ছেলেগুলো পুরো ক্যাম্পাস মুড়ে দিয়েছে পতাকায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে এমন করা যায় না। সবাই জানেন, আমিও। কিন্তু টুঁ শব্দটি করি না। না-দেখার ভান করে ক্লাসে যাই, পড়াই।
“ওই পোশাকে কেন কলেজে? মাথায় ওটা কী?” জবাবের অপেক্ষায় না থেকেই ছেলে দুটোকে বেদম মার। আমি তাকাই, কিন্তু দেখি না। আক্রমণকারী এবং আক্রান্ত, দুই পক্ষই আমার ছাত্র। কিন্তু আমার সাহস নেই মাঝে দাঁড়িয়ে বুক দিয়ে আগলাই বিপন্ন মানবতাকে। বলি, “ওদের গায়ে হাত দেওয়ার আগে আমাকে মারতে হবে।” আমি বলি না কিছুই। অদ্ভুত এক ভয় আমাকে কুঁকড়ে রাখে। পাশ কাটিয়ে যাই।
গুঁড়িয়ে দেওয়া উপাসনাস্থলে রীতিমতো আইন-আদালত মেনে সুরম্য মন্দির হয়েছে রাজন্য অনুগ্রহে। উদ্বোধনের দিনে দেশ জুড়ে প্রতিশোধের তৃপ্তি। উৎসবের উল্লাসে মাতোয়ারা আমার শহর, মহল্লাও। আবাসনে আমার ভদ্রাসনে উড়ছে আগ্রাসী রং। অনুমতি নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি ভয়ে কাঠ। মুখ ফস্কে যদি কিছু বলে ফেলি! ত্যাগ ও তিতিক্ষার ওই রং আশৈশব আমার বড়ই প্রিয়। ভারতীয় ঐতিহ্যের রং। কিন্তু সেই রংও আজকাল রং বদলে ফেলেছে। আমি তাই ভয়ে ভয়ে তাকাই।
সেই রঙের মতোই আমার চার দিকের সবটা বদলে গেছে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রাণের মানুষ। সবাই এখন অন্য রকম। বড্ড অচেনা মনে হয়। আমি এখন সবাইকে ভয় করি। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যেও আমি এখন গেস্টাপো দেখতে পাই। আমার শহরে ভরসন্ধ্যায় রাজপথে আমার সামনেই অ্যাম্বুল্যান্সে ভাঙচুর হয়। আর এক শহরে শ্লীলতাহানির অভিযোগে অভিযুক্ত ও গণপ্রহারে অর্ধমৃত অধ্যাপককে টেনে নামিয়ে দলবদ্ধ প্রহার করা হয়। আমি পাশ কাটিয়ে যাই, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় ভয়ের শৈত্য আমাকে কাঁপিয়ে দেয়।
করোনা তাড়াতে শাঁখ বাজে দেশময়। কাঁসর ঘণ্টা থালা বাটির ধাতব ও কর্কশ ধ্বনি আমার হাড় কাঁপিয়ে দেয়। তীব্র যন্ত্রণায় কষ্ট পাই। কানে হাত দিই। কিন্তু কাউকে বলি না যে, এ ভাবে কোভিড রোখা যায় না। আমার ভিতরে যে ভয়ের সাইবেরিয়া!
ছেলেবেলায় সন্ধ্যার পর উঠোন পেরোতে ভয়ে কাঠ হতাম। মা শিখিয়েছিলেন, ভয় করলেই ভয়, না করলেই নয়। বছর দুয়েক পর পাঠ্যবইয়ে পেলাম অন্নদাশঙ্কর রায়কে: “জগৎ জুড়ে ভয়ের মেলা/ ভয় লাগে যে সারা বেলা/ কেমন করে করব খেলা/ ভয় ভেঙে দাও প্রভু।” আরও পরে পেলাম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে, এ বার অবশ্য পাঠ্যবইয়ের বাইরে। “চলো, বেরিয়ে পড়ি।/ আকাশ এখন ক্রমেই আরও রেগে যাচ্ছে।/ যাক্।/ ভয় করলেই ভয়, নইলে কিছু না।” কিন্তু ভয় যে দিন-দিন জাঁকিয়ে বসে! ঘরের অন্ধকার কোণে নিরাপত্তা খুঁজি।
এই সর্বগ্রাসী ভয়ই রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতার হাতিয়ার। মাস দুয়েক আগে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর জার্নালে ‘ফিয়ার: আ পাওয়ারফুল মোটিভেটর ইন ইলেকশনস’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ বেরোয়। লেখক কার্ক ওয়ালড্রফ, নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গে ভয় ও ভয় ছড়ানোর যে সম্পর্ক রয়েছে তার প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দেন। রচনাটি সদ্য-সংঘটিত আমেরিকান নির্বাচনকে মাথায় রেখে লেখা, কিন্তু যুক্তি-কাঠামো ও বর্ণনা এ দেশের রাজনীতির সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায়। অচিরেই ভারতে মুসলিমরা সংখ্যাগুরু হয়ে যাবে, এই ভয়ই তো হিন্দুদের তাড়িয়ে নিয়ে যায় ভোটকেন্দ্রে। বাংলাদেশে ‘জনতার অভ্যুত্থান’-এর পর হিন্দুদের বেছে বেছে আক্রমণ, খুন, বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আমাদের দেশে মুসলিম-বিদ্বেষ বেড়েছে শতগুণ। এতে শাসক শ্রেণির পোয়াবারো। এ বার নতুন ভয়, অচিরেই গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশ দখল নেবে এবং তৈরি হবে নতুন পূর্ব পাকিস্তান। ফলে এখন রাষ্ট্রবাদী দেশবাসীর পবিত্র কর্তব্য বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি জাতীয় ছেঁদো কথায় কান না দিয়ে এক দেশ এক নেতার চরণে আত্মনিবেদন করা। নতুন এই ভয় অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছে।
২০১৮-তে মনার্কি অব ফিয়ার লিখেছিলেন দার্শনিক মার্থা নুসবম। বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আমেরিকার রাজনৈতিক পটচিত্রে ভয়ার্ত নাগরিকদের মনের গতিপথের হদিস খুঁজেছেন। লিখছেন, “বিভাজিত সমাজে নাগরিকরা গঠনমূলক আলোচনা ও বিতর্কের পরিসরই পান না।” কারণ সেই ভয়। এ বারের নির্বাচনে আমেরিকার জনগণকে সফল ভাবে তিনটি ভয় দেখিয়েছেন ট্রাম্প। এক, বেআইনি অভিবাসীদের তাড়াতে না পারলে দেশ গোল্লায় যাবে। দুই, মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধি আটকাতে হবে। নইলে সাদা আমেরিকানদের সমূহ সর্বনাশ। তিন, কোনও মহিলাকে রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে বসালে আমেরিকার পুরুষতান্ত্রিক মহান ইতিহাস কালিমালিপ্ত হবে। নারীবিদ্বেষী ট্রাম্পের কোনও সমস্যাই হয়নি মহিলা ভোটারদের মন পেতে। রুশোর এমিল উদ্ধৃত করে মার্থা দেখিয়েছেন, ভয়তন্ত্র তৈরি করে যে একনায়কেরা দেশ শাসন করেন, তাঁদের মানসিক গঠন ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে অপরিণত বালকের বিস্তর মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
এ সব তো সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের কথা। কিন্তু আমি আমার দেশের কথা ভেবে ভয়ের তাড়সে লুকিয়ে পড়ি। এই ভয় থেকে মুক্তির পথ কী? নতুন বছরে সঙ্কল্প, ‘ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার’। তাই রবীন্দ্রনাথেই আশ্রয় নিই। ভিতরের ‘আমি’টা আমাকেই বলে ওঠে, “তোমার মনে ভয়, আমার ভয় হারা...”
অর্থনীতি বিভাগ, কাছাড় কলেজ, শিলচর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy