E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: জীবনের পাঠ

মহাকাশচারীরা ৮ দিনের জায়গায় আটকে পড়লেন ২৮৬ দিন। পরিস্থিতির কোনও নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে ছিল না। তাই তাঁদের মানিয়ে নিতে হত, ধৈর্য ধরতেই হত, অপেক্ষা করতেই হত।

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:৪৪
Share
Save

সুনীতা উইলিয়ামস আর ব্যারি বা বুচ উইলমোর মহাকাশে গিয়েছিলেন বোয়িং-এর তৈরি স্টারলাইনার স্পেসক্রাফ্টে চড়ে। সব কিছু পরিকল্পনা মতোই চলছিল। কিন্তু ফেরার ঠিক আগে অপ্রত্যাশিত কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তাঁদের ৮ দিনের সফর শেষ হতে লেগে গেল ২৮৬ দিন। তার পর ইলন মাস্কের তৈরি স্পেস এক্স ক্রু ড্রাগনে করে তাঁদের ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু সুনীতা আর ব্যারির কাছে কি বিষয়টা অপ্রত্যাশিত ছিল? একদমই না। তাঁরা ভাল করেই জানতেন মহাকাশ সফরের প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে অনিশ্চয়তা আর বিফলতার ভ্রুকুটি। স্পেসক্রাফ্ট যাত্রা শুরুর মুহূর্ত থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। নাসাও তা জানত। আর, আমরা তা জানলাম এত দিনে।

তবুও তাঁরা পিছপা হননি। কারণ নিজের কাজের প্রতি একাগ্রতা আর পেশাদারিত্ব তাঁদের সাহস জুগিয়েছে। সেলেব্রিটি তকমা পাওয়ার জন্য তাঁরা মহাকাশ সফর করেননি। তাঁরা গিয়েছিলেন বিজ্ঞান গবেষণার স্বার্থে। আর আমরা সহজেই ধৈর্য হারাই যখন ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়ি, কোনও পরীক্ষা কিংবা ইন্টারভিউতে প্রথম বার অসফল হই, সুইগি কিংবা জ়োম্যাটোতে খাবার আসতে ২ মিনিট দেরি হয় কিংবা কোনও নতুন প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষর হতে যদি কয়েক দিন মাস সময় লাগে। কিন্তু ওই মহাকাশচারীরা ৮ দিনের জায়গায় আটকে পড়লেন ২৮৬ দিন। পরিস্থিতির কোনও নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে ছিল না। তাই তাঁদের মানিয়ে নিতে হত, ধৈর্য ধরতেই হত, অপেক্ষা করতেই হত। আর চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেও বিশ্বাস রাখতে হত ২৮৬ দিন পরে নিজেদের ঘরে ফেরার।

কিন্তু বর্তমান সমাজজীবনে আমরা যেন সহজেই ধৈর্যচ্যুত হয়ে পড়ছি। সস্তায় কোনও কিছু পাওয়ার লোভে সহনশীলতা হারিয়ে ফেলছি। সাফল্যের ইঁদুর-দৌড়ে প্রথম হওয়ার প্রচেষ্টায় ছেলেমেয়েদের বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে সঠিক শিক্ষা দেওয়ার ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি। সাময়িক অসফলতায় দোষারোপে বিদ্ধ করছি পরবর্তী প্রজন্মকে। উন্নতির দোহাই দিয়ে ছেলেমেয়েদের জীবনের প্রেশার কুকারে বন্দি করে দিচ্ছি। পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছি। তাই আজকের পর থেকে জীবনে যখনই কোনও অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হতে হবে, তখন মনে রাখবেন— আপনি অন্তত মহাশূন্যে আটকে নেই। ৮ দিনের জায়গায় ২৮৬ দিন অপেক্ষা করতে হবে না।

অনিশ্চয়তা জীবনের অঙ্গ। জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, অনেক পরিকল্পনা পাল্টে যাবে, অনেক বিফলতার মোকাবিলা করতে হবে, সফল হতে সময় লাগতে পারে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু যদি সুনীতা উইলিয়ামস আর ব্যারি উইলমোর ৮ দিনের জায়গায় ২৮৬ দিন মহাকাশে বেঁচে থাকতে পারেন, তা হলে আমরাও নিশ্চয় জীবনের ছোটখাটো বাধা সহজেই সামলে নিতে পারব। উইলিয়ামস আর উইলমোরের লড়াই আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।

দীপঙ্কর মান্না, অসলো সায়েন্স পার্ক, নরওয়ে

মেয়েদের প্রেরণা

দেবীপ্রসাদ দুয়ারীর লেখা ‘আকাশের দখল নেওয়া’ (১-৪) প্রবন্ধটি মন ছুঁয়ে গেল। সুনীতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোরের ২৮৬ দিন মহাকাশ যাপন সত্যিই সাধারণ মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই যাপন ও নিরাপদে ফিরে আসা অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা, রাশিয়া, জাপানের মিলিত প্রচেষ্টায় মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণা ও তার প্রয়োগ সত্যিই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে। এ ভাবে যদি গোটা পৃথিবী দেশ-ধর্ম-জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠতে পারত, তবে সবাই শান্তিতে থাকতে পারতাম। সুনীতা উইলিয়ামসের মহাকাশে থাকা, গবেষণা করা, মহাকাশ স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণ, বিশেষত তাঁর বয়স ও কেরিয়ার— সব কিছুই যেন মেয়েদের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির সঞ্চার করে। পৃথিবীতে অনেক নারীই নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু মহাকাশে এক নারীর অনিশ্চিত অথচ কর্মচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ জীবন প্রমাণ করে যে, সুযোগ পেলে মেয়েরাও প্রচলিত ধারণা ভাঙতে পারেন। সুনীতা ও বুচের গবেষণা মহাকাশ বিজ্ঞানকে অনেক দূর এগিয়ে দিল।

শেষে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। সুনীতা যদি ইসরো থেকে রওনা হতেন, আমাদের পক্ষে কি তাঁকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হত? আমেরিকা যা খরচ করেছে, তা তো আমাদের গোটা এক বছরের মহাকাশ গবেষণার বাজেটের থেকেও বেশি। আমাদের বিজ্ঞানীদের প্রতিভা, মেধা, পরিশ্রম— সব থাকা সত্ত্বেও তখন হয়তো বিতর্কের সূচনা হত যে এই টাকাটা কোথায় দেওয়া ভাল— মহাকাশে না মন্দিরে?

সিক্তা দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান

পাঠের সার্থকতা

রিয়া মোদক ‘অতই সহজ পাঠ?’ (১৬-৪) প্রবন্ধে সহজ পাঠ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এক দিকে যেমন রবীন্দ্রনাথের গ্রামবাংলার মনোরম রূপ তুলে ধরার কথা বলেছেন, তেমনই অন্য দিকে অভিযোগ জানিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে রয়েছে প্রান্তিক মানুষের প্রতি অবজ্ঞার ভাব। প্রশ্ন হল, কথাগুলি কতটা যুক্তিযুক্ত।

সহজ পাঠ-এ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন (যার উল্লেখ লেখক করেছেন) যে, কাঠুরে সর্দার বকশিশ নিতে অস্বীকার করলেন কারণ উপকার করাকে তিনি ধর্ম বলে মনে করেন আর তার বিনিময়ে টাকা নেওয়া তাঁর বিবেচনায় অধর্ম। এর মধ্যে দিয়ে আসলে লেখকের অবজ্ঞা বর্ষিত হল শক্তিবাবুর প্রতি যিনি সব কিছুর মূল্য যাচাই করছেন অর্থ দিয়ে। ১৮৯০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে ঠাকুর পরিবারের বিস্তৃত জমিদারির ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলার গ্রামেগঞ্জে, লক্ষ করেছেন প্রকৃতির মন-ভোলানো রূপ, তেমনই শিলাইদহ কাছারি বাড়িতে এবং অন্যত্র সাক্ষাৎ করছিলেন বহু দরিদ্র প্রজার সঙ্গে। গ্রামজীবনের দুর্বিষহ অবস্থা তিনি চাক্ষুষ করেছেন, প্রজাদের দুঃখকষ্ট তাঁকে নাড়া দিয়েছিল গভীর ভাবে। তাই নিসর্গপ্রেমী হলেও তিনি রোম্যান্টিকতা দিয়ে গ্রামজীবনের দৈন্য এবং বৈষম্যকে নির্লিপ্ত ভাবে আড়াল করেননি। বরং, গ্রামীণ পুনর্গঠনের ভাবনাকে তিনি যে বাস্তব রূপ দিয়েছেন, এ কথা তো সকলেরই জানা। আবার তাঁর গল্প উপন্যাস বা কাব্যেরও একটি মোড় ঘুরেছিল জোড়াসাঁকোর পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে গ্রামগঞ্জে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করার ফলে। আর, শহুরে বাবুরা অনুকম্পা দেখিয়ে গ্রামের মানুষের উপকার করে অনেক সময় যে আত্মতুষ্টির মনোভঙ্গি প্রকাশ করেন, তিনি ছিলেন তার তীব্র সমালোচক।

গ্রামের জলকষ্ট, কৃষিজমির খণ্ডীকরণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, গ্রামকে শোষণ করে শহরের পুষ্টি— এই সব কিছুকেই তিনি বহু বার ধিক্কার জানিয়েছেন। গ্রামের সুদখোর মহাজনের শোষণের ভয়াবহতা সম্বন্ধে তিনি যেমন জানতেন, তেমনই জানতেন জমিদারি ছেড়ে দিলেই এই শোষণ সমাপ্ত হবে না। আসলে এই সব প্রেক্ষিতকে নজরে রাখলে সহজ পাঠ-এর ভিন্ন একটি পাঠ সম্ভব। গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও তার ঋতু পরিবর্তনের চোখভোলানো রূপের বন্দনা করাটা একেবারেই অসঙ্গত নয় যে-হেতু শিশুর মনে প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীলতা ও একাত্মবোধ তৈরি করা একান্তই জরুরি ছিল। তেমনই গ্রামসমাজে বৈষম্য ও বঞ্চনার বাস্তবতা বিষয়ে সহজ পাঠ-এর লেখক অজ্ঞ তো ছিলেনই না, বরং এই সমাজের বাস্তব রূপকে তিনি শিশুপাঠ্য বইয়ে চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছেন। জাতিগত তফাত, শ্রেণিবৈষম্য এবং অন্যান্য বৈষম্য যা ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তাকে শিশুপাঠ্য বইয়ে সূক্ষ্ম ভাবে তুলে ধরেছেন, যা মোটেই সহজ কাজ নয়। এই ভাবে শিশু পাঠককে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর একটি জরুরি কাজ সম্পন্ন হচ্ছিল। এই প্রয়োজনীয় কাজটি সেই সময় কত জন এই ভাবে করতে পেরেছিলেন, সন্দেহ আছে।

সুজাতা মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৯

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sunita Williams Astronauts NASA

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।