Advertisement
০৪ ডিসেম্বর ২০২৪
Protest

সম্পাদক সমীপেষু: প্রতিবাদ কোথায়

মানুষ অভ্যাসের দাস। যখন পলিথিনের প্যাকেট আবিষ্কৃত হয়নি, তখন নির্দ্বিধায় দোকান-বাজারে সেই আদি-অকৃত্রিম থলে বস্তুটি সহচর ছিল। তার পর পলিথিনের ব্যাগে বেচাকেনা একটা অভ্যাসে পরিণত হল।

protest

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪ ০৫:২০
Share: Save:

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ “‘না’ বলতে পারার শক্তি’ (৩০-৬) আমাদের ভিতরকার আমি-র ভিতটাকে একটু হলেও নাড়িয়ে দিয়েছে। যখন চার পাশের অবক্ষয়, আঁধার ঘনিয়ে আসা পরিস্থিতিতে মানুষ তার অস্তিত্ব বিকোয় লোভ, লালসা মিশ্রিত আবহে, তখনও তার হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় না বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ বা একটিমাত্র শব্দ ‘না’। অথচ, বিপুল শক্তির অধিকারী এই ‘না’ উচ্চারণের জন্য শুধু প্রয়োজন একটু সাহস।

মানুষ অভ্যাসের দাস। যখন পলিথিনের প্যাকেট আবিষ্কৃত হয়নি, তখন নির্দ্বিধায় দোকান-বাজারে সেই আদি-অকৃত্রিম থলে বস্তুটি সহচর ছিল। তার পর পলিথিনের ব্যাগে বেচাকেনা একটা অভ্যাসে পরিণত হল। বৃথাই পলিথিনের বিপদ সম্পর্কিত হাজারও আলোচনা। উন্নত দেশগুলো ব্যতিক্রমী ঠিকই, কিন্তু কলকাতারও কিছু অঞ্চলে পলিথিন বর্জন করা হয়েছে। বাসিন্দারা মুদিখানার দ্রব্য বা চপ, শিঙাড়া, মিষ্টির বাক্স নিয়ে যাচ্ছেন কাগজের ঠোঙায় বা সঙ্গে আনা থলেতে। সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার সহমতের মিশেলে দ্বৈত ‘না’ শব্দটির প্রয়োগ সার্থক হয়েছে। ইতিপূর্বে স্থানীয় প্রশাসনের তরফে আলোচনা করেই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গিয়েছে। তার পর সেটি অলিখিত আইনে রূপায়িত হয়েছে।

দৈনন্দিন জীবনে আলো, জল, পাখা, বিদ্যুৎ ব্যবহারে অপচয় সম্পর্কে ভাবিত নই আমরা। রাস্তার ধারে পুরসভার কল থেকে অবিরাম জল ঝরে পড়ে। নতুন ট্যাপ কলটি উধাও হয়ে যায় অচিরেই। এমনই লোভ এক শ্রেণির অসাধু মানুষের যে, সৌন্দর্যায়নের কারণে মহানগরীতে পথ-বিভাজিকার লোহার রেলিং রাতের অন্ধকারে চুরি হয়ে যায়। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর উত্থিত হয় কি?

প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জলাজমিগুলি মাফিয়া চক্রের দৌলতে এবং স্থানীয় নেতাদের যোগসাজশে বিকিয়ে যায় অট্টালিকা নির্মাণে। গৃহস্থের বাড়ির সামনের পুকুরটি হতে যে একটু আধটু সুবাতাস শরীর জুড়োত, তা-ও চুরি হয়ে যায়। ‘না’ বলা যাবে না। যদি স্থানীয় ক্লাব ওই নির্মীয়মাণ বহুতলে একটি ছোট্ট ক্লাবঘর পায় মুফতে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধে কী হবে?

অভিনব উদাহরণ দিয়েছেন প্রবন্ধকার— টুকলি করা মেয়েটি অবলীলায় সৎ ভাবে পরীক্ষা দেওয়া মেয়েটির জিজ্ঞাসায় বলে “তুমিও টুকে লেখো না।” টুকলি কোরো না— এই ‘না’টুকু বলার প্রয়োজন অনুভূত হয় না। তাই কাজের বরাত পেতে গেলেও টেবিলের নীচ দিয়ে লেনদেন হয়। অথচ, ‘না’ বলতে পারাটা কোনও ঐশ্বরিক শক্তি নয়। একক ভাবে প্রতিবাদ না করতে পারলে সমবেত ‘না’র জন্য যেন আমাদের বোধ জাগ্রত হয়। ছোটবেলায় পড়া ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে’, তারা দু’জনই অপরাধী— সেই শিক্ষা বড়বেলাতেও জরুরি যে!

ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫

সাহস নেই

‘না’ আমরা প্রায় সকলেই বলতে চাই। আমাদের বিবেক যে কোনও অন্যায় দেখলে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ আমাদের প্রতিবাদের পথ থেকে দূরে সরে থাকতে বাধ্য করে। ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া অন্যায় কি না— এই প্রশ্ন একশো জনকে জিজ্ঞেস করলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন এটা ঘোরতর অন্যায়। অথচ, টাকা দিয়ে চাকরি নেব না— এই কথাটাও আমরা বলতে পারছি না। অনেকেই এ সুযোগ নিচ্ছেন বলেই এই অন্যায় মাথাচাড়া দিয়েছে।

বড্ড স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি আমরা! তাই তো পাশের বাড়ির নাবালিকা মেয়েটির তীব্র আপত্তিতে কর্ণপাত না করে তার বাবা-মা যখন তার বিয়ে দেন, তখন প্রতিবাদ করতে পারি না। বরং বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে গৃহস্থের প্রশংসা করতে করতে চলে আসি। চোখে পড়ে না মেয়েটির চোখের জলের সঙ্গে তার চুরমার হয়ে যাওয়া ভবিষ্যতের স্বপ্ন! সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে নাবালিকা মায়ের মৃত্যুর খবরে আমরা ‘গভীর দুঃখপ্রকাশ’ করি, কিন্তু নাবালিকার বিয়ে নিয়ে প্রতিবাদ করি না। সংবাদমাধ্যম, সমাজমাধ্যমে নিয়মিত দেখা যায় উপযুক্ত ভিত না থাকার কারণে বাড়ি ভেঙে পড়ার খবর, বাড়ি ভেঙে ফেলার নির্দেশ। অথচ, কোনও সরেজমিন তদন্ত না করে যাঁরা দোতলা, তিনতলা ভিতের বাড়িকে পাঁচতলা, ছ’তলার অনুমোদন দিচ্ছেন, তাঁদের কঠোর শাস্তি হয় না কেন? যাঁরা এমন বাড়ি বানাচ্ছেন, তাঁদেরও কি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়? মাঝখান থেকে মারা পড়ছেন কিছু সাধারণ মানুষ, যাঁরা সেই ফ্ল্যাট কিনেছেন। আজকের দিনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, উচ্চশিক্ষার জন্য এন্ট্রান্স পরীক্ষা— সর্বত্র দুর্নীতি। অনৈতিক সুযোগ পেলে নেব না— এই কথা বলার সাহস আমরা প্রতি দিন হারিয়ে ফেলছি। এর কারণ, আমাদের আত্মবিশ্বাস নেই। মেরুদণ্ড সোজা নেই। তাকে সোজা করার চেষ্টা বা ইচ্ছাও মরে গেছে। লোভ, দারিদ্র, স্বার্থপরতা, রাজনৈতিক চাপ ও ক্ষমতার আস্ফালন, বেকারত্ব, কোনও প্রকার ঝামেলায় না জড়ানোর ইচ্ছা ইত্যাদি আমাদের মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে। এই রকম চলতে থাকলে এক দিন গোটা সমাজ, রাজ্য, দেশ দুর্নীতির আখড়া হয়ে যাবে। আর সাধারণ মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন না। তাই মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতিবাদ করতে হবে।

গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

অন্য প্রলোভন

“‘না’ বলতে পারার শক্তি” প্রবন্ধটি সময়োপযোগী। ‘না’ বলতে পারার প্রয়োজনীয়তা বা ‘না’ বলতে না-পারার কারণগুলো বিস্তারিত ভাবে সেখানে আলোচিত হয়েছে। এ কথা ঠিক যে, প্রয়োজনে ‘না’ বলতে পারার কাজটা সব ক্ষেত্রে সহজ নয়। কিন্তু সহজ ক্ষেত্রেও মানুষের ‘না’ নেই ছেলেমানুষি-স্বার্থভাবনার কারণে।

প্রবন্ধকার বলেছেন— প্রতিটা অন্যায় একটা প্রলোভনের রূপ ধরে আসে যার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, মনে মনে যুক্তি সাজায়— কেন এই প্রস্তাব আসলে ততটা অন্যায় নয়। কোনও অন্যায়কে মেনে নিতে গেলে নিজেকে অর্থাৎ মন ও অন্তরকে কোনও না কোনও ভাবে আশ্বস্ত করতেই হয়, নইলে তো অপরাধবোধের যন্ত্রণায় ভুগতে হবে। তার জন্য কুযুক্তি-সহ উদাহরণ পেশ করতে হয় হৃদয়-মনের কাছে। ফলে প্রতিনিয়ত এই কুযুক্তির চর্চায় মানুষের সামগ্রিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার পতন ঘটে, যা পুনরুদ্ধার করা মুশকিল।

ট্যাক্সিচালক প্রসঙ্গে প্রবন্ধকারের বক্তব্য— যে মনের জোরে অচেনা ট্যাক্সিচালক ঠিকানা খুঁজে ফিরিয়ে দিয়ে যান টাকা-গয়না ভর্তি ব্যাগ, সেই সামগ্রিক মূল্যবোধের জোর থেকেই আমাদেরও বলতে হবে ‘না’। হয়তো ট্যাক্সিচালকের উদাহরণটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। কিংবা হয়তো টাকা-গয়না ভর্তি সম্পন্ন ব্যাগ-মালিকের বিপদগ্রস্ততার চেয়ে নিজেকে সৎমানুষ হিসাবে জাহির করা— এ-ও এক অন্য রকমের প্রলোভন। তবু এমন প্রলোভনকে তো প্রশ্রয় দিতেই হবে।

আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের গল্প বলি। তাঁদের অফিসে ঘুষের চল নেই। তবু এক কাস্টমার সেই অফিসের বড়বাবুকে একশো টাকা ঘুষ দিতে চাওয়াতে বড়বাবু চিৎকার করে সেই কাস্টমারকে পুরো পেড়ে ফেলেন। যদিও বড়বাবু তাঁর পূর্বতন অফিসে নিয়মিত ঘুষ খেতেন বলে অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে যুক্তিটা হল, এক-আধ বার মাত্র একশো টাকা ঘুষ নিয়ে কোনও লাভ নেই। শুধু তা-ই নয়, যেখানে ঘুষের চল নেই সেখানে ঘুষ নেওয়া ঝুঁকিও বটে। তাই বড়বাবু অনায়াসে ‘না’ বলে এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে নিজের ইমেজ খানিকটা বাড়িয়ে নিয়েছেন।

অবশ্য এর একটা ইতিবাচক ফলও আছে। কাস্টমারের অন্যায় প্রশ্রয় পেল না। পরবর্তী কালে এমন অন্যায় করার আগে তাঁকে দু’বার ভাবতে হবে। দ্বিতীয়ত, ওই অফিসে ঘুষ চালু হওয়ার সম্ভাবনাটিও অনেকটা পিছিয়ে গেল। সুতরাং, বড়বাবুর এই নাটকীয় আচরণকেও একটু প্রশ্রয় দেওয়া যায়।

দুর্গেশ কুমার পান্ডা, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

অন্য বিষয়গুলি:

Protest Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy