Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

নিস্তব্ধতা আর হ্যামলিনের বাঁশির সুরে মিশে যাচ্ছে অ্যাম্বুল্যান্সের হাহাকার

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।

বাড়ি থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে করোনা আক্রান্তকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নিজস্ব চিত্র

বাড়ি থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে করোনা আক্রান্তকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২০ ১৬:০২
Share: Save:

আগের কথা

আমার পিএইচডি গতবছর নভেম্বরে, আই আই টি খড়্গপুরে। তার আগেই আসে আইনস্টাইনের আপন দেশে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে পোস্ট ডক্টরেট করার সুবর্ণ সু্যোগ। ডিসেম্বরে যাত্রা। গন্তব্য অনতিপরিচিত, ছোট্ট কিন্তু মিষ্টি শহর হ্যানোভার, ডিস্ট্রিক্ট লোয়ার স্যাক্সনি। এয়ার ইন্ডিয়ায় কলকাতা থেকে দিল্লি আর ফ্র্যাঙ্কফুর্ট হয়ে পৌঁছে গেলাম হ্যামবার্গ থেকে প্রায় ১৫০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে, হ্যামলিনের লাগোয়া এই শহরটিতে। যেখানে রাতের বেলা কান পাতলে আজও যেন সেই বিখ্যাত বাঁশির সুর ভেসে আসে। সব ঠিকঠাকই চলছিল। বিজ্ঞানী হিসাবে নীরবে নিভৃতে অঙ্ক কষতেই ভাল লাগতো বরাবর। জিনতত্ত্ব সেরকম না বুঝলেও, সংখ্যাতত্ত্ব ফিরে আসে খাতায়-কলমে, বার বার। তখনও জানতাম না কী অপেক্ষা করে আছে জীবনে, তখনও ভাবিনি, যখন আমি পিএইচডি শেষ করছি, মাও সে তুংয়ের দেশে সকলের অজান্তে (অথবা গোপনে) বীজ বুনে চলেছে এক ভয়াবহ অতিমারি। ৩ জানুয়ারি, চিনে নতুন বর্ষবরণের প্রস্তুতি। সেদিন ঘটনাটা প্রথম জানলাম আমার ল্যাবমেট লেই ঝ্যাংয়ের কাছে। ওর বাড়ি হুবেই প্রদেশেই! কেউই পাত্তা দিই নি। আরে আমাদের দেশে পথ দুর্ঘটনাতেই তো কত মানুষ মারা যান। এভাবে চলল আরও একটা মাস। ফেব্রুয়ারি ১৫, জার্মানিতে ব্যাভেরিয়ায় এক কোম্পানিতে চিন থেকে আসা এক কর্মচারির থেকে করোনায় আক্রান্ত হল ১৮ জন। তত দিনে চিন বাদে দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইরান করোনার কবলে। আমার আন্তর্জাতিক ল্যাবমেটরা দ্বিধাবিভক্ত হল। এক দল ভয়ে নিকটবর্তী থাই রেস্তরাঁয় লাঞ্চ করা বন্ধ করল। আমি এক মুঠো ভাতের লোভে রইলাম দ্বিতীয় দলে।

যুদ্ধপ্রস্তুতি

শক্ত-সমর্থ জাতি জার্মানরা কোনদিনই অন্য দেশের সংবাদমাধ্যমের ভরসা রাখে না। রবার্ট কক ইন্সস্টিউটের তথ্যে এদের অগাধ বিশ্বাস। মার্চের শুরুতে যখন জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ ছাড়াল তখনও এদের কোনও হেলদোল দেখলাম না। এশিয়ানদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও শুনতে পাওয়া গেল যে, এরা ফ্লু-এর ভয়ে মুখোশ এঁটে বাড়িতে বসে থাকে, ইত্যাদি। হঠাৎ ইটালিতে মৃত্যুমিছিল শুরু হল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এরা এমন বিপর্যয় দেখেনি। তাই অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙল জার্মান প্রশাসনের। এদিকে আমরা কিন্তু রোজ অফিস করে চলেছি। এবার সংখ্যাতত্ত্বে আসি। ৬ দিনে সংখ্যাটা ছাড়ালো ১০০ থেকে ১ হাজার। সাধারণ মানুষের হাসিঠাট্টা ক্রমশ নীরবতায় রূপান্তরিত হল। অফিস বাথরুমের বেসিনের পাশে ঝোলান হল হাতধোয়ার নিয়মাবলি, জার্মান ভাষায়। অ্যাঞ্জেলা মার্কেল চাঁছাছোলা ভাষায় আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস দিলেন। লকডাউনের সিদ্ধান্ত হল ১৩ মার্চ, শুক্রবার। তখন আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৭৫। আসলে এর প্রায় ১০ গুণ, যা এর পরের সপ্তাহে ধরা পড়ল। তবে ইউনিভার্সিটি, বাস-ট্রাম কিছুই সরকারি ভাবে বন্ধ হল না। আমাদের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ চালু হল। পাশের শহরে এক তথাকথিত নামি প্রাইভেট সংস্থায় চাকুরীজীবী আমার এক মাসতুতো ভাইযের কাছে নির্দেশ এল, অফিসে এসেই কাজ করতে হবে। ভারতে তখনও করোনা ছড়ায়নি। বাড়িতে সবাই বললো, অনেক হয়েছে, ফিরে আয়। আমি কিন্তু গেলাম না। কারণ এয়ারপোর্টে করোনায় আক্রান্ত হলে সেটা আমার বাড়ির বয়স্ক লোকেদের জন্য খুব একটা ভালো হবে না।

প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহ

শুক্রবার অফিস ফেরত ছুটলাম বাজারে। অর্ধেক জিনিস পেলাম না। আমাদের ক্ষেত্রে টিস্যু পেপারের প্রয়োজনীয়তা অপেক্ষাকৃত কম। মাস্ক, স্যানিটাইজার, সাবান এক মাস ধরেই পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির পরামর্শে এক মাসের চাল, ডাল আর কিছু ফলমূল কেক, বিস্কুট এসব আগেই কেনা ছিল। সত্যি বলতে যা কাজের চাপ, তাতে প্রথম সপ্তাহের এই আকস্মিক ছুটি ভালই লেগেছিল। নিজের ঘরে আপন মনে কাজ করছিলাম। সময়ের বাধ্যবাধকতা ছিল না। রান্না শিখছিলাম। অনেক বন্ধুদের সাথে চ্যাটে আড্ডা হচ্ছিল অফিসটাইমেই। ‘কন্টাজিয়ন’ আর ডাস্টিন হফম্যানের ‘আউটব্রেক’ ছবি দুটি ফের দেখলাম। এভাবে শুরু হল দ্বিতীয় সপ্তাহ। ভারতে ধরা পড়ল সংক্রমণ। ইউরোপের উন্নাসিকতার থেকে শিক্ষা নিয়ে একদম সঠিক সময়ে ভারতে নেমে এল লকডাউন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স, অভিজিত বন্দোপাধ্যায়ের লেটেস্ট বই, হইচই, নেটফ্লিক্স, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, এবিপি আনন্দ, চা-কাকু মিম, আর মিনিটে মিনিটে অতিমারির আপডেট দেখে দিন কাটছিল। এ বার দুম করে মিলিয়ে গেলো অদূর ভবিষ্যতে প্রিয়জনদের দেখতে পাওয়ার ক্ষীণ আশাটুকুও। বাড়ির শাসানিতে সান্ধ্যভ্রমণ বন্ধ হল। সারাদিন বাড়ি থাকায় খাবারের ভাঁড়ার দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। বাড়িটি মেনরোডের উপর হওয়ায় প্রতি আধ ঘন্টায় একটা করে অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন শুনতে পাচ্ছিলাম। এক এক দিনে জার্মানিতে সংক্রামিত হতে লাগল ৬ হাজারের বেশি মানুষ। ইটালির পরিসংখ্যান ছিলো আরও ভয়াবহ। ভয়ানক ভাইরাস এই ছোট্ট শহরটাকেও ছেড়ে কথা বলল না। একদিন বিকালে আমার বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে থাকা বয়স্ক প্রতিবেশিনীকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে নিয়ে গেলো কিছু মুখোশধারী। আমার অন্যতম আর এক প্রিয় শহর প্যারিসে ২১ বছর বয়সী এক কিশোরীর মৃত্যু সংবাদ এলো। আত্মহত্যার খবর এলো জার্মান অর্থমন্ত্রীর। আমার গলাটা একটু খুসখুস করলেই পাগলের মতো এমার্জেন্সি নাম্বার হাতড়াতে আরম্ভ করলাম। সব সময়েই একটা অনিশ্চয়তা তাড়া করতে লাগল। যদি এর পর খাবার না পাই? ভারতে মা-বাবার জন্য টেনশন গ্রাস করল। প্রথম বার একাকীত্বে এত অসহায় বোধ করলাম। দু’বেলা শুরু হল ‘অমলের’ শুধুই জানলা দিয়ে ফাঁকা রাস্তার দিকে চেয়ে থাকা আর বেঁচে থাকার লড়াই। খাবার বলতে ডাল-ভাত সিদ্ধ, নুন, একটু মাখন আর গভীর বিষণ্ণতা। শাক-সবজি আলু-পেয়াঁজ নিত্যসামগ্রী শেষ হওয়ায় এ বার বুঝলাম বাজার যেতেই হবে। শুরু হলো অতিক্ষুদ্র, অদৃশ্য এক শত্রুর বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধের প্রস্তুতি।

তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহ

তৃতীয় সপ্তাহে, অবশষে, মুখে রুমাল বেঁধে বেরলাম ভয়ে ভয়ে। সুপার মার্কেটে নিত্যসামগ্রী আবার পাওয়া যাচ্ছে দেখলাম। জার্মানরা খুব নিয়মানুবর্তী। সবাই দু’মিটার দূরত্ব বজায় রেখে কেউ কারও দিকে না তাকিয়ে, লাইন দিয়ে বাজার করে বাড়ি চলে যাচ্ছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা মনে করিয়ে দিল জীবনানন্দের কবিতা, “অদ্ভুত আঁধার এক…”। এ দিকে কোনও মতে বাজার করে দৌড়ে বাড়ি এসে চলল এক ঘন্টা ধরে হাত-পা, চুল, জ্যাকেট, জুতো আর দরজার হাতল ধোয়ার পালা। কেনা জিনিসপত্র ফেলে রাখলাম তিনদিন। অফিসের বন্ধুদের দেখা করার জন্য মন কেমন করতে লাগল। বুঝলাম এদেশ হয়তো সামলে নেবে, এখানে দুম করে চাকরি কেড়ে নেওয়া যায় না। অন্তত ৩ মাস মাইনের ৬০% বেকার ভাতা দেবে সরকার। এ বার এল চতুর্থ সপ্তাহ, ভারতে তখন লকডাউনের সবে ১২ দিন। সবাই বাজিও ফাটাল। জার্মানিতে তখন আক্রান্ত ১ লাখের বেশি। মৃতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। সামনে শুধুই অন্ধকার, দুঃস্বপ্ন। কত দিন কারও সাথে সামনাসামনি ভাল করে কথা বলিনি। তবু বুকে আশা রেখেছি। জার্মানিতে করোনায় মৃত্যুর হার কিন্তু এখনও কম। কারণ টেস্ট হচ্ছে অনেক বেশি। এত দিনে সরকারের প্রচেষ্টা নজরে পড়ার মতো। কিন্তু আমাদের দেশ? সাধারণ মানুষ? খাবে কী? দুর্ভিক্ষ? যুদ্ধ লাগবে না তো? ব্রতী হলাম বরানগর রামকৃষ্ণ মিশনের ক্লাসমেটদের সাথে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য সামান্য কিছু অর্থ সংগ্রহে। এপ্রিলে বাড়ি ফেরার কথা ছিল। জানি না অক্টোবরে দুর্গাপুজোতেও ফিরতে পারব কিনা। শুধু জানি বিজ্ঞানীদের হাত ধরে, আমারই বন্ধুদের হাত ধরে আমরা বন্দিজীবন থেকে আবার মুক্ত হব। দেশে ফিরব। আরও এক বার দেখবো ‘শশাঙ্ক রিডেম্পশন’। এখানে বরফ পড়ে বলে বাড়িগুলোর ছাদ নেই। আমি বাড়ি ফিরে আবার দেখবো মুক্তির আকাশ। আশা রাখব, এই ভাইরাস, আর এক বার আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় ঘটাবে। বুঝিয়ে দেবে, যত দিন আমরা বিভেদ ভুলে এক হতে না পারব, তত দিন আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি নই, কিছুতেই নই।

রক্তিম হালদার

গবেষক, হ্যানোভার অপটিক্যাল টেকনোলজি, লিবনিৎজ ইউনিভার্সিটি, হ্যানোভার

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE