Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

বাঙালি ও নোবেল

অমর্ত্য সেনের কোলে বসিয়ে বাচ্চাদের হাতেখড়ি দেওয়ার নাকি হিড়িক হয়েছিল, তাঁর নোবেল পাওয়ার পরে। এখন এক দল আবার, ‘একমাত্র বাঙালিই পারে, এত নোবেল জিততে’ জাতীয় কথাবার্তা শুরু করেছেন।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৭
Share: Save:

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল পেলেন দারিদ্র নিয়ে কাজ করে। অমর্ত্য সেনও কল্যাণমুখী অর্থনীতির কাজের জন্যই এই পুরস্কার পেয়েছিলেন ২১ বছর আগে। এক জন বাঙালি আবার নোবেল পেয়েছেন বলে আমরা বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছি স্বাভাবিক ভাবেই। অভিজিৎ সম্পর্কে গুগল করে নিয়েছি। খুঁটিয়ে কাগজ পড়ে জেনে নিয়েছি তাঁর ডাকনাম বা স্কুল কেটে সিনেমা দেখার গল্প।

অমর্ত্য সেনের কোলে বসিয়ে বাচ্চাদের হাতেখড়ি দেওয়ার নাকি হিড়িক হয়েছিল, তাঁর নোবেল পাওয়ার পরে। এখন এক দল আবার, ‘একমাত্র বাঙালিই পারে, এত নোবেল জিততে’ জাতীয় কথাবার্তা শুরু করেছেন। কিন্তু এই শেষ ২১ বছরে কতটা বদলেছে বাঙালির জীবন? হ্যাঁ, সামর্থ্যবান, আলোকপ্রাপ্ত, শিক্ষিত বাঙালির কথাই বলছি।

এই ২১ বছরে হয়তো তিনি তিন বার গাড়ি কিনেছেন। পাঁচতারা হোটেলে বিবাহবার্ষিকী পালন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করেছেন বার কয়েক। শেষতম ঢাউস এসি গাড়িতে বসিয়ে ছেলে বা মেয়েকে একা স্কুলে পাঠিয়ে, দূষণ বাড়িয়ে রাস্তা জ্যাম করেছেন। নিরীহ প্রবীণ রিকশাচালককে গলির মধ্যে তুইতোকারি করেছেন তাঁর মাইনে করা ড্রাইভার, বা হয়তো তিনি নিজেই। অর্থাৎ, মোদ্দা কথা হল— এই বাঙালি, সাধারণ সমাজজীবন থেকে নিজেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন ক্রমশ। নিজের পারফিউম-সুরভিত জামায় যেন এক বিন্দু দারিদ্র বা সাধারণত্বের ‘মলিনতা’ না লাগে— এটা তাঁর জীবনের অন্যতম, হয়তো প্রধান, সঙ্কল্প হয়ে উঠেছে। নিজের শ্রেণিচিহ্ন নিয়ে এতটাই তিনি সচেতন যে, জাঁক ও দেখনদারিই হয়ে উঠছে তাঁর রোজকার জীবনের সারসত্য।

অথচ কিছু দিন আগে পর্যন্তও সহজ, অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের প্রতি বাঙালির একটা সমীহ ছিল। বাবা-মায়েদের দৃঢ় ধারণা ছিল, বেশি ‘বড়লোক’ হয়ে যাওয়া খারাপ। ‘বড়লোকি’ দেখানো তো আরও খারাপ। সেই বাবা-মায়েরাও বদলে গিয়েছেন আজ। বাজার ও বিজ্ঞাপন ধীরে ধীরে বদলে দিয়েছে ‘বড়লোকি দেখানো’র কায়দা-কানুন। নতুন উচ্চ বা মধ্যবিত্ত বাঙালি এখন সত্যিই ভুলে যেতে চান দেশভাগের পর কলোনির দরমার ঘরে তাঁদের বাপ-ঠাকুর্দার জীবনযুদ্ধের ইতিহাস। তাঁদের কাছে এখন সমাজ-সংযোগের মানে হচ্ছে, বেড়াতে গিয়ে সানগ্লাস পরে গ্রামের গরিব বাচ্চাদের কাঁধে হাত রেখে ছবি তোলা।

অমর্ত্য সেন যখন ছুটিতে শান্তিনিকেতনে এসে সাইকেল চালালেন, মিডিয়া তাঁকে প্রশ্ন করল এই ভাব নিয়ে যে, আরে, আপনি নোবেল লরিয়েট, তাও সাইকেল চালাচ্ছেন! মিডিয়া এটা বিশ্লেষণ করল না— গাড়ি বা মোটরবাইক ছেড়ে সাইকেল বেছে নেওয়াটা আসলে জীবনবোধ ও ভাল লাগার প্রশ্ন। যার সঙ্গে জুড়ে আছে পরিবেশ ও সমাজবোধ।

না। শিক্ষিত বাঙালি সেটা ভাবতে পারলেন না। বস্তুত ভাবনাচিন্তা করার অভ্যেসকেই তিনি সরিয়ে রাখলেন এবং ক্রমশ একটা আদ্যোপান্ত সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আরও জড়িয়ে গেল সামর্থ্যবান বাঙালির সমাজ-সংসার। তা হলে এমআইটি-তে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট বাংলায় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বলেন, ‘‘গরিবের হাতে পয়সা আনতে হবে। বড়লোকের হাতে নয়’’, ড্রয়িংরুম-শোভিত বাঙালি সে-সব কথা আজ মন থেকে বিশ্বাস করেন তো ?

শতঞ্জীব গুপ্ত

কলকাতা-৮

মনে পড়ে যাবে

প্রিমো লেভি। আউশভিৎজ় কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফেরা অল্প কয়েক জন ইহুদি-বন্দিদের এক জন। ফিরে, ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি নাৎসি জার্মানির বর্বরতা সম্পর্কে বই লিখে গিয়েছেন, নানা সভা-সমিতিতে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর শেষ বই ‘দ্য ড্রাউন্ড অ্যান্ড দ্য সেভ্ড’-এ থার্ড রাইখ-এর উত্থানকাল সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেভি আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, হিটলার অনেক আগেই তাঁর আত্মজীবনীতে ইহুদি-বিদ্বেষের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন: ইহুদিরা মানবসভ্যতার পরজীবী, ঘৃণ্য পোকার মতো তাদের সরিয়ে দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে এই প্রচার তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, বিশেষ ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে; সেই জনপ্রিয়তা নাৎসি পার্টিকে তার বর্বর কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিয়ে যেতে অনেকাংশে সাহায্য করবে (যে কর্মকাণ্ডের শুরুতেই নির্যাতিতদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে)।

লেভি-র লেখা পড়তে পড়তে আমাদের মনে পড়ে যাবে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর করা সাম্প্রতিক উক্তি: অনুপ্রবেশকারীরা উইপোকার মতো। মনে পড়বে অসমের এনআরসি-র কথা, ডিটেনশন ক্যাম্পের কথা। মনে পড়বে, এক উগ্র-দক্ষিণপন্থী পার্টির নেতাদের মনগড়া তথ্য: পশ্চিমবঙ্গে দু’কোটি অনুপ্রবেশকারী আছে। আর মনে পড়ে যাবে, এই প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ ভারত সিটিজ়েনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিলের নাম করে ধর্মীয় বিভাজনকে আইনসিদ্ধ করতে চাইছে। আজকের জার্মানিতে নাৎসি পার্টির সমর্থনে কোনও রকম প্রকাশই দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু সেই আইন নিহত ছ’কোটি মানুষকে তাঁদের মর্যাদা, জীবন, ফিরিয়ে দিতে পারেনি।

অমিত বর্ধন

ইঞ্জিনিয়ারবাগান, চুঁচুড়া

বাংলায় কথা

‘‘বাংলায় বলা ‘বারণ’, বিতর্ক কফি হাউসে’’ (২৫-১০) পড়ে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। এখন কাজের সূত্রে উত্তরপ্রদেশে থাকি, মাঝে মাঝে কলকাতায় যাই। এ বার কলকাতায় গিয়ে, বাড়ির বিশেষ বাচ্চাটির আবদারে এক বিখ্যাত পিৎজ়ার দোকানে গিয়ে দেখি, সব কর্মী হিন্দিতে কথা বলছেন। দেখে তাঁদের বাঙালিই মনে হল। জিজ্ঞেস করলাম, তাঁরা বাংলা জানেন কি না। সবাই চুপ করে রইলেন। বুঝলাম, জানেন, কিন্তু বলবেন না। বললে হয়তো চাকরি থাকবে না। তা হলে কি এ বার নিজের ভূমিতে নিজের মাতৃভাষায় ব্যবসা-বাণিজ্য হবে না, নিজের ভাষায় কথা বলা যাবে না? এ কিসের ফল— অন্য ভাষার আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসন, না নিজের ভাষা সম্পর্কে হীনম্মন্যতা?

সুজয় কুমার ধাড়া

বরেলী, উত্তরপ্রদেশ

সহজে সংস্কৃত

বিশ্বজিৎ রায়ের ‘ধুতিচাদর আর ড্রইংরুম’ (২৭-১০) শীর্ষক নিবন্ধ পড়ে, অল্প সংযোজন করছি। সংস্কৃতে স্বল্প সময়ে দক্ষ হওয়ার জন্য সোজাসাপ্টা পাঠপদ্ধতি আবিষ্কার করে যে দু’টি বই ঈশ্বরচন্দ্র রচনা করেছিলেন, তা হল, ‘উপক্রমণিকা’ এবং ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’। এই দু’টি পাঠ্যপুস্তক রচনা কী ভাবে হল, বিনয় ঘোষ প্রণীত ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ’ গ্রন্থে তার বর্ণনা রয়েছে।

বিদ্যাসাগর যখন বৌবাজারে বসবাস করছেন, তখন তাঁর বাড়ির সামনেই থাকতেন রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিশোর রাজকৃষ্ণ বিখ্যাত ব্যবসায়ী হৃদয়রাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতি ছিলেন। রাজকৃষ্ণ প্রায়ই বিদ্যাসাগরের কাছে চলে আসতেন, তিনি ছাত্রদের যখন পড়াতেন সেখানে উপস্থিত থাকতেন। রাজকৃষ্ণ হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিলেন। ক্রমশ সংস্কৃত সাহিত্যে রাজকৃষ্ণের আগ্রহ জন্মায় এবং তিনি সংস্কৃত শিক্ষার আগ্রহ ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে প্রকাশ করেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি মুগ্ধবোধ আয়ত্ত করা যে কঠিন, সে কথা ভেবে তাঁর হতাশার কথা ঈশ্বরচন্দ্রকে বলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র আশ্বাস দিয়ে বলেন, মুগ্ধবোধ গিরিশৃঙ্গ তোমাকে অনায়াসে পার করিয়ে দেব। সেই জন্যেই তিনি বাংলা হরফে রচনা করেন ‘উপক্রমণিকা’ এবং ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’। ৫ বছরের কোর্স দু’আড়াই বছরে শেষ করে রাজকৃষ্ণ সংস্কৃত কলেজের সিনিয়র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই অসম্ভব কাজ সম্ভব হওয়ার বার্তা সারা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ে।

সুদীপ বসু

অধীক্ষক, বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

অন্য বিষয়গুলি:

Abhijit Banerjee Nobel Laureate Bengalis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy