিভিন্ন সাহিত্যকর্মী বহু দিন আগেই বাংলা ভাষা বাঁচাতে এমন আন্দোলন করে গিয়েছেন। অনেক মানুষ আজও করে চলেছেন।
তবে আগাগোড়া ধর্মীয় মেরুকরণ এবং রাজনৈতিক সুবিধার নিরিখে বাংলা ভাষার অবনমনকে বোঝার পাশাপাশি বিষয়টি একটু অন্য ভাবেও ভাবা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালে কিন্তু ভাষার ভিত্তিতে দেশ ভাগ করা হয়নি। ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। তার মূলে ছিল বিরাট রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। লক্ষণীয়, মাত্র এক বছর পরেই ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ঠিক চার বছর পরে ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ হয়েছিলেন ছাত্ররা। ধর্ম আর রাজনীতিই যদি ভাষার মূল পরিচালক হবে, তা হলে শুধুমাত্র ভাষাকে কেন্দ্র করে কী ভাবে অগণিত বাঙালি সে দিন জোট বাঁধতে পেরেছিলেন? আজ সেই জোর বাঙালির মধ্যে আর নেই কেন? এর যথাযথ কারণটি ঠিক কী?
প্রবন্ধে বলা হয়েছে, রাজ্যের বর্তমান শাসক এবং বিরোধীদের ধর্মীয় মেরুকরণের খেলায় বাংলা ভাষা মার খাচ্ছে, সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। এ কথা ঠিক। তবে একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে ১৯৫২-র সেই ভাষার সঙ্গে একাত্মতার ধারা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হল না কেন? এর দায় কার? উত্তর অন্বেষণে বিশদে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে অর্থকরী ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা কি ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে? আর নতুন প্রজন্মের মাঝে কি সেই কারণে বাংলা তার গুরুত্ব হারাচ্ছে? খেয়াল করলে দেখা যাবে, শিক্ষিত প্রজন্মের মধ্যে বাংলার চর্চা যেটুকু আছে তা কেবল সিলেবাস-কেন্দ্রিক। আবার কিছু মানুষের মধ্যে যেটুকু শুদ্ধ বাংলার চর্চা হয়, তা বড় একমুখী। তাঁরা শুধু লিখতে থাকেন, অন্যেরটা পড়েন না। কাজ চলে গেলেই হল, এই বোধ বাঙালির শিরায় শিরায় প্রবেশ করেছে। এর পরে আছে পরিভাষার অভাব। এক সময় নিখিল সরকার যথার্থ লিখেছিলেন, উপযুক্ত পরিভাষার অভাবে যেন তেন প্রকারেণ কাজ চালাবার নেশা মানুষকে পেয়ে বসেছে। মোট কথা বাংলা ভাষার জন্য যে যত্ন প্রয়োজন তা বিশিষ্ট বাঙালির মধ্যেও লক্ষ করা যাচ্ছে না। ফলে আমজনতার কাছে ঠিক বার্তাটিও পৌঁছচ্ছে না।
সবার আগে দরকার ভাষার যত্ন। এবং সেটা করতে হবে শুরু থেকেই। কলকাতা পুরসভার নির্দেশ মেনে সাইনবোর্ডে বাংলা লিখলেই কি সমস্যা মিটে যাবে? সাইনবোর্ড কিংবা লাখো গাড়িতে ভুল বানানের ছড়াছড়ি। সেগুলি কি অভিযান চালিয়ে ঠিক করা আদৌ সম্ভব? গাছের গোড়া কেটে আগায় জল ঢাললে গাছ তো বাঁচবে না। সরকারি নোটিসেও বানান ভুল চোখে পড়ে। এগুলি কিন্তু আমজনতাকে প্রভাবিত করে। ফলে শৈশব থেকেই শুরু হয়ে যায় ভাষার প্রতি অযত্ন। শিক্ষকতার সূত্রে বহু ছাত্রকেই বলতে শুনেছি, ইংরেজি মাধ্যমের একাধিক স্কুলে ‘ভুল করে’ বাংলা বলে ফেললে আর্থিক জরিমানা দিতে হয়। অথচ সে তো বাঙালিরই সন্তান!
আমাদের বাঙালি পরিচয় হয়েছে ভাষার নিরিখে। সেটাই আমরা দ্রুত ভুলে যাচ্ছি। রাজনীতির কারবারিরা সঙ্কীর্ণ স্বার্থে ভোলানোর কাজটিকে ত্বরান্বিত করছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে সর্বস্তরের বাঙালি সেই ফাঁদে পা দিচ্ছেন।
প্রয়াত গায়ক প্রতুলবাবু যখন উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করতেন— “দুইজনা বাঙালি ছিলাম/ দেখো দেখি কান্ডখান!/ তুমি হইলে বাংলাদেশি,/ আমারে কও ইন্ডিয়ান!” এ এক বিরাট বিস্ময় হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন হল, নতুন প্রজন্ম এই বিস্ময়ের, এই আবেগের মূল্য বুঝবে?
দীপায়ন প্রামাণিক, গড়পাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
প্রতিবাদ কোথায়
দেবাশিস ভট্টাচার্যের উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ‘হিন্দি-ত্ব এবং হিন্দুত্ব’ প্রসঙ্গে এই চিঠির অবতারণা। কিছু দিন আগে কলকাতা মেট্রো স্টেশনে হিন্দি না বলতে পারার কারণে এক বাঙালি ভদ্রমহিলাকে এক হিন্দিভাষী মহিলার কাছে ভর্ৎসনা শুনতে হল। তার একটাও প্রতিবাদ শোনা গেল না। বাঙালি হয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলা কি অপরাধ? ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকঢোল পিটিয়ে বাংলাভাষা দিবস পালন করছি, আর বছরভর সেই বাংলা ভাষায় কথা ভুলে গিয়ে দিব্যি আছি আমরা।
পরধর্মে আপত্তি বা ভাষা, খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বাঙালি অনেকটাই উদারমনস্ক। কিন্তু কোনও কারণে বাংলাকে যদি পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে তবে প্রতিবাদে সরব হওয়া বাঙালির সঙ্গত অধিকার। বাংলায় হিন্দুয়ানা ও হিন্দিয়ানা দুটোই সমান ক্রিয়াশীল। আগামী বিধানসভার নির্বাচন ঘিরে প্রতিযোগিতামূলক মেরুকরণের রাজনীতি শুরু হয়ে গিয়েছে। দুই শিবিরের এই চরম মেরুকরণের রাজনীতি চলতে থাকবে ভোটের দিন পর্যন্ত।
এত দুর্নীতি ও বেহাল রাজ্যশাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভকে যদি বিরোধীরা ঠিক পথে চালনা করতে না পারেন তবে তাঁদের ব্যর্থতাও অনেক গভীরে। ৩৪ বছর শাসনের আসনে থাকায় সব রকম বিরোধিতার সুর তাঁরা ভুলে গিয়েছেন। আর জি কর থেকে শিক্ষা, খাদ্য, নিয়োগ-দুর্নীতি, ভাষার অবমাননা— যে কোনও বিষয় নিয়ে লড়তে তাঁরা ব্যর্থ। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাও কি তাঁরা হারিয়ে ফেলার পথে? বিরোধী স্বর না উঠলে অপশাসন, অন্য সংস্কৃতির আগ্রাসনও চলতে থাকবে।
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)