বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে কতগুলি বই এখনও অবধি লেখা হয়েছে? দু’শোর কম হবে না সম্ভবত। মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এর দুই-তৃতীয়াংশেরই বেশি প্রকাশিত তাঁর মৃত্যুর পরে। আলোচ্য বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে সম্পাদক শুরুর দিকেই মনে করিয়ে দিয়েছেন, “আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে সত্যজিতের স্থান এবং সত্যজিৎ ও তাঁর শিল্পকর্ম সম্বন্ধে আমাদের আগ্রহ, দুয়েরই আমূল পরিবর্তন হয়েছে তাঁর মৃত্যু পরবর্তী তিরিশ বছরে।”
অনুষ্টুপ পত্রিকায় প্রকাশিত সত্যজিৎ-সম্পর্কিত লেখালিখির এই সঙ্কলনগ্রন্থ নিজেও তার সাক্ষ্যবহ। যে কারণে দেখা যায়, ১৯৮১ সালে দেবীপদ ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ ‘সমকাল ও সত্যজিৎ রায়’ প্রকাশের পরে ১৯৯২-এর আগে এ পত্রিকায় সত্যজিৎ-বিষয়ক আর কোনও লেখা প্রকাশিত হয়নি। সে দিক থেকে এই সঙ্কলন শুধু এক গুচ্ছ মনোজ্ঞ প্রবন্ধের সমাহারই নয় শুধু, বাংলা লিটল ম্যাগাজ়িনের পরিসরে সত্যজিৎ-চর্চার গতিপ্রকৃতিরও দলিল। সত্যজিৎকে নিয়ে চর্চা ও সত্যজিৎ-চর্চার ইতিহাস, দু’দিক থেকেই এই বই মূল্যবান। সম্পাদক নিজে একাধারে ইতিহাসবিদ ও সত্যজিৎ-গবেষক বলে এই দ্বিবিধ তাৎপর্যের দিকটি স্পষ্ট ধরিয়ে দেন।
১৯৮১-২০২১ কালপর্বে প্রকাশিত মোট ২০টি প্রবন্ধ এই সঙ্কলনে স্থান পেয়েছে, ৬টি শীর্ষকে। প্রথম শীর্ষক, ‘ঐতিহ্য শিক্ষা বিবর্তন’-এ তিনটি লেখা, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাম হালদারের। দ্বিতীয় শীর্ষক ‘বিষয় রবীন্দ্রনাথ’। এখানেও তিনটি লেখা— সুধীর চক্রবর্তী, শিলাদিত্য সেন ও সন্দীপন সেনের। এর পর সৌরীন ভট্টাচার্য ও ছন্দক সেনগুপ্তের লেখা নিয়ে পরের শীর্ষক ‘পথের শুরু’। ‘সমকালের ইতিহাস’-এ পাঁচটি লেখা। প্রবীর বসুর দু’টি, বাকি তিনটি দেবীপদ ভট্টাচার্য, চিন্ময় গুহ ও সৌমিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ‘ছবি লেখা’ শীর্ষকে পাচ্ছি চার জন লেখককে— শোভন সোম, নীলাঞ্জন হাজরা, বিশ্বজিৎ রায় ও সৌভিক চট্টোপাধ্যায়। শেষ শীর্ষক ‘এক নজরে’-তে রয়েছে দু’টি লেখা, দীপেন্দু চক্রবর্তী ও দেবীপদ ভট্টাচার্যের।
নিখাদ স্মৃতিমূলক লেখা একটিই, রাম হালদারের ‘সত্যজিৎ: কিছু স্মৃতি...’। অসামান্য স্মৃতিচারণ। এই প্রকাশনা থেকেই পাওয়া যায় তাঁর একটি বই, কথকতা কমলালয় ও প্রসঙ্গ ফিল্ম সোসাইটি (এখন নাম কথকতা কমলালয় ও প্রসঙ্গ ফিল্ম সোসাইটি এবং সত্যজিৎ রায়)। সম্প্রতি সেই বইয়ের নবকলেবরেও এই স্মৃতিলিখনটি যুক্ত হয়েছে। দেবীপদ ভট্টাচার্যের ‘মানুষ ও শিল্পী’তেও স্মৃতি আছে বেশ খানিকটা জুড়ে।
আঁকিয়ে সত্যজিৎকে নিয়েও বইয়ে একটিই লেখা, শোভন সোমের ‘চিত্রকর সত্যজিৎ’। অনুষ্টুপ-এ প্রকাশিত দেবাশীষ দেবের ‘রং তুলির সত্যজিৎ’ লেখাটি পূর্ণাঙ্গ বই হয়ে বেরিয়েছে বলে এই সঙ্কলনে নেই। সত্যজিতের সঙ্গীতভাবনা নিয়ে একমাত্র লেখাটি সুধীর চক্রবর্তীর। সত্যজিতের নিজের লেখা ‘রবীন্দ্রসংগীতে ভাববার কথা’ প্রবন্ধ, সুভাষ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও সত্যজিতের ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহারকে মনে রেখে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত-ভাবনার বৈশিষ্ট্যকে বিশ্লেষণ করেছিলেন সুধীরবাবু। তবে এক জায়গায় খটকা লাগে। সত্যজিতের প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিকা থেকে ‘মম চিত্তে’ যে চারুলতা-র আবহ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছিল, ‘বাজিল কাহার বীণা’ পূর্ণাঙ্গ ভাবে এবং ‘অন্ধজনে দেহ আলো’র একটি পঙ্ক্তি (সংযোজন অংশে কিন্তু লেখা দু’টি পঙ্ক্তি) আগন্তুক-এ ছিল, এ কথা তিনি নিজেই লিখছেন ১০৪ নম্বর পাতায়। অথচ ১০৫ নম্বর পাতায় বলছেন, “আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, সত্যজিৎ তাঁর প্রিয় গানের একটাও চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করেননি।”
অনুষ্টুপের সত্যজিৎ
সম্পা: ছন্দক সেনগুপ্ত
৫০০.০০
অনুষ্টুপ

পথের পাঁচালী আমেরিকায় কী ভাবে পৌঁছল, সে বিষয়ে ছন্দক সেনগুপ্তের লেখাটি চোখ খুলে দেওয়ার মতো। অপুর আমেরিকা-যাত্রায় এডগার কাউফম্যানের ভূমিকা এর আগে আমরা জানতাম কি? সত্যজিতের না-হওয়া ছবি ‘একটি জীবন’কে ঘিরে লেখায় সৌমিক বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার দেখাচ্ছেন, “তাঁর পরিকল্পিত খসড়াতে গুরুদাস নির্জন মগ্ন-তাপস নন, সমাজব্যবস্থায় প্রোথিত জীবন্ত মানুষ, রাজনৈতিক পঙ্কিলতার সাক্ষী ও শিকার।” যুদ্ধ-বিগ্রহ ও অন্যান্য ভাবনায় উপেন্দ্রকিশোর থেকে সুকুমার হয়ে যে পরম্পরা সত্যজিতে বর্তেছে, তার দীর্ঘ আলোচনা শিবাজীর লেখায়। চমকপ্রদ অবলোকন: “বিনা সরণ-অনুবাদে মুখের কথার সাক্ষাৎ বাণীরূপ গড়বার সুকুমারী কায়দাটি খেয়াল রাখলে মনে হতেই পারে, সত্যজিৎ-এর গুপী গাইন ও বাঘা বাইন-এ হাল্লার কুমতলবি পরাগ্রাসী মন্ত্রী দ্বারা শুন্ডিতে প্রেরিত লোকটির খঞ্জ হওয়াটা মোটে খামোখা ব্যাপার না। কেননা, যে দূত রণ-পরাজয়ের দুঃসংবাদ বহন করে আনে, তার আভিধানিক, সাবেকি পারিভাষিক আখ্যাই যে ‘ভগ্নদূত’।” রাজনীতির অন্য পিঠ, সত্যজিতের লিঙ্গচিন্তা বিষয়ক লেখায় শিলাদিত্য সেন দেখান, “অশোকও (কাঞ্চনজঙ্ঘা) অপুর মতোই এক পুরুষ যাকে পৌরুষ-এর ফ্রেমে আঁটানো যায় না, সত্যজিৎ আঁটাতে চান না।” চিন্ময় গুহ লক্ষ করেন, “শ্যামলেন্দুর চরিত্রকে উন্মোচিত হতে সাহায্য করে টুটুল, সে যেন নায়ক ছবির অদিতি বা অরণ্যের দিনরাত্রি-র অপর্ণা। তিনটি নারী চরিত্রেই... শর্মিলা ঠাকুর।”
সত্যজিতের গঠনপর্ব ও প্রথম ছবি নিয়ে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমেশ্বর ভৌমিক এবং সৌরীন ভট্টাচার্যের লেখার মধ্যে এক অন্তর্লীন সংলাপ যেন তৈরি হয় আপনা থেকেই। যেমন শমীকবাবু লিখছেন, “সত্যজিৎবাবু আসলে নিও-রিয়্যালিজম্-এর মতাদর্শগত লক্ষ্যকে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছেন না। ‘বাইসিক্ল থীভস্’-এর দৃষ্টান্ত তাঁর হাতে এনে দিয়েছে অনুন্নত দেশে ছবি তৈরির একটা পদ্ধতি মাত্র।” সোমেশ্বর ভৌমিকের লেখায়, “নব বাস্তববাদী ছবির মূল মতাদর্শ তাঁর কাজে আসেনি। কিন্তু বিভূতিভূষণের এই উপন্যাস থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠ অর্জন— এর মানবতাবোধ, এর কাব্যধর্ম আর এর সত্যময়তা।” পাশেই সৌরীন ভট্টাচার্য: “ছবি তৈরির আঙ্গিকের কথা ভাবতে গিয়ে পরিচালক কিন্তু অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছেন। উপন্যাসের ‘ring of truth’ বা সত্যবোধ তাঁকে টেনেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে উপন্যাসের এক ধরনের ‘rambling quality’-ও তাঁর নজরে আছে... তাঁর ছবিতে authenticity-র প্রয়োজনে সত্যজিৎ ছবির শরীরে rambling quality-র দরকার বোধ করছেন। এর কারণ বলতে গিয়ে তিনি অন্য একটা সমাজসত্যের উচ্চারণ করে বসলেন— life in a poor Bengal village does ramble.”
একই রকম পারস্পরিক সংলাপ-সম্ভাবনায় টগবগ করে সত্যজিতের বন্ধুভাবনা সংক্রান্ত দু’টি লেখাও, নীলাঞ্জন হাজরা ও বিশ্বজিৎ রায়ের। ফেলু ও জটায়ুর মিথস্ক্রিয়াকে ছেনে বিশ্বজিৎ বললেন, “ফেলুদা আর লালমোহনের টানাপোড়েন দুই সংস্কৃতির লড়াই, তবে শেষ অবধি দুই-ই রইল— সত্যজিৎ ফেলুদার মাধ্যমে লালমোহনকে খানিক শুধরে দিলেন বটে কিন্তু লালমোহনের কলম রোধ করলেন না। উচ্চ-সংস্কৃতি, ভদ্রলোক সংস্কৃতি ইত্যাদির অছিলায় জন-সংস্কৃতির কণ্ঠরোধ করাও একরকম স্বৈরাচার”।
নতুন আলো ফেলা, চিন্তা উস্কে দেওয়া অনেকগুলো লেখাকে এক মলাটে নিয়ে আসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বই হয়ে থাকল এটি। মুদ্রণপ্রমাদ বড্ড বেশি, এড়ানো যেত না?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)