Advertisement
০৪ জানুয়ারি ২০২৫
Equal Rights

সম্পাদক সমীপেষু: দাসত্বের ট্র্যাজেডি

মনে পড়ছে মুন্সী প্রেমচন্দ ‘সদ্‌গতি’ গল্পটি। মেয়ের বিয়ের কারণে দুখী চামার পণ্ডিতপ্রবর পরম ঈশ্বরভক্ত ঘাসীরামের বাড়িতে উপস্থিত। তাঁকে শুভক্ষণ দেখে দিতে বাড়িতে আনতে হবে যে।

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:৫২
Share: Save:

সোনালী দত্তের ‘এই দাসত্বের অন্ত কোথায়’ (১০-১২) প্রবন্ধে উঠে এসেছে অতীত, সমকাল সমাধানের সূত্রও। তবুও কিছু কিছু দৈনন্দিন দেখা ঘটনাপুঞ্জ, ইতিহাস হয়ে থাকা সমাজের দলিল উল্লেখ আবশ্যক।

মনে পড়ছে মুন্সী প্রেমচন্দ ‘সদ্‌গতি’ গল্পটি। মেয়ের বিয়ের কারণে দুখী চামার পণ্ডিতপ্রবর পরম ঈশ্বরভক্ত ঘাসীরামের বাড়িতে উপস্থিত। তাঁকে শুভক্ষণ দেখে দিতে বাড়িতে আনতে হবে যে। কিন্তু পণ্ডিতজির যাওয়ার সময় কোথায়! সন্ধ্যার আগে তো নয়। তাই তিনি কাজের দীর্ঘ ফর্দ ধরিয়ে দিলেন দুখীকে। কঠিন পরিশ্রমে অভুক্ত পিপাসার্ত দুখী শেষ পর্যন্ত মরল পণ্ডিতের বাড়িতেই। দুখীর বৌ-মেয়ে বস্তি থেকে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ল। পণ্ডিতগিন্নি গজর গজর করেন “এই ডাইনিগুলো তো মাথা খেয়ে ফেললে।” পণ্ডিতমশাই বলেন “কাঁদুক পেত্নীগুলো, কতক্ষণ কাঁদবে? পণ্ডিতগিন্নি বলেন, “চামারের কান্না অলুক্ষুণে নাকি গো?” পণ্ডিত বলেন, “বড্ড অমঙ্গলের।”

২ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার, সম্মান, সুবিচার পাওয়ার দাবি তোলা উচিত। প্রবন্ধকার শুরু করেছেন নির্ভয়া মামলায় ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত মুকেশ সিংহের অভিব্যক্তি দিয়ে— তরুণীর উচিত ছিল বাধা না দিয়ে নির্যাতন সহ্য করা। তা হলে মরতে হত না। তাই তো যৌনাঙ্গে রড বা মদের বোতল প্রবেশ করিয়ে পৌরুষ প্রদর্শনের প্রকাশ ঘটেছে; ঘটছেও চার দিকে। আসলে ‘দাস’ শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মালিক। মালিক মানে আমিত্ব, অহংবোধের প্রকাশ। অসম শক্তির অধিকারী হওয়ায় যে বা যারা যেখানে যতটুকু সুযোগ পায়, তার সবটুকু চেটেপুটে খায়। দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। বিশেষত উচ্চবর্ণের আস্ফালনের শিকার হতে হয় নিম্নবর্ণের মানুষদের।

‘ইউনিসেফ’-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর ১২ লক্ষ শিশু পাচার হয়। তার বৃহত্তম উৎস ভারত। এর মূলে আছে দারিদ্র, সামাজিক বৈষম্য, লোভ, অশিক্ষা ও কুসংস্কার। ফলে বাল্যবিবাহ, দেহব্যবসা, যৌন শোষণ ও শিশুশ্রম ক্রমবর্ধমান। প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন, ২০২২ সালে ভারতের মাটি থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৮৩ হাজার শিশু। ধারণা, পাচার হয়ে গিয়েছে তারা। পণের দাবি পূরণে অক্ষম হওয়ায় প্রতি দিন গড়ে ভারতে খুন হন ২০ জন মেয়ে। এমনকি আত্মনির্ভরশীল নারীকেও ধর্ষিত হতে হয় তার নিজের বাড়িতেই। দাসত্বের এ এক অন্তহীন ট্র্যাজেডি।

এই সিস্টেম থেকে মুক্তি পেতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সুশিক্ষা, সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বোধ। সর্বজনীন শিক্ষাই পারে এই বধ্যভূমি থেকে মুক্তি দিতে।

সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪

দুর্নীতির দায়

‘আর উপরতলার দায়?’ (৭-১২) শীর্ষক সম্পাদকীয় নিয়ে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করলাম, যে-হেতু নিজে দীর্ঘ দিন প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ছিলাম। স্নেহ এবং কর্তব্যে অবহেলার দায়— উভয়ই সর্বদা নিম্নগামী। কর্পোরেট সেক্টর-এ কাজের দায়িত্ব ব্যক্তি বা কর্মচারী-ভিত্তিক এবং সেই কর্মচারী বা আধিকারিক তাঁর কাজের সফল রূপায়ণের জন্য দায়িত্ববদ্ধ থাকেন। কিন্তু সরকারি অফিসগুলিতে স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর পরেও সেই ব্রিটিশ আমলের পদ্ধতি অনুসৃত হয়। অর্থাৎ, কোনও সরকারি কাজে ত্রুটি-বিচ্যুতির দায় বর্তায় নিচু তলার কর্মচারীদের উপর।

আর একটি অত্যন্ত আপত্তিকর বিষয় উপরওয়ালাদের মৌখিক নির্দেশ পালন। আমাদের পিরামিড আকৃতির প্রশাসনে বড় কর্তাদের খুশি রাখার প্রবণতা প্রবল, কারণ বাড়ির কাছাকাছি চাকরি করার সুবিধা পাওয়া। তা ছাড়াও অন্যান্য বাড়তি সুযোগ-সুবিধা তো আছেই। চাকরি জীবনে প্রত্যক্ষ করেছি উঁচু তলার আধিকারিকরা সরকারি কাজের অছিলায় বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করেছেন, খেয়েছেন অধীন আধিকারিকের ব্যবস্থাপনায়। এ ধরনের প্রবৃত্তি সাধারণ প্রশাসনের তুলনায় পুলিশ প্রশাসনে অনেক বেশি বলে অভিযোগ। সাম্প্রতিক কালের আর জি কর কাণ্ড তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রেশন দুর্নীতি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এবং আধিকারিকদের যৌথ পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব নয়। আর সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, রাজনৈতিক মহলে এ ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে, দুর্নীতির প্রভাব ভোটের ইভিএম-এ প্রতিফলিত হয় না। অর্থাৎ, ভোটাধিকার প্রয়োগ গণতান্ত্রিক সচেতনতার ভিত নয়। যে কোনও অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন পরোক্ষ ভাবে রাষ্ট্রের অনুমোদন পাচ্ছে, আর নাম কে ওয়াস্তে নিচুতলার কিছু আধিকারিকের উপর দায় চাপানো হচ্ছে। তবে ইদানীং রাজ্য সরকার দুর্নীতি রোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। নিচুতলার আধিকারিকরাও জোট বাঁধছেন এবং দাবি করছেন লিখিত নির্দেশ ছাড়া তাঁরা কাজ করবেন না।

সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১

পাঠছুট

‘অতঃপর স্কুলছুট’ (৩-১২) সম্পাদকীয়তে উচ্চ মাধ্যমিকে স্কুলছুটের চিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ। সরকারি শিক্ষা আজ চরম সঙ্কটের মুখে। বিশেষজ্ঞরা নানা রকম দাওয়াই দিচ্ছেন রুগ্‌ণ শিক্ষার স্বাস্থ্য ভাল করার জন্য। পিছনে যদি ফিরি, দেখতে পাই আশির দশককে। শিশুমনে চাপ পড়বে, স্কুলছুট বাড়বে— এই আশঙ্কায় নিদান দেওয়া হল ‘নো ডিটেনশন’-এর, যাতে ক্লাস ফোর পর্যন্ত সবাই বিনা বাধায় উঠে যায় পরবর্তী ক্লাসে। কেন্দ্রের নির্দেশে তা বেড়ে হয়েছিল ক্লাস এইট পর্যন্ত। তবে বাস্তবে ক্লাস টেন পর্যন্তই কোনও বাধা ছাড়া সবাই ক্লাসে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু তাতেও স্কুলছুট বাড়ছে। ক্লাস ওয়ানে যত ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়, মাধ্যমিক পরীক্ষায় সকলে বসে না। তা হলে কোথায় যায় তারা? অনুমান সহজ— কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন হাবে, হাটে-বাজারে, হোটেল-রেস্তরাঁ আর মোটর গ্যারাজে। মেয়েদের স্কুলছুটও আটকানো যায়নি ‘কন্যাশ্রী’র মতো বিভিন্ন প্রকল্প দিয়ে।

‘শিক্ষা-বৈদ্য’রা আরও নতুন ব্যবস্থা করেছেন ২০২০ সালে। তার ফলে শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে মহাবিদ্যালয়ও ত্যাগ করছে। চার বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু হওয়ায় শিক্ষার ব্যয়ভার বাড়বে, অথচ শিক্ষান্তে কাজের কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই সেখানেও ছুট। ইউজিসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান সি ডি দেশমুখ বলেছিলেন, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমানোর জন্যই শিক্ষা সঙ্কোচন করা হচ্ছে। আজ বাস্তবে সেটাই হচ্ছে নানা মোড়কে। আমাদের দেশের শিক্ষা কমিশনগুলো বলেছিল, যদি ১০% শিক্ষাখাতে ব্যয় করা যায়, তা হলে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর কোনও চাপ পড়ে না। কিন্তু বাস্তবে কখনও তা ৪%-এর বেশি হয় না। শিক্ষার খরচ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সরকারি সাহায্য ধীরে ধীরে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সর্বোপরি শিক্ষার যে মূল সুর, তা ক্রমাগত অবলুপ্তির দিকে যাচ্ছে। একাদশ শ্রেণির সিলেবাস বার বার পরিবর্তিত হচ্ছে। এতে শিক্ষার মান বজায় রাখা যায় না। অবৈজ্ঞানিক সিলেবাস শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় উৎসাহ দিচ্ছে না।

শুধু ছাত্র নয়, প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোও এলাকাছুট হয়ে যাচ্ছে। অথচ ওই সব স্কুলে এক সময় প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী ছিল। তাদের অনেকেই আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। পাশাপাশি দীর্ঘ দিন ধরে বিদ্যালয়ে কোনও শিক্ষক, শিক্ষা-কর্মী নিয়োগ নেই। স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে খুব কম পারিশ্রমিক দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করলে তার ব্যয়ভার ছাত্র-ছাত্রীদেরই বহন করতে হয়। এমন অনেক স্কুল রয়েছে যেখানে বিষয় থাকলেও বিষয়-শিক্ষক নেই। এই অবস্থায় স্কুলছুট অসম্ভব নয়।

ট্যাব প্রদান একটি ছাত্রদরদি পদক্ষেপ, সন্দেহ নেই। কিন্তু অতিমারির সময় তা কতটুকু কাজ দিয়েছিল, তথ্য-সহ সত্য উন্মোচন হওয়া দরকার। যে সময়ে দরকার ছিল যথাযথ মূল্যায়নের, পরিবেশ অনুকূল থাকলেও তা করা হয়নি।

শঙ্কর কর্মকার, হালিশহর, উত্তর ২৪ পরগনা

অন্য বিষয়গুলি:

Society Communism Slavery Respect Fight For Justice Child Trafficking UNICEF Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy