প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন আর এক প্রতিষ্ঠান। —ফাইল চিত্র।
সুবোধ সরকার তাঁর ‘যদি বাংলাতেও লেখেন...’ (১৫-৯) প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শুধু এই বাংলায় জনপ্রিয় নন, যে কোনও পাঠকের কাছেই তাঁর লেখা ছিল সমাদৃত। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আর এক প্রতিষ্ঠান। গভীর ভাবনা প্রকাশেও তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দ। অপার ছিল তাঁর কল্পনাশক্তি। বিশ্ব কবিতার হালহকিকত সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন, তা তাঁর নিজের লেখাতেই জানা যায়। তাঁর সমসাময়িক এবং পরবর্তী লেখকদের মধ্যে উন্নততর নির্মাণের এক অলিখিত, প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা সুনীলের লেখাকে প্রভাবিত করেছে। কম বয়সে আমেরিকা গেলেও সেখানে থেকে যাওয়ার আর ইংরেজি ভাষায় লেখার প্রলোভন সহজে ত্যাগ করেছিলেন মাতৃভাষাকে ভালবেসে। গল্প-উপন্যাস লেখার জন্য সুনীলের হাতেই গড়ে ওঠে বাংলা ভাষার নির্ভার এক রূপ। কবিতা আর গদ্যের এক সন্ধি-সখ্য ঘটিয়েছিলেন তিনি।
নবীন ও প্রবীণ লেখক কবিদের স্বীকৃতি আর মর্যাদা দানে সুনীল ছিলেন প্রবল উৎসাহী। এক সময় বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রসারণে তাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকা বাংলার মানুষ দেখেছেন। চাসনালা খনির দুর্ঘটনার প্রতিবেদন হোক, কিংবা কবিতা রচনা ও সম্পাদনা, বা নীললোহিত নামে আখ্যান, অথবা প্রথম বয়সে কলকাতা ট্রিলজি আর মধ্য বয়সে সময়ের ট্রিলজি— এগুলি নিশ্চিত ভাবে তাঁকে বাঙালি পাঠকের মনে আন্তর্জাতিক মানের লেখক হিসাবে স্থান করে দেবে। সুনীলের সংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক মন মানুষের সমস্যাকে সর্বজনীন চিরন্তন আলোকে দেখে এসেছে। শুরু করলে সুনীলের লেখা না শেষ করে ছাড়া যায় না, এমনই সুখপাঠ্য। দক্ষিণ ভারতীয় এক রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী আমাকে এক বার বলেছিলেন যে, অনেকেই বাংলায় লেখেন, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাংলা আলাদা। এই বঙ্গে এত কোটি মানুষের মাতৃভাষাকে ক্রমাগত কোণঠাসা হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে ভাতঘুমে থাকা বাঙালিকে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে তোলার কাজ তাঁর মতো আর কে করবেন?
বাংলায় লিখে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার সুউচ্চ মিনারে আরোহণ করেও মাটিতে নেমে বাংলা ভাষার স্থায়ী এবং সর্বত্র প্রসারের জন্য পথে নেমে লড়াই করা যায়। তাঁর মতো আর কে-ই বা তা দেখিয়েছেন?
শান্তি প্রামাণিক, উলুবেড়িয়া, হাওড়া
কলকাতা কেন্দ্র?
সুবোধ সরকার লিখেছেন, “...সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরে দ্বিতীয় বাঙালি সুনীল, যিনি সাহিত্য অকাদেমির সভাপতি হয়েছিলেন। তৃতীয় কেউ হবেন, অদূর ভবিষ্যতে তার কোনও চিহ্ন দেখি না।” এই প্রসঙ্গে বলি, সুনীল মূলত বাংলা সাহিত্যরচনা ছাড়া অন্যান্য ভাষাতে (যেমন হিন্দি বা ইংরেজি) সাহিত্য রচনা করে প্যান-ইন্ডিয়ান লেখক হয়ে ওঠেননি। সাহিত্যে ভারতজোড়া তাঁর দাপট ছিল বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক। তবুও ২০০৮ সালে সাহিত্য অকাদেমির সভাপতির পদ পেতে তাঁকে লড়তে হয়েছিল মালয়ালম লেখক এম টি বাসুদেবন নায়ারের সঙ্গে, এবং মাত্র পাঁচটি ভোটের ব্যবধানে (৪৫-৪০) তিনি সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
প্রবন্ধকারের আশঙ্কাকে যদি সত্যি বলে মেনেও নিই, সে ক্ষেত্রেও নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু কথা বলার থেকে যায়। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সাহিত্য অকাদেমির সঙ্গে জেনারেল কাউন্সিল মেম্বাররূপে সরাসরি যুক্ত থাকার সুবাদে সাহিত্য অকাদেমি-কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যচর্চা, প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে কিছু খামতি আমার নজরে এসেছে। এক জন লেখক উঠে আসবেন কী করে, যদি তাঁর গুণের প্রচার, প্রসার ও যথোপযুক্ত মঞ্চে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়? ভগীরথ মিশ্রের মৃগয়া, অভিজিৎ সেনের রহু চণ্ডালের হাড়, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর হলদে গোলাপ ইত্যাদি গ্রন্থ এখনও পর্যন্ত সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের নজরে পড়েনি।
সাহিত্য অকাদেমির জেনারেল কাউন্সিলের (২০১৮-২০২২ সময়সীমার) একটি বৈঠকে ত্রিপুরা সরকারের প্রতিনিধি আকবর আহমেদ প্রস্তাব রেখেছিলেন, বাংলায় সাহিত্য অকাদেমির পুরস্কার যেন চার বছর পর এক বছর বহির্বঙ্গীয় সাহিত্যিকের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে সেই প্রস্তাবটি পরের একটি মিটিং-এ খারিজ করা হয়। মনে পড়ে, সুবোধবাবু লিটল ম্যাগাজ়িনের ‘মৃত্যুঘণ্টা’ শুনতে পাওয়ার কথা লিখেছিলেন একটি প্রবন্ধে। সাহিত্যের প্রসূতি-আগার লিটল ম্যাগাজ়িন। তাই কোনও একটি পত্রিকাকে বছরে এক বার অর্থ পুরস্কার না দিলেও, সম্মানিত করে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার, সেই প্রস্তাব আমিই তুলেছিলাম জেনারেল কাউন্সিলের মিটিং-এ। যথেষ্ট সমর্থনের অভাবে সেই প্রস্তাবও খারিজ হয়ে যায়।
বর্তমানে বাংলা সাহিত্য বড় বেশি কলকাতা-কেন্দ্রিক। সরকারি পুরস্কার পাওয়া বা সরকারি অনুষ্ঠানগুলিতে আমন্ত্রণ পাওয়ায় কলকাতারই প্রাধান্য থাকে চোখে পড়ার মতো। জেলাগুলির প্রতিনিধিরা সংখ্যায় নগণ্য। আর পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বসবাসকারী লেখকরা তো কল্কে পানই না। কিন্তু দু’দশক আগে থেকে সমকাল পর্যন্ত বহির্বঙ্গীয় বাংলা ভাষার যে সাহিত্যিকরা উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, বা করে চলেছেন, তাঁদের ক’জনকে বর্তমান কলকাতা-কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য-কর্ণধাররা স্বীকৃতি দিয়েছেন? তাঁরা কি জানেন ধানবাদ-নিবাসী অজিত রায়ের যোজন ভাইরাস, এক কালে পটনা-নিবাসী সুবিমল বসাকের প্রত্নবীজ বা এথি, আমৃত্যু দিল্লিবাসী মণিরত্ন মুখোপাধ্যায়ের আভরিগাদো ব্রাজিল বা অম্বা, গুরুগ্রাম নিবাসী রবীন্দ্র গুহের শিকঞ্জের পাখি খামোশ বা জৈগুনের পদ্ম প্রভৃতির গ্রন্থের খবর?
বাংলা ভাষার লেখককে যদি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছতে হয়, তা হলে চারাগাছ থাকাকালীন তাঁকে জল-মাটি-বাতাস দিয়ে পরিচর্যা করা দরকার, যে কাজটি করবেন সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয়রা। কিন্তু তাঁরাই যদি স্বভূমে এক জন লেখকের সৃজনক্ষমতাকে দাবিয়ে রাখেন, তা হলে তাঁরা মহীরুহ হয়ে উঠবেন কী ভাবে?
অনাদিরঞ্জন বিশ্বাস, পোর্ট ব্লেয়ার, দক্ষিণ আন্দামান
নিশানা চাই
সুবোধ সরকার তাঁর প্রবন্ধে প্রশ্ন করেছেন, এখন কি আর কোনও লেখক আছেন যিনি বাংলা ভাষার জন্যে রাস্তায় নামতে পারেন? আমার প্রশ্ন, তাঁদের মতো মানুষরাই তো এখানে নেতৃত্ব দিতে পারেন। হয়তো তাঁদের দেখেই আমাদের মতো সাধারণ মানুষজন বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার্থে রাস্তায় নামব। এই লেখায় বলা হয়েছে যে, আজ বাঙালির অবস্থা বড়ই হীন। কিন্তু তার থেকে উদ্ধারের পথটা ঠিক বোঝা গেল না।
‘অন্তর্মুখী’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বড় লেখক হলেও ‘ভারতমুখী নন’— এ কেমন মূল্যায়ন? লেখক মাত্রেই কি বহির্মুখী হবেন, ‘হিল্লিদিল্লি’ করে মাত করে দেবেন, এমনই কি ধরে নেওয়া চলে? চিলির নোবেলজয়ী লেখক গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল ছিলেন পেশায় শিক্ষক, তিনি নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন, তেমন মেলামেশা করতেন না, নজরকাড়া সাজগোজ করতেন না। শুধু কবিতা দিয়ে বিশ্ব জয় করেছিলেন। এমন লেখক-কবি বাংলাতেও ছিলেন, এখনও আছেন। তাঁদের কাজ তাঁরা করছেন, এটাই তো ভাবা উচিত। উল্টো দিকে, বাঙালির এখন একটাই কাজ— ট্রোল করা এবং ট্রোলড হওয়া, লেখকের এই মন্তব্য আশ্চর্য করে। বাঙালি মাত্রেই এ সব করে, লেখক সে কথা জানলেন কী করে? বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষা করার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ডিএ-এর দাবিরই বা কী সম্পর্ক? তা ছাড়া, সব বাঙালি ডিএ নিয়ে পড়ে আছে, আর কিছুই করছে না, এ কথা কি সত্যিই বলা চলে?
সুবোধ সরকার বাঙালিদের ‘লিলিপুটিকরণ’ করে আমাদের চোখ খোলার চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়। কিন্তু কেবলই হতাশার বিষ ঢেলে কোনও লাভ নেই, পথের যথাযোগ্য নিশানা চাই।
তরুণ কুমার ঘটক, কলকাতা-৭৫
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy