Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: জাপান ও স্বামীজি

এক সময় জাপান ছিল সাহসী, শৃঙ্খলাপরায়ণ, দেশপ্রেমিক, ঐতিহ্যের অনুসারী। জাপানিদের জাতীয় চরিত্রে ‘মিস্টিক’ বা গুপ্ত রহস্যবাদ লক্ষ করা যায়।

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৪:০৯
Share
Save

‘এক স্বাদেশিক সন্ন্যাসী’ (১২-১) প্রবন্ধে বিশ্বজিৎ রায় স্বামী বিবেকানন্দের স্বল্পায়ু জীবন ও দেশ-কাল-সমাজ ভাবনায় যে আলোকপাত করেছেন সে সম্বন্ধে দু’চার কথা। বিবেকানন্দ জাপানে গিয়ে অভিভূত হয়েছিলেন, ওসাকায় কী ভাবে নানা শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত হচ্ছে তা দেখে। তখন ভারত ছিল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের করাল গ্রাসে জর্জরিত। সমাজে তথাকথিত পুরোহিতদের প্রভাব জনগণকে বিপথে চালিত করেছিল। কিন্তু সুখসন্ধানী ক্রিয়ামূলক ধর্মের সংস্কৃত রূপ কী হবে, সে প্রশ্ন স্বামীজিকে ভাবিয়েছিল। প্রথমে নিজের দেশ যতটা সম্ভব ঘুরে দেখেছেন এবং যে উপলব্ধি লাভ করেছেন তা দিয়ে চিন ও জাপানের জনগণের কর্মসংস্কৃতির সঙ্গে তুলনা করে নিরাশ হয়েছিলেন। শিষ্যদের চিঠিতে আহ্বান করেছেন, চিন ও জাপান ঘুরে যেতে।

এক সময় জাপান ছিল সাহসী, শৃঙ্খলাপরায়ণ, দেশপ্রেমিক, ঐতিহ্যের অনুসারী। জাপানিদের জাতীয় চরিত্রে ‘মিস্টিক’ বা গুপ্ত রহস্যবাদ লক্ষ করা যায়। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সময় নানা কারণে ক্ষুব্ধ জাপান তার দরজা বন্ধ করে দেয় এবং বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের স্বেচ্ছাবন্দি রাখে। এই অবস্থা দীর্ঘ কাল অব্যাহত থাকে সেখানে। ১৮৫৩-র কাছাকাছি সময়ে আমেরিকার চারটি জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে জাপানে এসে উপস্থিত হয়, তার দু’টি ছিল বাষ্পচালিত। তা দেখে জাপানে প্রচণ্ড আলোড়নের সূত্রপাত হয়। কারণ, এর আগে জাপানিরা বাষ্পচালিত জাহাজ দেখেনি। নানা ঘটনাপ্রবাহের পর জাপানের তরুণ সম্রাট ঘোষণা করেন, “পৃথিবীর সব দেশ থেকে আমাদের জ্ঞান সংগ্রহ করতে হবে এবং সেই লব্ধ জ্ঞান দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ সাম্রাজ্যনীতির ভিত্তি শক্ত করতে হবে।”

প্রতীচ্যের জ্ঞান ও প্রযুক্তি আহরণের মাধ্যমে জাপানি জীবনে শুরু হল নতুন যুগ। বিদ্যুৎগতিতে কলকারখানা ও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার হল। এই পথ ধরেই সাম্রাজ্যলিপ্সাও গ্রাস করল জাপানকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপান একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এই অবস্থার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ সালে জাপানে যান এবং জাপানের উগ্র সাম্রাজ্যলিপ্সা দেখেন। তাঁর তা একদম মনঃপূত হয়নি। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী।

বিবেকানন্দ জাপানের এই আত্মম্ভরিতা এবং আধিপত্যের তমসালগ্ন রূপটি সে ভাবে দেখে যেতে পারেননি। তিনি শিকাগো ধর্মসভায় ধর্মের ব্যাখ্যা এবং হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য সবাইকে বোঝান জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতার বোধ থেকে। ভারতের নারীকল্যাণের জন্য নিবেদিতাকে আহ্বান করেছিলেন তিনি। তাঁকে হিন্দুত্ববাদের ছকে ফেলা যায় না কখনওই। লেখক প্রশ্ন রেখেছেন, স্বামীজি দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হলে হয়তো নিজ ভাবনার বিচার করতেন, কারণ, তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ ‘যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি’র আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।

নারায়ণ সাহা, কলকাতা-৮৪

তাঁর লক্ষ্য

বিশ্বজিৎ রায়ের লেখা ‘এক স্বাদেশিক সন্ন্যাসী’ প্রবন্ধ বিষয়ে কিছু কথা। সে সময়ের ভারতীয়রা জড়প্রায় ও হৃদয়হীন, তাঁদের প্রথমে রজোগুণে উন্নীত করতে না পারলে কোনও ভাবেই তাঁদের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়, এই ছিল তাঁর উপলব্ধি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য-এর ‘ধর্ম ও মোক্ষ’ বিষয়ে স্বামীজির বাণী, “আগে ভোগ কর, তবে ত্যাগ হবে।” অর্থাৎ, লক্ষ্য হল সেই ত্যাগ, তবে ত্যাগ করার জন্যও তো কিছু ভোগ করতেই হয়। স্বামীজির ধর্মের মডেল সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান হয় তাঁর বাণীতে— ধর্ম এমন একটি ভাব যাহা পশুকে মানুষে এবং মানুষকে দেবতায় উন্নীত করে।

লেখক যথার্থই বলেছেন, স্বামীজির ধর্মের সংজ্ঞাটি দেশকাল সাপেক্ষে বিচার্য, তবে তাঁর ওই সংজ্ঞাই যে তাঁর ধার্মিক মডেলের চূড়ান্ত লক্ষ্য, তা বলা বুঝি সঙ্গত নয়। স্বামীজির দৃষ্টি ছিল স্বাদেশিকতার মাধ্যমে বিশ্বমানবিকতায়, স্বদেশপ্রেমের মাধ্যমে বিশ্বপ্রেমে উত্তরণ, যা তাঁর বই ও লেখালিখি পড়লেই বোঝা যায়।

আত্রেয় মণ্ডল, বাঁকুড়া

স্বামীজির দূরদৃষ্টি

বিবেকানন্দের যথাযথ মূল্যায়নের প্রয়াস আছে বিশ্বজিৎ রায়ের লেখা ‘এক স্বাদেশিক সন্ন্যাসী’ প্রবন্ধে। সমাজজীবনের ব্যবহারিক ও বস্তুতান্ত্রিক অগ্রগতির ধারা মানুষের সমস্যার শেষ সমাধান করতে পারে না, চিত্ত ও চেতনাকে ঈশ্বরভাবে ভাবিত করলে তবেই তার নিষ্কৃতি— এমনই ছিল একটি দীর্ঘ চিঠির উপসংহারে বিবেকানন্দের অভিমত। এই চিঠিরই মাঝপথে তিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের ক্রমান্বয়ে আধিপত্যের ভিত্তিতে সমাজ-বিবর্তনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। এই বিশ্লেষণ পদ্ধতি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে সম্পূর্ণ কি না সে প্রশ্ন উঠতে পারে, কিন্তু সমকালীন সমাজের বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে তিনি শ্রেণিস্বার্থের সন্ধান করছেন, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তুলে ধরছেন শোষণের বৈচিত্র এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ-বিবর্তনের ধারা অনুধাবন করার মতো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিচ্ছেন, যা তাঁর উপসংহারের অভিমতকে আগেই অতিক্রম করে গিয়েছে।

তিনি লিখেছেন— বৈশ্যশাসনের মূলে আছে এক নীরব নিষ্পেষণ এবং রক্তশোষক ক্ষমতার ভয়ঙ্করতা। কারণ, তিনি বুঝেছিলেন এই পণ্যপ্রধান পুঁজিবাদী সভ্যতায় শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য মুনাফার আকারে নিংড়ে নেওয়ার এমন একটি কৌশল আছে যে, শ্রমের কত অংশ শ্রমিকের নিজের, আর কত অংশ মালিকের মুনাফায় পরিণত হচ্ছে সে হিসাব করা শ্রমিকের পক্ষে অসাধ্য। অথচ ক্ষাত্রযুগে এই শোষণটা প্রত্যক্ষ ছিল বলে শ্রমজীবী মানুষের চাপা অসন্তোষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটত প্রায়শই। তাই ক্ষত্রিয় শাসনের অনিবার্য অবসান যত দ্রুত হয়েছিল, বৈশ্যশাসনের অবসান তত দ্রুত হওয়ার নয়।

ওই চিঠিতে লেখা— সব শেষে আসবে শ্রমজীবীর প্রভুত্ব। এর সুফলে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পুনর্বণ্টন হবে। সঙ্গে সঙ্গে এর একটা কুফলও বোধ হয় দেখা দেবে। এর উদাহরণ তিনি উল্লেখ করেছেন দেওয়ান হরিদাস দেশাইকে লেখা চিঠিতে। তিনি আমেরিকার কালো মানুষদের মধ্যে অনৈক্য, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও চক্রান্ত দেখে দুঃখ-হতাশা প্রকাশ করেছেন। তবু শ্রমজীবী মানুষের এই বিপ্লবকে অগ্রিম অভিনন্দন জানাতে দ্বিধাবোধ করেননি।

ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠেছেন বার বার। ধনী, জমিদার, পুরোহিত, রাজা-রাজড়াদের নির্মম শোষণ-অত্যাচারের দিকে আঙুলও তুলেছেন। বলেছেন, কোথায় সেই ভালবাসা, পরের দুঃখে কাঁদে কোথায় সেই হৃদয়? সেই বিবেকানন্দ এ দেশে কোন মন্ত্রে পূজিত হন?

দুর্গেশ কুমার পান্ডা, সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

পরিপূরক

কখনও শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রনাথ দত্তকে পুত্রস্নেহে আগলে রাখছেন, আবার কখনও নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐশ্বরিক ক্ষমতার ব্যাপারে চূড়ান্ত সন্দিহান। প্রথম সাক্ষাতেই তিনি ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি ঈশ্বর দেখেছেন?” শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, হ্যাঁ, দেখেছি, যেমন ভাবে তোমাকে দেখছি। প্রখর যুক্তিবাদী, অসাধারণ বিজ্ঞানচেতনায় সমৃদ্ধ নরেন্দ্রনাথ খুবই অবাক হন। কিন্তু, কালের নিয়মে উপলব্ধি করেন, শ্রীরামকৃষ্ণ মিথ্যা বলছেন না, তিনি যে জগতের রক্ষক। এই নরেন্দ্রনাথই বিবেকানন্দ রূপে ঠাকুরের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে বলেছেন, “বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”, আর রামকৃষ্ণ বলছেন, সেবাকার্য ভাল, তবে মাতৃদর্শনের কাছে সব তুচ্ছ। আসলে শ্রীরামকৃষ্ণ মরমিয়া সাধক, আর স্বামীজি চরম বাস্তববাদী, বিজ্ঞানচেতনায় সমৃদ্ধ। দুই দর্শন একে অপরের পরিপূরক।

রক্তিম দেব, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Swami Vivekananda Japan

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}