‘দর্শকের প্রবেশ বন্ধ শ্রীভূমিতে’ (১৫-১০, ই-সংস্করণ) শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়লাম। জানা গেল, হাই কোর্টের মণ্ডপ-উচ্চতা সংক্রান্ত বিধি না মেনে রাজ্যের দমকলমন্ত্রী স্বয়ং নিজের পুজোর মণ্ডপ বানিয়েছেন দুবাইয়ের ‘বুর্জ খলিফা’র অনুকরণে ১৪৭ ফুট। বিমানবন্দর ওই এলাকার পাঁচ-ছয় কিলোমিটারের মধ্যে। অহরহ বিমান ওঠানামা করে কখনও মধ্যমগ্রাম-বিরাটির উপর দিয়ে, কখনও রাজারহাটের দিক দিয়ে, যা প্রধানত সিগন্যাল-নির্ভর। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল ও পাইলটরা বিষয়টা সূক্ষ্ম বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন করেন। সেখানে রাতের আকাশে জোরালো লেজ়ার রশ্মি বিভ্রান্তি ঘটিয়ে বড় কোনও ভুল ঘটাতে কত ক্ষণ! দমকলমন্ত্রীর এই আইন না-মানার প্রবণতা জনমনে ভাল বার্তা দেয়নি। দর্শনার্থীদের দৃষ্টিসুখ বৃদ্ধি করতে তিনি সফল হলেও, প্রশাসন কালিমালিপ্ত হল।
চার পাশে বহুতল, মাঝে ওইটুকু একচিলতে ফাঁকা জমিতে এত বড় মণ্ডপ। লোকজনের পদপিষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনার কথা মন্ত্রী-সান্ত্রী কেউ ভাবেননি। লেকটাউন হোক, বা শ্রীভূমির দিক দিয়েই হোক— দু’দিক দিয়েই বারো-চোদ্দো ফুটের হাঁটা বা গাড়ি রাস্তায় হাজারে হাজারে দর্শনার্থী ঢুকলে শ্বাসকষ্ট হওয়া বা পদপিষ্ট হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে কোনও পক্ষই ভাবেননি। তৃতীয়া থেকেই ভিড়ের আঁচ একটু একটু করে পাওয়া উচিত ছিল। দক্ষিণ থেকে বিমানবন্দর যাওয়ার এত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তার উপর এর প্রভাব কী হতে পারে, সেটাও প্রশাসনের তরফে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মনে হল। উত্তরের পুজোয় প্রতি বারই শ্রীভূমির চমক থাকে মণ্ডপ ও প্রতিমায়, যার প্রভাব ভিআইপি রোডের উপর এসে পড়ে। তার পরও এ বারের উদ্যোগে কেউ আইনি দিকটি নিয়ে ভাবেননি। হেভিওয়েট পুজোগুলোর উপর সরকার বা প্রশাসনের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে বলে তো মনেই হয় না। প্রশাসন এত দিন দেখেও তদারকি করেনি প্রকল্পটিতে। দমকলমন্ত্রী না-হয় নিজের মতো এগিয়েছেন, পুলিশ প্রশাসন কেন নিশ্চিন্ত রইল? দমকল ক্লিয়ারেন্স না দেখে পুলিশই বা কেন পারমিশন দিল?
বড় বাজেটের পুজোর সূচনা পর্ব থেকে রাশ প্রশাসন বা পুলিশ নিজের হাতে নিলে এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হয়তো এড়ানো যেত। আইন সকলের জন্যই সমান বা আইনের চোখে সকলে সমান, এটা অন্তত প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার।
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪
পুনরাবৃত্তি
পুজো মণ্ডপে ঢোকা বন্ধ করার ঘটনা এর আগেও এক বার ঘটেছিল। এ বছর আবার একই রকম ব্যাপার ঘটল। ২০১৫ সালে কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল— বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু দুর্গাঠাকুর দেখুন এই কলকাতায়। দুর্গা তৈরিও হয়েছিল। কিন্তু ভিড় নিয়ন্ত্রণের কোনও পরিকল্পনা রাজ্য সরকারের ছিল না। পুজো ভাল ভাবে শুরুর আগেই এত ভিড় হয়েছিল যে, সরকার বাধ্য হয়ে এই মূর্তি দর্শন বন্ধ করে দেয়। আর এ বার বুর্জ খলিফার উচ্চতা এতই বেশি হল যে, সরকার-নির্ধারিত উচ্চতার রেকর্ড ভেঙে গেল। আলোর ঝলকানি এমন ছিল যে, বিমান চলাচলে অসুবিধা হচ্ছিল। শেষে অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানোয় আলোর ঝলকানি বন্ধ হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জনগণেরও বুর্জ খলিফা দেখা বন্ধ করে দেওয়া হল। প্রশ্ন হল, যখন এগুলি তৈরি হয়, তখন তো সরকারের অনুমতি নিয়েই তৈরি হয়। তখন কি প্রশাসকরা ঘুমোচ্ছিলেন?
সঞ্জয় চৌধুরী, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
কুমারী পুজো
পুজোর সময় বিভিন্ন স্থানে কুমারী পুজো করা হয়। একুশ শতকে এই পুজোর কি কোনও প্রয়োজন আছে? ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ এই অভিনব পুজোর প্রচলন করেন। শাস্ত্রকাররা নারী জাতিকে শ্রদ্ধা-সম্মান জানাতে এই পুজোর পক্ষে মত দিয়েছেন। পুরুষদের সংযত রেখে নারীকে সম্মান করতে হবে— এটাই কুমারী পুজোর মূল লক্ষ্য। ব্রাহ্মণ কন্যাদেরই এই পুজোতে নির্বাচন করা হয়।
প্রশ্ন হল, এই পুজো করে কিছু লাভ হয়েছে কি? সমাজ কি কোনও শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছে? চার থেকে চুরাশি— যে কোনও বয়সের মেয়েরা ভারতের কোনও অংশেই নিরাপদ নয়। এই বাংলায় ১২১ বছর ধরে কুমারী পুজো হচ্ছে, কোনও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এ ছাড়া যে শিশুটিকে ঘিরে এই উৎসব, তার মানসিক জগতে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হয়, সেটা কি কেউ বলতে পারেন? শিশুদের উপর এই অত্যাচার বন্ধ করা উচিত।
অসীমেশ গোস্বামী, শ্রীরামপুর, হুগলি
প্রকৃত ধর্ম
মধ্যপ্রদেশে রতলাম জেলায় ৫৬টি মণ্ডপে নবরাত্রির অনুষ্ঠানে অহিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (‘অহিন্দুদের প্রবেশ নিষেধ’, ১২-১০)। যদিও ওই পূজা মণ্ডপগুলি তৈরিতে কোনও অহিন্দুর ছোঁয়া থাকলে সেটাও ভেঙে ফেলা হবে কি না, সেই সংবাদ নেই। পুজোতে যে ফুল বা ফল ব্যবহার করা হবে, সেগুলি হিন্দুদের বাগান থেকে যদি না আনা হয় তা হলে কী হবে, তারও কোনও উল্লেখ নেই। এমনকি পিতল, কাঁসা-সহ যে সব সামগ্রী পুজোয় ব্যবহার করা হবে, সেগুলো হিন্দুদের দ্বারা তৈরি কি না, কী করে বোঝা যাবে! যত দূর জানি, উত্তর ভারতের বিভিন্ন কারখানায় (যেমন আলিগড়) হিন্দু-মুসলমান মিলে পিতল, কাঁসা তৈরি করেন।
মধ্যপ্রদেশকে অনেক কিছু পশ্চিমবঙ্গের কাছ থেকে শিখতে হবে। এখানে মহম্মদ আলি পার্কে দুর্গাপুজোর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। যে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমস্ত ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। যত দূর জানি, অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করা সমস্ত ধর্মের মূল কথা। প্রকৃত হিন্দু ধর্মের আদর্শও তা-ই। শ্রীরামকৃষ্ণ নমাজ পড়েছেন, খ্রিস্টসাধনা করেছেন, আবার মন্দিরে পুজোও করেছেন। তাঁর প্রিয় শিষ্য বিবেকানন্দ বলেছেন, “মানবজাতিকে আমরা সেই স্থানে নিয়ে যেতে চাই, যেখানে বেদও নেই, কোরানও নেই, বাইবেলও নেই।” বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কি শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের এই কথাগুলিকে মান্যতা দেয়?
নিখিল কবিরাজ, কল্যাণী, নদিয়া
অন্য উৎসব
তূর্য বাইনের প্রবন্ধ ‘আড়ম্বরে কাটছাঁট হলে মন্দ কী’ (৬-১০) পাঠ করে মনে পড়ল রবি ঠাকুর রচিত শারদোৎসব নাটকে এক অন্য ধারার আনন্দ আয়োজনের কাহিনি, যেখানে বালক উপানন্দ লক্ষেশ্বরের কাছে রেখে যাওয়া তার প্রভুর ঋণ শোধ করার লক্ষ্যে পাতার পর পাতা পুঁথি নকল করে চলেছে। কর্মনিষ্ঠ জীবনে খুশির হাওয়া থেকে সে বঞ্চিত। শারদ উৎসবে বার হওয়া ছেলের দল এবং ঠাকুরদা ও সন্ন্যাসী, সবাই সানন্দে তার কাজ ভাগ করে নিল। সমব্যথী সাহচর্যের কী অপার বন্ধন!
বর্তমানে প্রচারসর্বস্ব সর্বজনীন পুজোর জৌলুসের বিপ্রতীপে সহৃদয়তার বিচ্ছিন্ন কিছু উদাহরণ জায়গা করে নেয় সংবাদপত্রে। শহর জুড়ে থাকা কয়েকটি বিগ বাজেটের পুজো কমিটি নিয়মমাফিক তাদের বাজেটে লিপিবদ্ধ রাখে জনহিতকর কর্মকাণ্ডের জন্য পৃথক তহবিল। এ ছাড়াও আছে স্বেচ্ছায় রক্তদানের উদ্যোগ থেকে ছোটদের বই খাতা রং পেনসিল দেওয়া, বৃদ্ধাবাসের অশক্ত অধিবাসীদের প্রতিমা দর্শনের ব্যবস্থা করা বা পঙ্ক্তি ভোজের মতো হিতকর কিছু কর্মসূচি। প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অন্য রকম কিছু মহতি উদ্যোগও নজর কাড়ে উৎসবের মরসুমে। বর্তমানে আপন আপন সুখের বৃত্ত রচনায় মশগুল আধুনিক জীবনযাত্রায় এ-হেন সহমর্মিতা সংক্রমিত হোক আগামী প্রজন্মের পুজো উদ্যোক্তাদের মধ্যেও, এই আশা রাখি।
সুপ্রতিম প্রামাণিক, আমোদপুর, বীরভূম
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy