আঠারো বছর বয়সি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু ডি গুকেশের মনের জোর ধরে রাখতে অগ্রজ অভিজ্ঞ বিশ্বনাথন আনন্দের পরামর্শ, সমালোচনায় কান দেওয়ার দরকার নেই। গুকেশের এই মনের জোর দেখে বলতে ইচ্ছা করে, “আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার/ পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,/ দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার/ ক্ষত বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।” (সুকান্ত ভট্টাচার্য)। ‘ক্ষত বিক্ষত’ হওয়ার মতো কিছু অপ্রিয় পরিবেশ তৈরিও হয়েছে। পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন তো বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপকে সার্কাসের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, আর কখনও ক্যান্ডিডেটস দাবায় যোগ দেবেন না। দোষে-গুণে মানুষ এই সমালোচকেরা। নেতিবাচক উস্কানিমূলক প্রতিক্রিয়া দিলেও গুকেশ পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিলেন না। ফলে সমালোচকদের দিকেই ফিরে গেল তাঁদের সমালোচনা।
ভাগ্যিস গুকেশ জিতলেন। ক্রিকেট, ফুটবল তো প্রধানত বিদেশের খেলা। তার জনপ্রিয়তা ও প্রচারের চাপে ভারতের প্রাচীন দাবা খেলা প্রচার পায় কতটা? সেই খেলাতেই গুকেশের জয়ে ভারতের জয়ধ্বনি শোনা গেল। মনে পড়ে ১৯৭২ সালের ‘ম্যাচ অব দ্য সেঞ্চুরি’, ববি ফিশার ও বরিস স্প্যাসকির দ্বৈরথ, তা আমেরিকা-রাশিয়া দ্বৈরথ হয়ে উঠেছিল। সংবাদপত্রে প্রতিটি খেলার চাল দেওয়া হত। ফিশারের দেওয়া চাল দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল, অনেক কিছু বুঝতেই পারিনি। গুকেশ আর ডিং লিরেনের খেলার চালের পরিচয় সে ভাবে প্রকাশ্যেই এল না। ভারতে অনেক উদীয়মান, প্রতিভাবান দাবাড়ু আছেন। এই চালগুলো আলোচনা হওয়া দরকার। পাড়ায় রোয়াকে এখনও বয়স্করা দাবা খেলেন। তবে অধিকাংশই খেলেন ভারতীয় নিয়মে। সত্তরের দশকে আমাদের বাড়িতেই পাঁচ ভাইদের মধ্যে দাবা খেলা নিয়ে খুনসুটি, তোলপাড় এখন সুখস্মৃতি হয়ে মনের মাঝে রয়ে গিয়েছে।
আজকাল খেলোয়াড়রা প্রায় একাই আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে কম্পিউটারের সঙ্গে অনুশীলন করেন। আনন্দের উপদেশ এঁদের সকলের পাথেয় হওয়া উচিত: বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবে কিন্তু কোনও সমালোচনা হবে না, এটা আশা করা যায় না। খ্যাতির শীর্ষে উঠলে প্রতি মুহূর্তে একা, নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। কেউ হয়তো টেনে ফেলেও দেয়। গুকেশ আগামী দিনে নিশ্চয়ই আরও শেখাবেন, কী ভাবে এই নিঃসঙ্গতা ও সমালোচনা জয় করা যায়।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
নায়ক-বরণ
তিনি গুকেশ দোম্মারাজু। জন্ম তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ে, ২০০৬-এর ২৯ মে। বাবা রজনীকান্ত ইএনটি বিভাগের শল্যচিকিৎসক এবং মা পদ্মা এক জন অণুজীববিজ্ঞানী, মাইক্রোবায়োলজিতে ডক্টরেট। খেলার দুনিয়ায় এই তরুণ ডি গুকেশ নামে পরিচিত। এখন তাঁর বয়স মাত্র আঠারো বছর!
চিনের ডিং লিরেন-কে হারিয়ে তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেন গত ১২ ডিসেম্বর। ২০২৪-এর এই ১২ ডিসেম্বর ভারতের ইতিহাসে তথা ভারতের দাবাজগতে, ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে সোনালি দিন হয়ে থাকল! গুকেশ সর্বকনিষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেন। এর আগে ১৯৮৫ সালে মাত্র বাইশ বছর বয়সে গ্যারি কাসপারভ স্বদেশি আনাতোলি কারপভকে হারিয়ে সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন। এত দিন সেটাই ছিল বিশ্বরেকর্ড, গুকেশ নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়লেন। দাবার এক সময়ের বিস্ময়বালক আজ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। দাবার জগতে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছলেন তিনি।
তাঁর এই কৃতিত্ব ভারতীয় দাবার জগতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করল। ডি গুকেশের আগে ভারতের হয়ে দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন বিশ্বনাথন আনন্দ। সে-ও আবার সব মিলিয়ে পাঁচ-পাঁচ বার! এই আনন্দই ২০১৩ সালে কার্লসেনের কাছে হেরে যান। সে দিন সাত বছরের গুকেশ উপস্থিত ছিলেন গ্যালারিতে। সেই বালকবয়সেই তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এক দিন তিনিও ওই বিশ্ব দাবার আসরে থাকবেন। এবং গ্যালারিতে নয়, বোর্ডে বসবেন প্রতিযোগী হয়ে। আর চ্যাম্পিয়নও হবেন! তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখতে পেরেছেন। তাই লিরেনকে হারানোর পর তিনি আর আবেগের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। ভিতরের উচ্ছ্বাসকে প্রকাশ করেছেন, আবেগে চোখের জলও ফেলেছেন। এক দশক ধরে বুনে যাওয়া স্বপ্ন সফল করতে পেরেছেন যে!
গুকেশের হাত ধরেই এ বছর ভারত তিনটি বিশ্ব খেতাব জিতেছে। প্রথমে ক্যান্ডিডেটস দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, পরে বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে সোনা পেয়েছেন এবং সব শেষে এল এই বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব! ভারত চতুর্থ বিশ্ব খেতাব জিতেছে মেয়েদের হাত ধরে। দাবা অলিম্পিয়াডে ভারত এ বার মহিলা বিভাগেও সোনা জিতেছে। ২০২৪ সালটি দাবার ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষে খুবই উল্লেখযোগ্য, আনন্দময়।
গুকেশের এই অভাবনীয় সাফল্যের পিছনে রয়েছে তাঁর অদম্য ইচ্ছা, কঠিন পরিশ্রম, আন্তরিক উদ্যোগ এবং জেদ। তাঁর এই গুণাবলি বিশেষ ভাবে প্রশংসনীয় এবং নব্য প্রজন্মের তাঁকে আদর্শ রূপে মেনেই পথ চলা উচিত। একই সঙ্গে তাঁর বাবা মায়ের অসীম ধৈর্য ও সহযোগিতাও তাঁকে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করেছে।
তবে, গুকেশকে শুধু শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনবার্তা পাঠালেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। দেশে ফিরলে তাঁকে অবশ্যই সরকারি সংবর্ধনা দেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণ আর্থিক পুরস্কারও। তাঁকে এমন ভাবে উৎসাহ দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে তিনি আরও অনেক বিশ্ব খেতাব অর্জন করতে পারেন। এবং তাঁকে দেখে আরও অনেকে দাবা খেলায় অনুপ্রাণিত হয়।
আরও একটি সুখবর রয়েছে। দাবায় ভারতের জুনিয়র দলটিও কিন্তু প্রস্তুত। এঁরা যথেষ্ট শক্তিশালী। প্রজ্ঞানন্দ তো বেশ কয়েক বার কার্লসেনকে পর্যন্ত হারিয়েছেন। অর্জুন এরিগাইসির রেটিং পয়েন্ট ২৮০০-র বেশি, আনন্দের পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে এই কৃতিত্বের অধিকারী। এঁরা বিশ্ব দাবায় প্রথম কুড়ি জনের মধ্যে আছেন। আমরা আশা করতেই পারি যে এঁরা ভবিষ্যতে দেশকে অনেক গৌরব ও পদক এনে দেবেন। এঁরাও ভবিষ্যতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলে দেশ উৎফুল্ল হবে। তবে ভারতীয় দাবার সেরা মুহূর্ত হবে সেই দিন, যে দিন দুই ভারতীয় দাবাড়ু দাবার টেবিলে মুখোমুখি বসবেন আর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য লড়াই করবেন। আমরা সেই শুভ দিনের অপেক্ষায় থাকলাম।
পঙ্কজ সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
গুরুর পথে
মাত্র আঠারো বছর বয়সেই দাবার মতো কঠিন প্রতিযোগিতায় ভারতের ডি গুকেশ বিশ্বজয় করলেন। দাবা বা চতুরঙ্গ প্রাচীন ভারতীয় খেলা। কিন্তু আধুনিক যুগে ভারতে দাবাকে জনপ্রিয় করেছেন মূলত বিশ্বনাথন আনন্দ। তিনি দাবা-বিশ্বে ‘ভিশি’ নামে পরিচিত। বিশ্বনাথন আনন্দ দেশের প্রথম ও একমাত্র খেলোয়াড় যিনি পাঁচ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। তবে গুকেশের মতো এত কম বয়সে কেউ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি।
দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য চালু নিয়মটি হল, ক্যান্ডিডেটস দাবার সেরা খেলোয়াড়কে লড়তে হবে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের সঙ্গে। সেই কঠিন প্রতিযোগিতায় সব খেলোয়াড়কে হারিয়ে ভারতের ডি গুকেশ চিনের ডিং লিরেনের প্রতিযোগী হন। তখন থেকেই ভারতবাসীরা স্বপ্ন দেখছিলেন, ডি গুকেশ চিনের এই তারকাকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবেন। শেষ পর্যন্ত তা সত্যি হল। ডি গুকেশ কোটি কোটি ভারতবাসীর স্বপ্ন সফল করলেন। এই ভাবেই দেশের মুখ উজ্জ্বল করার চেষ্টা করবেন আগামী দিনের ভারতীয় খেলোয়াড়রাও, এই আশা বেঁচে থাকুক।
ডি গুকেশ বিশ্বনাথন আনন্দের ছাত্র। আনন্দের শিক্ষা, তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা সার্থক হয়েছে। গোটা ভারত প্রার্থনা করছে, গুরু-শিষ্যের এই পরম্পরা যেন বজায় থাকে এবং ভারতে যেন আরও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তৈরি হয়।
অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy