হিন্দির অনুপ্রবেশ।
‘সরকারি কাজে ইংরেজির বদলে হিন্দি আনার প্রস্তাব’ (৯-১০) খবরটি পড়ে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। প্রায় ২-৩ বছর আগেও কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় একই ভাবে হিন্দি চাপিয়ে দিতে আগ্রাসী হয়েছিল। প্রতিবাদ হওয়ায় পিছিয়ে যায়। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিন্দির অনুপ্রবেশ ধারাবাহিক ভাবে চলতেই থাকে। ব্রিটিশ রাজের সময় তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে, প্রাদেশিক কংগ্রেস সরকার বিদ্যালয়ে, কলেজে পড়াশোনা, সরকারি কাজ হিন্দি মাধ্যমে চালুর চেষ্টা করেছিল (১৯৩৭-৪০)। তীব্র বিরোধিতার জন্য ব্রিটিশ সরকার হিন্দি প্রত্যাহার করে, কংগ্রেস সরকারেরও পতন হয়। ২০১৪-র পর থেকে হিন্দি চাপানোর প্রক্রিয়া তীব্র আকার নেয়। তাই সংসদীয় কমিটি ওই রকম সুপারিশ করতে পেরেছে। কারণ, এখন কমিটিগুলির মাথায় আর কোনও বিরোধী সাংসদ নেই। এ বার তো সর্বত্র হিন্দি মাধ্যম চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে— কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আইআইটি, আইআইএম, কেন্দ্রীয় স্কুল-কলেজ’সহ সর্বত্র। কেন্দ্রীয় ও হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির সরকারি কাজে তো বটেই, সেই সব রাজ্যের হাই কোর্টেও হিন্দি চালু করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, বাংলার বা অ-হিন্দিভাষী রাজ্যের কেউ কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে নিযুক্ত হলে তাঁকে হিন্দিতেই ফাইলে নোট লিখতে হবে, ক্লাস নিতে হবে, চিঠিপত্র-সহ সব কাজ হিন্দিতেই করতে হবে। সন্দেহ হয়, ইউপিএসসি-তে হিন্দি ভাষায় পরীক্ষা দিয়ে অন্য ভাষা-ভাষীরা চাকরি পাবেন কি না।
টেলিভিশন আসার পর থেকে হিন্দি অ-হিন্দিভাষীদের মস্তকে প্রতিস্থাপিত হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাংলা সিরিয়ালগুলিতে কোনও চরিত্র গান করছে, কিন্তু তা হিন্দি ছবির গান। যেন বাংলা গান দেওয়াই যেত না। টিভি মালিকরা অনেকেই হিন্দিভাষী, তাই কি পরিচালক অসহায়?
সেই বহুকথিত ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান’ তত্ত্ব, এর পিছনে কাজ করছে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ভাষা যে কী আবেগের বস্তু, সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে শাসক দল বুঝতে পারছে না, অথচ ইতিহাসের পাতায় অনেক উদাহরণ আছে। বাংলা ভাষার জন্য শিলচরে অসম সরকারের পুলিশের গুলিতে ১৯৬১ সালের ১৯ মে ১১ জন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন এবং উর্দু ভাষা চাপানোর পরিণতিই যে বাংলাদেশ, সে কথা তো সকলেরই জানা। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি-সহ অন্য অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিও এই হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই যাবে। দেশকে এক রাখতে হলে ২২টি আঞ্চলিক ভাষাকে হিন্দির সমান মর্যাদা দিতে হবে।
প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী, কলকাতা-১০৮
ভাষা রাজনীতি
দেশে প্রযুক্তি শিক্ষা-সহ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এবং সরকারি কাজে হিন্দি ভাষা বাধ্যতামূলক করার যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ সংবিধান বিরোধী। হিন্দি ভাষা বাধ্যতামূলক করার নীতি ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ আদর্শের বিরোধী, এবং জাতীয় সংহতি বিরোধী।
সংবিধানের অষ্টম তফসিলে ২২টি ভাষাকে ভারতের ‘সরকারি ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে হিন্দি একটি। উত্তর ভারতের প্রচলিত কথ্য ভাষার সঙ্গে ফারসি ভাষা যুক্ত হয়ে তৈরি হয় উর্দু ভাষা। এই ভাষা মোগল-পঠান সৈন্যদের মধ্যেই বেশি প্রচলিত ছিল। ইংরেজরা এ দেশে এসে সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও ফারসি ভাষার প্রচলন করলেন। উর্দু হল কথ্য ভাষা। মির্জা গালিব থেকে মুন্সি প্রেমচন্দ পর্যন্ত তাঁদের সাহিত্য রচনা করেছেন উর্দুতে। গোস্বামী তুলসীদাস রামায়ণ রচনা করেছিলেন অওধী ভাষায়। হিন্দিতে নয়।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যে ফাটল ধরাতে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে তৈরি হল মুসলিম লীগ এবং হিন্দু মহাসভা। উর্দু যে-হেতু বেশির ভাগ মুসলমানই ব্যবহার করেন, সে-হেতু সংস্কৃতের দেবনাগরী অক্ষরগুলো নিয়ে উর্দু লেখা শুরু হল। এবং তৈরি হল হিন্দি ভাষা। যার ব্যাকরণ, উচ্চারণ এবং অধিকাংশ শব্দই উর্দুর। উত্তর ভারতে সরকারি ভাবে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার ফলে সেখানকার বেশির ভাগ নিজস্ব ভাষাই আজ অবলুপ্তির পথে। দক্ষিণ ভারতে তামিল, মালয়ালম, তেলুগু, কন্নড় ভাষা এখনও তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বাংলারও হাজার বছরের সাহিত্যের ইতিহাস আছে। আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, এই ভাষা যেন হারিয়ে না যায়।
রাসমোহন দত্ত, মছলন্দপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
সুযোগ সঙ্কোচন
‘সরকারি কাজে ইংরেজির বদলে হিন্দি আনার প্রস্তাব’ সংবাদটি পড়ে শঙ্কিত। বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের সরকারি ভাষা হিন্দি হোক, কেন্দ্রীয় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের ভাষা হিন্দি হোক, হিন্দিভাষী রাজ্যে হাই কোর্টের কাজ হিন্দিতে হোক, সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বাধ্যতামূলক ইংরেজির পেপার তুলে দিয়ে হিন্দি আসুক— সরকারি ভাষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি এই সবই সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, মন্ত্রক সেই রিপোর্টই সেপ্টেম্বর মাসে পৌঁছে দিয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে। এই ভয়াবহ ভাষানীতি আসলে দেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ নামক আগ্রাসী মতাদর্শের ফসল। দেশের বহুভাষাভাষী চরিত্রকে নস্যাৎ করে হিন্দি আধিপত্যের বুলডোজ়ার চালাতেই সরকারি ভাষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির এই সুপারিশ। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে তিন বছর আগে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত ‘ভাষা রাজনীতি’ (১৩-০৭-১৯) সম্পাদকীয়ের কথা, যেখানে লেখা হয়েছিল, “প্রশ্নটি নিতান্তই আধিপত্যের। দেশের শাসকরা ভুলাইয়া দিতে ব্যাকুল যে হিন্দি ভারতের জাতীয় ভাষা বা ‘রাষ্ট্রভাষা’ নহে। তাঁহারা গণচেতনা হইতে এই কথাটি মুছিয়া দিতে চাহেন যে ভারতে কোনও একক রাষ্ট্রভাষা নাই— কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে ইংরাজি ও হিন্দির গ্রহণযোগ্যতা সমান।” ব্যাঙ্ক, রেল-সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় দফতরে দেখা যায় লেখা আছে— “হিন্দি হী রাষ্ট্রভাষা হমারা/ইয়ে হি হিন্দ কি রানি হ্যায়।” এটি একটি আদ্যন্ত রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার। ২৪ জানুয়ারি, ২০১০ সুরেশ কাচারিয়া নামক এক ব্যক্তির দায়ের করা একটি জনস্বার্থ মামলার বিচারে গুজরাত হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি এস জে মুখোপাধ্যায় ও বিচারপতি এ এস দাভে বলেন, ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ভারতে কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই, এবং সংবিধানে এমন কোনও ধারা পাওয়া যায় না (১৩ অক্টোবর, ২০১৩)। ভারতের কোনও ভাষাকে রাজভাষা করার আইন ভারতীয় সংবিধানে পাওয়া যায় না। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪৫ নম্বর ধারাটি ভারতের অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির সরকারি ভাষা সংক্রান্ত আইন। এই ধারায় বলা হয়, ভারতের অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি হিন্দি ও ইংরেজি ব্যতীত সেই রাজ্যের মুখ্যভাষাকে সরকারি কাজে ব্যবহার করতে পারবে। সুতরাং, বর্তমান সংসদীয় কমিটির সমস্ত সরকারি কাজকর্মে হিন্দি চাপানোর মনোভাব সংবিধান-বিরোধীও বটে। এই মনোভাব অ-হিন্দিভাষী ভারতবাসীর মৌলিক অধিকারকেও লঙ্ঘন করবে।
প্রশাসন, শিক্ষা-সহ সমস্ত সরকারি স্তরে ইংরেজি সরিয়ে হিন্দি চাপানোর ইচ্ছা হিন্দি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা আর আগ্রাসনেরই নামান্তর। প্রায় সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি পরীক্ষায় হিন্দিতে প্রশ্নপত্র ও লেখার সুযোগ থাকায় হিন্দিভাষীরা নিজের মাতৃভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পান, অ-হিন্দিভাষীরা পান না। এর ফলেই দেশের প্রশাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিন্দিভাষী আধিকারিক ও কর্মীর প্রবল সংখ্যাধিক্য। আরও বেশি করে হিন্দি চাপালে অ-হিন্দিভাষীদের শিক্ষা-চাকরির সুযোগ আরও কমবে। সমস্ত ভারতীয় ভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে প্রকৃত মেধার বিচার হত, কিন্তু হিন্দি আধিপত্যের রাষ্ট্রীয় নীতি সেই সম্ভবনাকে নস্যাৎ করতে চলেছে।
রুদ্র সেন, কলকাতা-২৮
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy