Advertisement
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Chemical Fertilizer

সম্পাদক সমীপেষু: বাংলার পুষ্টিচক্র

মাটিতে বাসরত অণুজীব মাটির নাইট্রোজেন, ফসফরাস প্রভৃতি খনিজ দিয়ে গাছের উপযোগী খাবার বানিয়ে দেয়। কৃত্রিম সার, কীটনাশক বা আগাছানাশক বিষ আসলে এই অণুজীব ধ্বংস করে মাটির উর্বরতা ধ্বংস করছে।

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪ ০৭:২০
Share: Save:

জৈব চাষের প্রতি সরকারি উদাসীনতা স্বাতী ভট্টাচার্য তুলে ধরেছেন তাঁর ‘প্রতি দিনের ভয়ের ভোজ’ (২২-৬) প্রবন্ধে। আমাদের গ্রামবাংলা ৬০-৭০ বছর আগেও এক ‘অনন্ত পুষ্টিচক্র’-এর কেন্দ্র ছিল। কৃষক জানত কী ভাবে বীজ বাছতে হয়, জমির উৎপাদিকা শক্তি অটুট রাখতে হয়, প্রাকৃতিক উপায়ে কীট-পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কারখানা-জাত কোনও সার বা বিষের প্রয়োজন হত না। সে সব আমরা ভুলেছি ‘গ্রিন রেভলিউশন’ করতে গিয়ে। বেশি ফসলের টোপ দিয়ে কৃষকদের বেশি সার ব্যবহার করতে শিখিয়েছি, যদিও উৎপাদন বৃদ্ধি এক সময়ে থমকে গিয়েছে। উৎপাদনের হার বজায় রাখার জন্যই এখন আরও সার, জল প্রয়োজন হচ্ছে। কৃষকের আয়ের তুলনায় ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে।

মাটিতে বাসরত অণুজীব মাটির নাইট্রোজেন, ফসফরাস প্রভৃতি খনিজ দিয়ে গাছের উপযোগী খাবার বানিয়ে দেয়। কৃত্রিম সার, কীটনাশক বা আগাছানাশক বিষ আসলে এই অণুজীব ধ্বংস করে মাটির উর্বরতা ধ্বংস করছে। অতিরিক্ত সার এবং কীটনাশক বা আগাছানাশক বিষ জলে মেশায় খাল বিলের মাছের বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জলজ প্রাণী, লতাগুল্মও ধ্বংস হচ্ছে।

একমাত্র জৈব চাষ (প্রাকৃতিক চাষ) এই বিষ চক্র থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে। উষ্ণায়ন কমানোর চেষ্টা বৃথা হবে যদি না আমরা জৈব ফসল গ্রহণ করতে শুরু করি।

অনুপকুমার তোকদার, কলকাতা-৫৯

খাদ্য চাই

স্বাতী ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন, দেশে জৈব চাষ নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। জৈব চাষে উৎপাদন কি কমবে? খাদ্যসঙ্কট দেখা দেবে? চাষ লাভজনক হবে কী করে? সিকিমের জনসংখ্যা মোটে ৭০ লক্ষের কাছাকাছি। সিকিম ১০০ শতাংশ জৈব চাষে সাফল্য পেয়েছে মানে এই নয় যে, সারা দেশে এই ব্যবস্থায় সহজে সাফল্য এসে যাবে। যদি তা-ই হত, তা হলে কেন্দ্রীয় সরকার রাসায়নিক সারে ভর্তুকির জন্য এত টাকা বরাদ্দ করত না। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার সময়ে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৩৬ কোটি, এখন তা প্রায় চার গুণ বেড়েছে। ফসল-আনাজপাতিতে ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহৃত হলেও রাসায়নিক চাষের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরকার সরাসরি কোনও পদক্ষেপ করতে চাইছে না। কারণ, এর বিকল্প কোনও সহজ ব্যবস্থা সরকারের হাতে নেই। তাই ‘পরিবেশ-বান্ধব চাষের জন্য অন্য রাজনীতি চাই’ প্রবন্ধকারের এই ভাবনা বুড়িছোঁয়া হয়ে রয়ে গিয়েছে। জৈব চাষ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা জরুরি।

শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া

কর্মসৃষ্টি

‘প্রতি দিনের ভয়ের ভোজ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সকলকে সচেতন করার আহ্বান। সকলের জন্য সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ খাবারের জন্য চাই জৈব সারের ব‍্যবহার। অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব‍্যবহারে উৎপাদিত সবুজ আনাজপাতি ও অন্যান‍্য খাবার থেকে মানুষের শরীরে বিষ ঢুকছে, তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন মারাত্মক ব্যাধিতে। অথচ, গ্রামে-গঞ্জে রাসায়নিক সারের পসরা নিয়ে কোম্পানিগুলি চাষিদের বাধ্য করছে তাদের সার কিনতে। অল্প জমির মালিকদের রাসায়নিক সার, বীজ, কীটনাশকের অতিরিক্ত মূল‍্যবৃদ্ধিতে জমি চাষ করে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে জমি ঠিকায় কিংবা ভাগচাষ করতে দিয়ে তাঁরা বাইরে কাজে যান পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে। লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র চাষি আজ পরিযায়ী শ্রমিক। শুধু মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে প্রতি বছর কাজে যান ২০-২৫ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক। কৃষিবিজ্ঞানীরা জৈব সারের গুরুত্ব জানেন। এই পদ্ধতিতে চাষ হলে গ্রামের গরিব, কর্মহীন মেয়েদের শুধু লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকাই নয়, তাঁরা কাজও পাবেন জৈব সার তৈরির কাজে। সিকিম যদি ১০০ শতাংশ জৈব চাষ করতে পারে, বাংলা পারবে না কেন? কর্মসৃষ্টি ও মানুষকে সুস্থ রাখার উপায় জৈব চাষ। চাই সরকারের উদ্যোগ ও বেসরকারি সংগঠনগুলির ঐকান্তিক প্রচেষ্টা।

খাদিজা বানু, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

বিষাক্ত

স্বাতী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধটি তাৎক্ষণিক লাভের ভয়াল ছবিটি বেআব্রু করল। স্বাধীনতার পর প্রায় আট দশক পরেও যেখানে ‘ফ্রি রেশন’-এর ভেঁপু বাজাতে হয়, সেখানে পুষ্টি, খাদ্যের গুণমান, খাদ্যে ভেজালের মতো দিকগুলি যে অবহেলিত হবে, সে কথা বলা বাহুল্য। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে বিশ্বের বাজারে শুধু ভারতীয় মশলা নয়, মাছ-মাংস, আনাজ, ফল, পান-সহ নানান জিনিস নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু একই দ্রব্য ভারতের বাজারে বিক্রি হচ্ছে রমরমিয়ে! সেগুলিকে ঠেকাতে সদর্থক ভূমিকা বিশেষ নিতে দেখা যায় না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফে। নজরদারিতে থেকে যাচ্ছে বড় ফাঁক। চালে যাতে শোষক পোকা না লাগে, সে জন্য ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে তাতে মেশানো হচ্ছে কড়া কীটনাশক। লঙ্কা, হলুদ, জিরেগুঁড়ো, গরমমশলা, সবজিমশলা, মিটমশলা-সহ অনেক মশলাতে মেশানো হয় টালিগুঁড়ো, বিপজ্জনক রং ও রাসায়নিক! সপ্তাহে গড়ে বারতিনেক তীব্র কীটনাশক প্রয়োগ না করলে শসা, বেগুন, বরবটি বাজারজাত করা যায় না। লিচুর শরীরে মারণ ধাতব রং, আপেলে মোম, ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড! সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়ায় মারাত্মক ফরমালিন। তালিকাটি সুদীর্ঘ ও শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার মতো। দুশ্চিন্তা গাঢ় হচ্ছে ভারতীয়দের শুগার, প্রেশার, ওবেসিটি, আলসার ও ক্যানসারের বৃদ্ধির হার দেখে। একমাত্র নজরদারি ও সার্বিক সচেতনতা পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

পলাশ মান্না, সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর

তাল-খেজুর

দীর্ঘ দহনে দগ্ধ ধরিত্রী। মেঘ নেই, বৃষ্টি নেই। বন, বৃক্ষহীনতাই এর মূল কারণ। বেশির ভাগ বাড়িতেই ফল-ফুলের গাছ। পথের ধারে বট অশ্বত্থ বকুল কৃষ্ণচূড়াও লাগাচ্ছেন কেউ কেউ। কিন্তু একটা গাছ সক্ষম সাবালক হতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগে। তত দিন তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করার সময়, ধৈর্য নেই কারও।

কিন্তু এমন কিছু গাছ আছে, যারা নিজেই বাঁচে নিজেই বাড়ে। রক্ষণাবেক্ষণের তেমন প্রয়োজন নেই। লাগানো খুব সহজ। বীজ ছড়ালেই হয়। যেমন— খেজুর আর তালগাছ। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এগুলি। কারণ, এখন এই গাছ কেউ লাগায় না। আগে ডাঙা-ডহর পুকুরের পাড় ভরা ছিল এই গাছে। এখন সব কেটে জমি হচ্ছে, পুরনো মাটির রাস্তা পাকা হচ্ছে। গ্রামীণ জীবনে আগে তালগাছ অপরিহার্য ছিল। মাটির ঘরের কাঠের প্রয়োজনীয়তার পনেরো আনাই পূরণ করত তালগাছ। জ্বালানির জন্য লাগত তালপাতা, কাঠ। তালের ডিঙিতে মাছ ধরা, ছোট নদী পারাপার, নালার উপর তালের সাঁকো, পুকুরে ঘাটেও তালের গুঁড়ি! তালপাতার পাখা, চাটাই, তালাই, ছাতা, মাথার টোকা কত কী তৈরি হত। খাদ্য হিসাবেও তালের বিবিধ ব্যবহার ছিল। তালশাঁস, তালরস। শ্রাবণ, ভাদ্র মাসে তাল ফুলুরি, তালের লুচি, তালের বড়া। গ্রামে মানুষ অপুষ্টিতে ভোগেন। অথচ, বলা হয় তালশাঁস, পাকা তালের রস নানান পুষ্টিগুণে ভরা। ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস-সহ নানা খনিজ ও ভিটামিনের ভান্ডার। তালরসের মিছরি শিশু, বৃদ্ধদের জন্য অমৃতসমান।

রাস্তা, বসতবাড়ির পাশের পতিত জমিতে তাল, খেজুর গাছ রোপণ করে গ্রামীণ জনগণের বাড়তি আয়ের উৎস সৃষ্টি করা ছাড়াও চিনি এবং গুড়ের ঘাটতি, মানুষের অপুষ্টিজনিত সমস্যার মোকাবিলা অনেকটাই সম্ভব। বাংলাদেশ এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ করছে। গ্রামীণ অর্থনীতি ও পরিবেশ উন্নয়নে এই সব গাছই হয়ে উঠতে পারে আগামী দিনের কৃষি, কৃষক ও পরিবেশের পরম বন্ধু।

সুব্রত দত্ত, দুর্গাগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chemical Fertilizer Vegetable Farmers Vegetables
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE