২০২৪-এর শেষ দিনে হায়দরাবাদে প্রতিদ্বন্দ্বী কেরলকে ১-০ গোলে হারিয়ে এ বারের সন্তোষ ট্রফি জিতল বাংলার ফুটবল দল। শেষ বার ট্রফি এসেছিল ২০১৬-১৭ মরসুমে, তৎকালীন কোচ মৃদুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোচিংয়ে। শুধু তা-ই নয়, আজ পর্যন্ত সন্তোষ ট্রফির ৭৮ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড ৩৩ বার (যার মধ্যে আছে ১৯৭৫-৭৬ থেকে ১৯৭৯-৮০ মরসুম পর্যন্ত টানা পাঁচ বার এবং ১৯৯৩-৯৪ থেকে ১৯৯৮-৯৯ পর্যন্ত টানা ছ’বার) বিজয়ী হওয়ার নজির স্থাপন করল বাংলা। টুর্নামেন্টে মোট ১২টি গোল করে টুর্নামেন্টের সেরা তথা গোল্ডেন বুটের অধিকারী হলেন বাংলারই রবি হাঁসদা। তিনি শুধু ফাইনালে একমাত্র জয়সূচক গোলই করলেন না, ভেঙে দিলেন ৫৪ বছর আগে ১৯৬৯-৭০ মরসুমে বাংলার হয়ে মহম্মদ হাবিবের করা ১১টি গোলের রেকর্ড। অবশ্য এই প্রসঙ্গে এ বারের বাংলা ফুটবল দলের অভিজ্ঞ কোচ সঞ্জয় সেনের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, যাঁর অনবদ্য কোচিং এবং স্ট্র্যাটেজি, বিশেষ করে ফাইনালে, বাংলাকে আবার ভারতসেরা করেছে। তবে সঙ্গত কারণেই সঞ্জয় সেন বাংলা তথা বাঙালির ফুটবল নিয়ে ইদানীং কালের সমালোচনায় ক্ষুব্ধ। তাঁর প্রশ্ন যে, বর্তমান জাতীয় কোচ, ফেডারেশন বা আইএসএল ক্লাবগুলির মালিকেরা কি আদৌ সন্তোষ ট্রফিকে গুরুত্ব দেন?
এ কথা অবশ্য ঠিক যে, ইদানীং ভারতীয় ফুটবল দলে বাঙালি খেলোয়াড়দের সংখ্যা একেবারেই তলানিতে এসে পৌঁছেছে। এমনকি গত ১৮ নভেম্বর হায়দরাবাদেই মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ফিফার বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচের জন্য নির্বাচিত ভারতীয় দলে এক জনও বাঙালি খেলোয়াড় স্থান পাননি। স্বভাবতই একদা ভারতীয় ফুটবলের পীঠস্থান বলে পরিচিত কলকাতা ময়দানের এ-হেন করুণ পরিণতিতে বাংলার ফুটবল নানা দিক থেকে সমালোচিত হচ্ছিল। ফলে এ বার সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার এই জয় এবং পুরো ২০২৪ সাল জুড়ে ভারতীয় ফুটবলে বাংলার ফুটবল দলগুলির নিরঙ্কুশ দাপট (সুপার কাপ— বিজয়ী ইস্টবেঙ্গল এফসি; আই লিগ— বিজয়ী মহমেডান এস সি; আইএসএল শিল্ড— বিজয়ী মোহনবাগান এস জি; আই লিগ ৩— বিজয়ী ডায়মন্ড হারবার এফ সি; সন্তোষ ট্রফি— বাংলা) নিঃসন্দেহে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করাবে।
বাংলার ফুটবলারদের এই সাফল্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য সরকারের তরফে ফুটবল দলকে ৫০ লক্ষ টাকা পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেন এবং বিজয়ী দলের প্রত্যেক ফুটবলারকে সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতিও দেন। সারা দেশে বেকারত্ব যে ভাবে বাড়ছে, সেখানে এই ধরনের চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলার যুব-সমাজকে শুধু ফুটবলই নয়, অন্যান্য খেলাধুলোর প্রতি আরও উৎসাহিত করবে। আগামী বছরগুলিতে বাঙালি খেলোয়াড়রা ভারতীয় ফুটবলে আগের মতো দাপটের সঙ্গে স্থান করে নিতে পারবে, এটাই আমাদের মতো ফুটবলপ্রেমীদের আশা।
অমিত কুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫
সুযোগ চাই
বাংলার সন্তোষ ট্রফি জয়ের খবরটি যথেষ্ট আনন্দদায়ক হলেও বিস্ময়কর নয় যে-হেতু বাংলার ফুটবল ঐতিহ্য ও সাফল্য বহু দশকের। কিন্তু কোটি টাকার প্রশ্ন এটাই যে, জাতীয় ফুটবল বৃত্তে চ্যাম্পিয়ন দলের কয়েক জন, এমনকি এক জন খেলোয়াড়কেও ভারতীয় জার্সি পরার যোগ্য বলে গণ্য করা হবে কি না। মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের মতো কলকাতা ময়দানের অভিজাত ক্লাবগুলির স্কোয়াডের সদস্য হিসাবেও কি তাঁদের মধ্যে কেউ বিবেচিত হবেন?
আমরা কি দেখতে পাব রবি হাঁসদা, অয়ন মণ্ডল, সুপ্রদীপ হাজরা, সৌরভ সামন্ত, জুয়েল মজুমদাররা তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য তাঁদের নিজেদের দেশে, এমনকি নিজেদের রাজ্যেও পাচ্ছেন? অদ্ভুত ভাবে দেখা যাচ্ছে যে, এক দশক বা তারও বেশি সময় আগে থেকে বাঙালির ফুটবল দক্ষতা কেমন ‘রহস্যজনক ভাবে’ যেন ‘নিশ্চিহ্ন’ হয়ে গেল। কলকাতা ময়দানের ভূমিপুত্র প্রতিভাবান বাঙালি ফুটবলারদের ব্রাত্য করে দেশ ও বিদেশ থেকে খেলোয়াড়দের মোটা অঙ্কের বিনিময়ে আমদানি করে এখন নিজেদের ধন্য মনে করছি আমরা। অথচ মাত্র চার দশক আগেও, ভারতীয় জাতীয় দলে ১৮ জনের মধ্যে অন্তত ১০ জন বাঙালি ফুটবলার দাপিয়ে ফুটবল খেলতেন, যার অন্যতম উদাহরণ ১৯৮২-র এশিয়ান গেমস।
কলকাতা ময়দানের ক্লাবগুলির প্রধান কর্তব্য হল দলে ভূমিপুত্রদের অগ্রাধিকার দেওয়া এবং উজ্জ্বল কেরিয়ার গড়ে তোলার জন্য যথাযোগ্য সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের সাহায্য করা। আর জাতীয় নির্বাচকমণ্ডলীরও উচিত পক্ষপাত-প্রাদেশিকতার অবসান ঘটিয়ে নিরপেক্ষ হওয়া এবং বাংলার যোগ্য প্রতিভাবান ফুটবলারদের ভারতীয় দলে সুযোগ করে দেওয়া।
কাজল চট্টোপাধ্যায়, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
আশা-নিরাশা
বাবার আচমকা মৃত্যুর পরে তাঁর মনে হয়েছিল, এ বার ফুটবলটাই ছেড়ে দিতে হবে। অথচ ফুটবল তাঁর ধ্যান জ্ঞান, জীবন মরণ। কিন্তু সংসারের জোয়াল টানবে কে? এত দিন বাবার কাঁধেই ছিল সব। তিনি খেলার অবসরে সাহায্য করতেন মাত্র। ভাগ্যিস মাস ছয়েক আগে রবি হাঁসদা খেলা ছেড়ে বাবার টোটো নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েননি বা মায়ের সঙ্গে খেতমজুরির কাজে নেমে পড়েননি। আর সে জন্যই আজ তিনি বাংলা ফুটবলের মহানায়ক। তাঁর একমাত্র গোলেই বাংলা এ বার সন্তোষ ট্রফি জিতল। সেই ২০১৬-১৭ বর্ষে শেষ ট্রফি জয়। তার পর শুধুই ব্যর্থতা। মাঝে দু’বার ফাইনালে উঠেও কেরল কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছিল বাংলা। এ বারেও সামনে ছিল সেই দল। তবে কি অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এ বারেও— আশঙ্কায় ছিলেন বাঙালি ফুটবলপ্রেমীরা। তবে রবির গোলেই শেষ পর্যন্ত ঝলসে গেল কেরল। টুর্নামেন্টে রবি একাই ১২টা গোল করে পেলেন শ্রেষ্ঠ গোলদাতার খেতাব। সেই সঙ্গে ভাঙলেন কিংবদন্তি ফুটবলার মহম্মদ হাবিবের নজিরও। বর্ধমানের মঙ্গলকোট থানার অন্তর্গত মশারু গ্রামের আদিবাসী পরিবারের ছেলে রবির সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তাঁর পরিবারের কেউই ফুটবল খেলেননি। শুধু ভালবাসা আর অদম্য জেদের জোরেই তাঁর ফুটবলার হয়ে ওঠা। জনাইয়ের ফুটবল কর্তা অসিত রায়ের হাত ধরে কলকাতা লিগে কাশীপুর সরস্বতী ক্লাবে সই করেন রবি। সেখান থেকে রেনবো ঘুরে কাস্টমসের হয়ে খেলে জাতীয় গেমসে বাংলা টিমে ডাক পান। তার পরে সন্তোষ ট্রফির বাছাই পর্বে খেলতে গিয়ে ২০২৩ সালের শুরুতে হাঁটুতে চোট পেয়ে পুরো বছরটা তাঁকে মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়েছিল। রবির রোজগার ছিল ‘খেপ’ খেলা। চোট পেয়ে সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ সময়ে কাস্টমস ক্লাবের কর্তারাই তাঁর পাশে দাঁড়ান।
এ বছর ফিরে আসার লড়াই করার সময়ই বাবার আচমকা মৃত্যু। তবু কাস্টমস ক্লাবের কর্তাদের চেষ্টাতেই মাঠে ফেরেন। কলকাতা লিগে ৯ গোল করার পরে এ বার সন্তোষ ট্রফির ম্যাজিক। সুনীল ছেত্রীর ভক্ত রবির সামনে দু’টি লক্ষ্য ছিল। সন্তোষ ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে একটা যে কোনও চাকরি। যাতে মা, স্ত্রী আর দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে খেয়ে পরে বাঁচতে পারেন। দুই, কোনও আইএসএল দলে সুযোগ পেয়ে নিজেকে সফল স্ট্রাইকার হিসেবে প্রমাণ করা। আর সেটা পারলে তাঁর জীবনের স্বপ্ন জাতীয় টিমের দরজাটাও তাঁর সামনে খুলে যাবে।
সন্তোষ ট্রফি জয়ে আনন্দে উদ্বেল বাংলার ফুটবল ভক্তরা। কিন্তু সত্যিই কি সময়টা আনন্দের না লজ্জার? কারণ ভারতের জাতীয় দলে, আইএসএল-এ বাঙালি কই? তবে এটাও প্রশ্ন, এখানে ফুটবলার তৈরির তেমন উদ্যোগ, উপযুক্ত পরিবেশ-পরিকাঠামোও আছে কি? রবি হাঁসদা-র মতো কয়েক জন তরুণের কাঁধে বাংলার ফুটবল। কিন্তু তাঁরাই বা আর কত দিন পারবেন আমাদের এই লজ্জা ঢাকতে?
সুব্রত দত্ত, দুর্গাগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy