স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘সব অধিকারে চেপেছে শর্ত’ (২৭-১২) প্রবন্ধে উল্লিখিত ছড়ার শেষ বাক্য ‘সবার চেয়ে অবাক জাদু গরিব লোকের হাসি’ যথার্থ। এত কষ্ট করে বেঁচে থেকেও প্রান্তিক মানুষগুলোর মুখে অমলিন হাসি বাস্তবিকই সমস্ত সচেতন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে বিস্মিত করে। করোনাজনিত আর্থিক সঙ্কট, এবং তার সঙ্গে উপযুক্ত নজরদারির অভাবে এই চড়া মূল্যের বাজারে নিম্নবিত্ত এবং রোজগারহীন মানুষগুলো দিশেহারা। বিনামূল্যে রেশনই তাঁদের ক্ষুধা নিবৃত্তির ক্ষেত্রে আজ সবচেয়ে বড় সহায়। অথচ, ধনী মানুষেরা আরও ধনী হচ্ছেন, খাদের অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন একদম নিচুতলার মানুষগুলো। সামাজিক ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের নামে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন অনুদানমূলক পরিষেবার সুবিধা মানুষ পেলেও, তার সুফল কিন্তু মিলছে না। প্রবন্ধের বক্তব্যে সেটাই উঠে এসেছে— কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা নিয়েও আটকানো যায়নি নাবালিকা বিবাহ ও অকালমাতৃত্ব। এক দিকে বিনাশ্রমে সরকারের কাছ থেকে মানুষ বিভিন্ন ধরনের অনুদান পাচ্ছেন, অন্য দিকে শ্রমের বিনিময়েও আশাকর্মীরা এবং এনআরজিইএ প্রকল্পে নিযুক্ত কর্মীরা সময়মতো মজুরি পাচ্ছেন না। গৃহ পরিচারিকাদের মতো বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের নিশ্চয়তা নেই। বাধ্য হয়ে রাজ্যের শ্রমিক কাজের অভাবে পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে।
বিভিন্ন অনুদান প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষকে সাময়িক খুশি রাখা যেতেই পারে। তবে এই ভাবে অর্থ খরচে ক্রমাগত বেড়েই যাবে রাজ্যের উপর ঋণের বোঝা। মানুষ যদি নিজের রোজগারের অধিকারের দাবিতে এখনই সরব না হন, তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দারিদ্রমুক্তির যে স্তম্ভ আজ নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে, তা এক দিন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
সীমাহীন দারিদ্র
‘সব অধিকারে চেপেছে শর্ত’ প্রতিবেদনটি এক হৃদয়স্পর্শী বাস্তব চিত্র। করোনাকালে এক দিকে যখন শাসক-ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট সংস্থার পুঁজি বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, তখন সীমাহীন দারিদ্রের মুখোমুখি দেশের এক বড় অংশের মানুষ। একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্ষুধার নিরিখে ভারতের স্থান ১১৭টা দেশের মধ্যে ১০২। সব প্রতিবেশী দেশগুলির থেকে পিছিয়ে। সারা বিশ্বে আজ ৮ কোটি মানুষ ঘুমোতে যা়ন খালি পেটে। অপুষ্টির প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে মহিলা ও শিশুদের মধ্যে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবরের মধ্যে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে মারা গিয়েছে ৮০ জন শিশু। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে ও শিশুদের স্কুলের মিড-ডে মিল থেকে ডিম বাদ হয়ে গিয়েছিল প্রায় পাঁচ মাস ধরে। এর ফলে রাজ্য সরকারের ১১০০০ কোটি টাকার সাশ্রয় হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু গর্ভবতী মেয়েদের যখন পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি, ঠিক তখনই অপুষ্টির দিকে তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই পুষ্টি না পেয়ে জন্ম নিয়েছে কম ওজনের, অসুস্থ সব শিশু। পৃথিবীর আলো তারা আর বেশি দিন দেখতে পেল না।
অতিমারির সময়ে প্রান্তিক মানুষগুলোর সন্তানদের শিক্ষায় নেমে এল এক চরম বিপর্যয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘লার্নিং টুগেদার’ সংস্থার ছত্রতলে ৭০০৩ জন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও ৩৬৯টি হতদরিদ্র পরিবারের উপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষা বলছে যে, প্রায় ২৮ শতাংশ শিশু লেখাপড়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তাদের হয়তো কোনও দিন আর বিদ্যালয়মুখী করা যাবে না। ইটভাটা থেকে চটকল, প্রতি ক্ষেত্রেই চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদন কম। তাই হয় মজুরের সংখ্যা কমে গিয়েছে, নয় কমেছে মজুরি। বাঘের আক্রমণে মৃত্যু বাড়ছে, তবু ভয় অগ্রাহ্য করে সুন্দরবনের মানুষ জঙ্গলের ‘কোর এরিয়া’য় বাগদা, কাঁকড়া ধরতে যাচ্ছেন। ধনেখালির তাঁতিদের মাথায় হাত, কারণ তাঁদের উৎপাদনের বেশিটাই কিনত তন্তুজ। সরকারের ভ্রান্ত নীতির ফলে আজ তন্তুজের বিক্রিবাটা একেবারে ভাটিমুখে। এই সঙ্কট থেকে মুক্তির পথ কী?
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১
গিগ-কর্মী
ওলা, উবর, জ়োম্যাটো, সুইগির মতো পরিষেবা শিল্পে যুক্ত এ দেশের দেড় কোটি গিগ-কর্মী। এঁদের দৈনিক গড়ে ১৫ ঘণ্টা কাজ করতে হয়, বেশির ভাগেরই মেলে না ন্যূনতম মজুরি। ইন্ডিয়ান ফেডারেশন অব অ্যাপ বেসড ওয়ার্কার্স এবং ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন— এই দু’টি সংস্থার যৌথ সমীক্ষার রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, গিগ-কর্মীদের উপর নির্মম শোষণ চলছে। প্রথমত, এই কাজে যুক্ত কর্মীদের নিজের অর্থে মোটরবাইক বা গাড়ি কিনে এই পরিষেবার কাজে যুক্ত হতে হয়। ফলে ব্যাঙ্ক ঋণের বোঝা চাপে ঘাড়ে, যার মাসিক কিস্তি মেটাতে আয়ের বড় অংশ চলে যায়। আয় কমে, সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ে, পেটে খাদ্যও কম পড়ে। সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ ও চেন্নাইতে ওলা উবর চালকরা দৈনিক ২০ ঘণ্টার উপর কাজ করেন। ৯০% চালক দিনে ছ’ঘণ্টার বেশি ঘুমোনোর সময় পান না। দীর্ঘ ক্ষণ গাড়ি চালানোর ফলে চালকরা অল্প বয়সেই কোষ্ঠকাঠিন্য, শিরদাঁড়ায় যন্ত্রণা, ঘাড়ে যন্ত্রণা, পেটের অসুখে আক্রান্ত হন। এ দিকে এই গিগ-কর্মীরা কেন্দ্রের সামাজিক সুরক্ষার আওতা থেকে বাদ, এঁদের জন্য নেই কোনও স্বাস্থ্য বিমাও। ফলে রোগ হলে চিকিৎসার খরচ মেলে না, মালিকরাও দেন না কিছু। চিকিৎসার বিরাট খরচ বহন করতে এঁরা অতিরিক্ত সময় কাজ করেন, ফলে আরও অসুস্থ হন।
গিগ-কর্মীদের ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস-সহ ইউরোপের বহু দেশ শ্রমিকের স্বীকৃতি দিলেও ভারত সরকার এঁদের এখনও শ্রমিকের স্বীকৃতি দেয়নি। তাঁদের সামাজিক সুরক্ষায় কর্পোরেট বা সরকারকে যাতে কোনও দায় না নিতে হয়, তার জন্য এই গিগ-কর্মীদের শ্রমিকের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কী নির্মম নীতি! গভীর রাতে যে ওলা বা উবরের চালকটি আমাদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেন, বা শীতের রাতে জ়োম্যাটোর যে ডেলিভারি বয়টি আমাদের ঘরে গরম গরম খাবার দিয়ে যান, আমরা জানতেও পারি না তাঁদের অপরিসীম দুর্দশার কথা।
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
ট্রেনে কোপ
কোভিডের তৃতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের নানা রকম বিধি কার্যকর শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে আংশিক লকডাউনের মতো কড়া নিয়মকানুন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আবারও বন্ধ হয়েছে। সরকারি অফিসে ৫০ শতাংশ হাজিরা, লোকাল ট্রেনে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে করোনার করাল গ্রাসকে উপেক্ষা করেই ঘরের বাইরে বার হতে হয়। শুধুমাত্র বিনামূল্যে রেশনে পাওয়া দু’-কেজি করে গম আর চালে সংসার চলে না, এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। লোকাল ট্রেন ১০০ শতাংশ চললেও তাঁদের পেটের তাগিদে বার হতে হবে, ১ শতাংশ চললেও বার হতে হবে। তাঁরা সকলে রাজকর্মচারী নন যে, হাজিরা না দিলে, অথবা আংশিক দিলেও মাসের শেষে বেতন ঢুকে যাবে। এই সঙ্কটের সময়ে লোকাল ট্রেনের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করে স্বাভাবিক অবস্থায় যে ভাবে ট্রেন চলে, সে ভাবেই চালানো দরকার। বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত কিছু ট্রেন চালানো হলে কিছুটা দূরত্ব বিধি বজায় রেখে চলা যায়। তাতে মানুষ, রাজ্য, দেশ ও দেশের অর্থনীতি— সব কিছুরই মঙ্গল হতে পারে। শপিং মল, সিনেমা হল, রাজনৈতিক জমায়েত, ধর্মীয় জমায়েত সব কিছু খুলে করোনা নিয়ন্ত্রণ যেমন সম্ভব নয়, তেমনই সব কিছু অচল না করে কী ভাবে করোনা সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করে চলা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে।
সাইদুর রহমান, উলুবেড়িয়া, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy