লতা মঙ্গেশকর। ফাইল চিত্র।
এমন নয় যে, অপ্রত্যাশিত। কিন্তু তাতে ধাক্কা কম লাগেনি। যখন খবর এল লতা মঙ্গেশকর পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তখন প্রত্যাশিত ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও বহু মানুষের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
এটা হয়। কারণ, এঁরা তো নিছক জনপ্রিয় তারকা নন। লতা ও তাঁর সতীর্থরা, যাঁরা প্রায় কেউই আর ইহজগতে নেই (আশা ভোঁসলে ছাড়া), তাঁরা একটা বিরাট সময় ধরে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে আছেন। শুধু স্মৃতি নয়; অবিস্মরণীয়, অবিচ্ছেদ্য, সক্রিয় অংশ। ঠিক যেমন ভাবে আমাদের জীবনে জড়িয়ে আছে কলকাতা শহর বা রবীন্দ্রসঙ্গীত। দশকের পর দশক ধরে আমাদের সমবেত চেতনায় এক সংস্কৃতির প্রলম্বিত নির্মাণ। আমরা কি কেউ মনে করতে পারব, কবে প্রথম শুনেছিলাম লতা বা মহম্মদ রফি-র নাম?
এই কিংবদন্তিরা সর্বার্থেই এখনও জীবিত আছেন আমাদের মধ্যে। তার প্রমাণ, এঁদের ঘিরে বহমান, তীব্র আলোচনা। কে বড়— লতা না গীতা, দিলীপকুমার না উত্তমকুমার, লতা ও রফি-র আলাদা ভাবে গাওয়া একই গান, কোনটা বেশি মনোমুগ্ধকর— এই সব নিয়ে তর্ক, চিৎকার, প্রায় হাতাহাতি। আর উচ্ছ্বাস? অবশ্যই। প্রাণের লক্ষণই তো উচ্ছ্বাস।
বিখ্যাত নায়িকা থেকে শুরু করে অনাম্নী নটী, সকলের জন্যই গান গেয়েছেন লতা। তার মধ্যে যেমন রয়েছেন মীনাকুমারী-নার্গিস-মধুবালা-ওয়াহিদা রহমানের নাম, তেমনই আবার রয়েছে তাঁর গলায় ‘সোচকে ইয়ে গগন ঝুমে’-র মতো এমন কিছু অনন্য গান, যার সুরে পর্দায় ঠোঁট মেলাচ্ছেন যিনি, তাঁকে খুব কম লোকই চেনেন। এই একই কাণ্ড রফি ঘটিয়ে গিয়েছেন, অসংখ্য বার। এই দুই শিল্পী ছিলেন ছোট-বড় সব সুরকারের প্রিয়— নৌশাদ-শচীন দেব বর্মণ-সলিল চৌধুরী-মদনমোহন থেকে শুরু করে বিস্মৃত হন্সরাজ বহেল-জি এস কোহলি-রামলাল পর্যন্ত।
বৈচিত্র ও গভীরতা— প্রতিভার এ দুই বৈশিষ্ট্যে লতা মঙ্গেশকর চিরকালীন ভাস্বর। প্রেম, ঈশ্বর, বিরহ, আনন্দ— সব কিছুই ফুটিয়ে তুলেছেন এক অবিশ্বাস্য কলানৈপুণ্য ও প্রজ্ঞার জোরে। মীনাকুমারীর বিষণ্ণতা (‘চলতে চলতে য়ুঁহি কোই মিল গয়া থা’, পাকিজা), ওয়াহিদার স্বপ্নিল এষণা (‘কাল কে সপনে আজ ভি আনা’, আদমি), হেমা মালিনীর চপলতা (‘ও ঘটা সাঁওরি’, অভিনেত্রী), জয়া ভাদুড়ির লাজুক রোম্যান্স (‘বাহোঁমে চলে আ’, অনামিকা)— কত অজস্র উদাহরণ। এর বাইরেও লতা গেয়েছেন আরও কত ধরনের গান, গড়ে উঠেছে এক বিশাল, বৈচিত্রময় ভান্ডার।
মনে পড়ে, শঙ্কর জয়কিষণের সুরে লতা ও রফি পৃথক ভাবে গেয়েছিলেন একটি গান। তাই নিয়ে কতই না তর্কবিতর্ক আমাদের। আজ সব তর্ক গান হয়ে উঠছে যখন মাথার মধ্যে ওই সুরসিঞ্চিত লাইনগুলো ফিরে আসছে অবাধ্য অবসেশন-এর মতো— “তুম মুঝে য়ুঁ ভুলা না পাওগে; জব কভি ভি সুনোগে গীত মেরে; সঙ্গ সঙ্গ তুম ভি গুনগুনাওগে।”
কে বেশি ভাল গেয়েছিলেন? না, আজ এ প্রশ্ন অবান্তর।
সুরঞ্জন চৌধুরী
কলকাতা-৯৭
তিনি আছেন
তিনি কি সত্যিই বিদায় নিলেন, না কি তাঁর মতো কিংবদন্তি বিদায় নিতে পারেন না? সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর শারীরিক ভাবে আমাদের ছেড়ে গেলেও তাঁর গান মানুষকে সমৃদ্ধ করতে থাকবে। বাবার কাছে সঙ্গীতের জীবন শুরু। সেই পথেই প্রায় সত্তর দশক বিচরণ করেছেন। তাঁর সমসাময়িক বা পরে যাঁরা সঙ্গীত জগতে এসেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই হয় অবসর অথবা চিরবিদায় নিয়েছেন। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার, উপাধিতে তিনি ভূষিত হয়েছেন। তাঁর সঙ্গীত সাধারণ মানুষের মনে সুখে-দুঃখে— যে কোনও ক্ষেত্রেই আনন্দ দিয়েছে। তাঁর কণ্ঠের জাদু, মাধুর্য প্রতিটি মানুষের মনের মণিকোঠায় সযত্নে সাজানো থাকবে। প্রায় ৩৬টি ভাষায় ৩০ হাজারের কাছাকাছি গান গেয়ে সঙ্গীত জগৎকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। আমরা যেমন তাঁর সঙ্গীতের সুধা পান করে আনন্দিত হব, তেমনই হবে আগামী প্রজন্মও।
দেবদূত মণ্ডল
নুরপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
যুগের অবসান
দেশ জুড়ে চলা সরস্বতী বন্দনার আবহেই চিরতরে বিদায় নিলেন ‘ভারতের কোকিলকণ্ঠী’ লতা মঙ্গেশকর। করোনা কাটিয়ে উঠলেও ৯২ বছর বয়সে কোভিড পরবর্তী অসুস্থতার ধাক্কা সামলাতে পারলেন না শিল্পী। ১৯২৯ সালে ইন্দোরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন লতা। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড়। তাঁর বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর মরাঠি সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন, পাশাপাশি অভিনয়ও করতেন।
পাঁচ বছর বয়সেই লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গীতে হাতেখড়ি। ১৯৪২-এ মরাঠি ছবি ‘কিটি হাসাল’-এ প্রথম গান রেকর্ড করেন তিনি। ১৯৪৫-এ পারিবারিক বন্ধু বিনায়ক দামোদরের ‘নবযুগ চিত্রপট’ সিনেমা কোম্পানি মুম্বই পাড়ি দেয়। লতাও সঙ্গে আসেন। লতাজির প্রথম উপার্জন ছিল ২৫ টাকা। প্রথম বার মঞ্চে গাওয়ার জন্য লতাজি ওই টাকা পান। তিনি এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় ছবিতে এবং ৩৬টিরও বেশি আঞ্চলিক ও বিদেশি ভাষায় গান গাওয়ার রেকর্ড করেছেন। ১৯৬৩ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের আবহে গাওয়া ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগো’ গানটি আজও ভারতের মতো ভিন্ন ভাষাভাষীর দেশে দেশাত্মবোধক গান হিসাবে বাজে।
বাংলা ছিল তাঁর ভালবাসার জায়গা। কিশোরকুমার আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর ‘রাখি ভাইয়া’। বাংলায় বিবেকানন্দকে নিয়ে গান রেকর্ড করার প্রবল ইচ্ছে ছিল তাঁর। সরস্বতীর ইচ্ছেও বুঝি আটকে রাখে সময়। ভারতীয় সঙ্গীতের দুনিয়ায় লতা মঙ্গেশকরের অবদান ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। ১৯৮৯ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান। ২০০১ সালে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক নাগরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করা হয়েছিল তাঁকে। ২০০৭ সালে ফ্রান্স তাদের দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার (লেজঁ দ্যনর) দিয়ে সম্মানিত করে লতা মঙ্গেশকরকে।
একটা যুগের শেষ হল। কিন্তু তিনি যে ব্র্যান্ড তৈরি করেছিলেন, তা রয়ে গেল। আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন সুরের সরস্বতী। তাই সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন তিনি।
আব্দুর রউফ মোল্লা
শান্তিপুর, নদিয়া
আরও যাঁরা
‘অসংখ্য চা-শ্রমিকের জুটত না পানীয় জলও’ (রবিবাসরীয়, ৩১-১) শীর্ষক প্রবন্ধটি তথ্যসমৃদ্ধ। এতে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং অসমের চা বাগানের শ্রমিকদের কথা বলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গেই তাঁর প্রথমা কন্যা নিরুপমা সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করা যায়।
নিরুপমা (বেলা)-র বিবাহ হয় মন্মথ লাল হালদারের সঙ্গে। এই হালদার পরিবার ছিল বহু চা বাগানের মালিক। ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত এই পরিবারের বসবাস ছিল অসমের ডিব্রুগড় শহরে। যাতায়াতের সূত্রেই চা বাগানের শ্রমিকদের দুর্দশার কথা প্রথম নজরে আসে— এ কথা নিশ্চিত ভাবে উল্লেখ করা যায়। এবং অনুমান করা হয়, ব্রাহ্ম সমাজ এই যোগাযোগের সূত্রে দ্বারকানাথকে এই কাজের দায়িত্ব অর্পণ করে। দ্বারকানাথ, কাদম্বিনীর সঙ্গে কন্যা নিরুপমার সক্রিয় ভূমিকা ছিল এ ক্ষেত্রে। জামাতা মন্মথ লালেরও প্রচ্ছন্ন সহায়তা ছিল এই মহৎ কাজে।
পরবর্তী কালে পিতা-মাতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কন্যা নিরুপমা এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। অতএব তাঁর কথা উল্লেখ না করলে রচনাটি সম্পূর্ণ হয় না। দ্বারকানাথের কনিষ্ঠ পুত্র প্রভাত চন্দ্রের স্ত্রী সরলা দেবীও ছিলেন ডিব্রুগড় শহরের মেয়ে। তখনকার আমলে, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা সত্ত্বেও এই প্রত্যন্ত ডিব্রুগড় শহরের হালদার পরিবারের সাহায্য সহায়তার কথা উল্লেখ করা একান্ত প্রয়োজন।
ইন্দ্রজিৎ নন্দী
কলকাতা-৩৭
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy