মোহিত রায়ের লেখা ‘চাই সাহসী সিদ্ধান্ত’ (৪-১২) প্রবন্ধ সম্পর্কে কয়েকটি কথা। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্রোত বার বার ভারতে আছড়ে পড়েছে। এ দেশের বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। আবারও সে রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা।
ভারতে কাজের সুযোগ ক্রমশ কমছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ঋণের উপর ক্রমাগত সুদ বৃদ্ধি পাওয়ায় উচ্চবিত্ত ছাড়া সকলেরই হাঁসফাঁস অবস্থা। সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে প্রবেশ করলে দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়তে পারে। আপাতত অনুপ্রবেশ আটকাতে সীমান্ত বন্ধ রেখে কড়া নজরদারি চালানো হচ্ছে। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়। ভারত সরকারের উচিত পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে একটি দৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রচনা করা। পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষত কলকাতা শহরের কী হাল ছিল আর কী হাল হয়েছে, তা ষাটোর্ধ্ব যে কোনও কলকাতাবাসীকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে। কলকাতায় ভিড়ের চাপ এবং হকারের সংখ্যা কী ভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর আগে থেকেই বেড়ে চলছিল, আমার নিজের চোখে দেখা।
প্রবন্ধকার শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছিলেন বলে ইন্দিরা গান্ধীর প্রশংসা করেছেন। কিন্তু, আজ পরিস্থিতি এক নয়। সে সময় ভারতের জনসংখ্যা ছিল প্রবন্ধকারের মতে প্রায় ৫৫ কোটি, আর এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪৩ কোটিতে। সন্ত্রাসবাদ তখন এত ভয়ঙ্করও হয়ে ওঠেনি। আজ নির্বিচারে সীমান্ত খুলে দিলে শরণার্থীদের পাশাপাশি বহু উগ্র জঙ্গিও ভারতে প্রবেশ করতে পারে। অনুপ্রবেশের স্রোত আটকাতে বাংলাদেশ সরকারের উপর কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক— সব রকম চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সুপরিকল্পনা চাই।
দিল্লির সব সরকারই পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। এই বৈষম্য উত্তর, মধ্য, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে ততটা দেখা যায়নি। এ বিষয়ে বিধানচন্দ্র রায় বার বার কেন্দ্রীয় সাহায্য চেয়ে বিফল হওয়ায় এক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে এর সমাধান চেয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ ঘন বসতিপূর্ণ হওয়ায় শরণার্থীদের জন্য এখানে জমি বাড়ি জোগাড় করাও খুবই সমস্যার ছিল। পরবর্তী কালে অবস্থা খুব বেশি বদলায়নি। হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা বলে খ্যাত একটি রাজনৈতিক দল তাদের শাসনকালে যে পদক্ষেপগুলো করেছে, নাগরিকত্ব সংশোধন আইনে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েছেন ওপার বাংলা থেকে আগত শরণার্থীরা। তাঁদের ভারতে আসার স্রোত কখনও থামেনি। উল্টে বিভিন্ন আইনের দ্বারা তাঁদের বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসাবেই কার্যত চিহ্নিত করা হচ্ছে। যখন যে দলই কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাক, দীর্ঘ দিনের এই সমস্যা মেটাতে কোনও উপযুক্ত নীতি গ্রহণ করেনি। গত তিন-চার মাস ধরে সেই গড়িমসিই লক্ষ করা যাচ্ছে।
কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-২৪
দুঃসময়ে
মোহিত রায়ের লেখা ‘চাই সাহসী সিদ্ধান্ত’ পড়ে এবং এর আগে টিভি ও ইন্টারনেটে বাংলাদেশের হিন্দুদের মর্মান্তিক অবস্থা দেখে চোখে জল এসে যাচ্ছে। কবিতায় আছে, বয়স্ক কাজের মহিলাকে কবি জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ও বুড়িমা, পুব বাংলায় বন্যা দুর্গতদের জন্য তুমি কাঁদো কেন? তোমার কেউ তো ওখানে নেই।’ তিনি উত্তর দেন ‘ওরা যে সব আমার নিজের লোক, আপনজন। আমারও সেই অবস্থা।
ওই বাংলাদেশ আমার বাপ-পিতামহের দেশ। আমার জীবনের প্রথম দশকটিও কেটেছে ওখানে। নিরাপত্তাহীনতা যে কী, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেতাম। বাবা ছিলেন স্থানীয় হাই স্কুলের মাস্টারমশাই। খুব ছোট বয়সে আমাদের গ্রামের কাছাকাছি বাগেরহাটে ভয়ানক দাঙ্গা বেধে গেল। প্রাণ বাঁচাতে আমরা খুলনা শহর থেকে ট্রেনে এপার বাংলায় আসি। মনে আছে বেনাপোল বর্ডারে ভারতের ইঞ্জিন যোগ হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মিশনারিরা দাঙ্গাদুর্গত হিসাবে আমাদের চিঁড়ে, গুড়, গুঁড়ো দুধ ইত্যাদি দিয়েছিলেন। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের শেষে প্রায় দু’বছর ভারতে থেকে আমরা আবার ফিরে যাই। বাবা কিছুতেই ‘সাত পুরুষের বাস্তুভিটে’ থেকে উৎখাত হতে চাইতেন না। ১৯৭১-এর যুদ্ধে গ্রামের সবাই চলে গেলেও বাবা আমাদের নিয়ে থেকে গেলেন। তিনি আশা করতেন ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলায় আমরা সসম্মানে বাস করতে পারব। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমেই পিছু হটছিলেন। লেখক খুলনায় যে হিন্দু গণহত্যার কথা লিখেছেন, আমরাও সে খবর পেয়েছিলাম। অগস্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নদীর অপর পাড়ে চলে আসে, মুক্তিযোদ্ধারা মারা পড়তে থাকে। আমরা রাতে কোনও রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে নৌকা করে এপার বাংলার হাসনাবাদের ঘাটে এসে উঠি। মা আর কিছুতেই ফিরে যেতে চাইলেন না। বাবা এক বার ওখানে গিয়ে ঢাকায় যোগাযোগ করে আমাদের বাড়িটি, বাবার শিক্ষক, সেজো জ্যাঠামশায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বাড়ি হিসাবে ও দেশের সরকার দ্বারা অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করে এলেন।
তার পর দীর্ঘ ৫৩ বছর পার হয়ে গিয়েছে। আমরা কেউ আর ও দেশে যাইনি। ওপারের লোকজনেরা এপারে এসে খোঁজ খবর দিয়ে গেছেন, এই পর্যন্তই। তবু যেন এক অদৃশ্য সুতোর টান থেকে যায়। হাসিনা সরকারের পতনের পরে ও-দেশে চূড়ান্ত অরাজকতা শুরু হয়েছে। গ্রামবাসীরা আমাদের বাড়িতে যে দুর্গাপুজো করেন, এ বছরও সেই পুজো হয়েছে, তাঁরা ছবি পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমাদের গ্রামের কাছাকাছি বিভিন্ন জায়গায় দুর্গামণ্ডপ ও মূর্তি ভাঙচুরের খবর দিয়েছেন। ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে সামরিক প্রহরায় দুর্গাপুজো হয়েছে।
প্রবন্ধকারের বক্তব্যের সঙ্গে আমি সহমত। ১৯৭১-এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লৌহকঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্ত খুলে রেখেছিলেন অসহায় শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তুর খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে ১৩ দিনের যুদ্ধের শেষে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। তিনি আমেরিকার নৌবাহিনীর হুমকি পর্যন্ত উপেক্ষা করেছিলেন। আর এখন মোদী সরকার যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় রয়েছে। প্রতিবেশী অসহায় শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আইন আছে। তবুও সীমান্ত বন্ধ রয়েছে। এ বার ভারত সরকার মানবিক হয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ করুক।
শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর চব্বিশ পরগনা
আর কত
মোহিত রায়ের ‘চাই সাহসী সিদ্ধান্ত’ প্রবন্ধে ছবির মতো দেখতে পেলাম সব কিছু। ফের এক বার শিউরে উঠলাম। সীমান্ত এলাকায় থাকি। উদ্বাস্তু পরিবারে জন্ম। নৃশংসতার এমন বিবরণ ঠাকুমার কাছে শুনতাম ছোটবেলায়। বাবার কাছেও শুনেছিলাম অমানবিকতার অনেক কাহিনি। তখন ১৯৫৪। শেষ সম্বল সামান্য কিছু টাকা আর একটা টিনের বাক্সে কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে ফিরছিলেন বাবা আর তিন পিসি। তাঁদের পথ আটকে দাঁড়িয়েছিলেন দু’-তিন জন। সংখ্যাগুরুর হাতে পায়ে ধরে সেই সময় ট্রাঙ্ক ফেলে পালিয়ে এসেছিলেন সবাই। আর কখনও যাননি।
আজ আবার সময় এসেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। অসহায় উদ্বাস্তু মানুষেরা ইচ্ছে করে তো উদ্বাস্তু হননি। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের বলি হয়েছিলেন। তার কুফল ভোগ করছেন পরবর্তী প্রজন্মও। আমরা সকলে এর আশু সমাধান চাই। ভিটেমাটি, সন্তান ছেড়ে রাস্তায় রাস্তায় প্রাণ হাতে করে আর কত দিন ঘুরবেন তাঁরা! এর সমাধান না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় মূল্য দিতে হতে পারে।
দীপায়ন প্রামাণিক, গোবরডাঙা, উত্তর চব্বিশ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy