এক সময়ের সর্বদা ব্যস্ত পুণের রাস্তা এখন সুনসান।
আমার জন্ম এবং বড় হওয়া ঘাটাল মহকুমার দাসপুরের নিকটবর্তী এক প্রত্যন্ত গ্রাম গোপালনগরে। শীলাবতী নদীর ওপারে হওয়ায় বন্যাপ্রবণ এবং দুর্গম। প্রত্যেক বছর বন্যার সময় এক থেকে দুই সপ্তাহ জলবন্দি হয়ে থাকাই ছিল আমাদের বাৎসরিক রুটিন। তাই 'লকডাউন'-এর অভিজ্ঞতা আমার কাছে নতুন নয়।
১৫ বছর হল পু্ণে শহরের বাসিন্দা আমি। এই শহরের কৈশোর অবস্থা থেকে যৌবনে পদার্পণের সাক্ষী আমি। পাহাড় ঘেরা সবুজ ও শান্তিপূর্ণ, বেশ ছিমছাম ছোট্ট শহর ছিল পুণে। প্রথম দিকে মানুষজনের ভিড় ছিল বাঁধাধরা সীমার মধ্যে। নতুন নতুন রাস্তাঘাট, জনপদ তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের আগমন ও থিতু হওয়ার দরুন সেই ছোট্ট পুণে আজ যেন এক মহানগর।
আমাদের ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে হিঞ্জাওয়াড়ি এলাকাটা দেখা যায়। ইনফোসিস, উইপ্রো , টেক-মাহিন্দ্রা, টিসিএসের মতো বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার অফিস এই এলাকায়। গত ১০ বছর ধরে অফিসযাত্রীদের আনাগোনায়, সকাল, সন্ধ্যা এবং রাত্রেও এলাকাটা গমগম করে। বাস্তবিকই অফিসটাইমে রাস্তা পারাপার কঠিন হয়ে পড়ে। গ্রাম থেকে বাবা মা এলে ভয়ে থাকতাম, পাছে রাস্তা পারাপার করার সময় বিপদ না ঘটিয়ে বসে। আজ ১৫ দিন হল সেই সমস্ত রাস্তাই সুনসান। দেখে মনে হচ্ছে, পুরনো পুণে ফিরে পেয়েছি। করোনা যেন কালা জাদু। সমস্ত মানুষজনকে যেন ভ্যানিশ করে দিয়েছে। রুপকথার গল্পে যেমন হয়।
আমার অফিস পাষাণ নামক এলাকায় অবস্থিত। পু্ণে ইউনিভার্সিটি, ন্যশন্যাল কেমিক্যাল ল্যবরেটরি, আই আই এস ই আর, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেট্রোলজি, ডিআরডিও, সি-মেট এবং ন্যাশান্যাল-ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজির মতো অনেক কেন্দ্রীয় সংস্থার অফিস এই পাষাণ এলাকাতেই। কিন্তু এখন ওই অফিসপাড়ায় ভয় মেশানো অকাল ছুটির মেজাজ। ১৯ মার্চ শেষ বার অফিস গিয়েছিলাম। তখনই একটা আভাস ছিল, কী হতে চলেছে। প্রায় ২১ দিন হল আমরা ঘরবন্দি। বাড়ির কাজের লোক সবেতন ছুটি নিয়ে নিজের নিজের গ্রামে ফিরে গিয়েছে। এ ভাবেই শহরটা প্রায় অর্ধেক খালি। পরশু স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে চেকআপের জন্য গিয়ে দেখলাম, পরিচিত ব্যস্ততা উধাও। একমাত্র জরুরি বিভাগের রোগী ছাড়া প্রায় কেউ নেই হাসপাতালে। সবাই পরস্পরকে শঙ্কিত দৃষ্টিতে জরিপ করছে। দুরত্ব বজায় রেখে চলছে। ভারতের মত জনবহুল দেশে এ এক অজানা অনুভুতি।
অফিসের কাজকর্ম সব বাড়ি থেকেই করছি। কাজের সময়টা ব্যস্ততাতেই কাটে। কিন্তু এ এক নতুন জীবনশৈলী, যেখানে পরিচিতরাও পরস্পরকে এড়িয়ে চলছে। মাল্টিপার্সন হোয়াটসঅ্যাপ কল আজকে দৈনন্দিন ব্যাপার। বাড়ির সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস অনলাইনে অথবা ফোনে অর্ডার করে আনিয়ে নিচ্ছে মানুষ। আমার মেয়ের স্কুলও এখন ডিজিটাল। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখলাম, ও এবং ওর শিক্ষিকারা বেশ সড়গড় হয়ে গিয়েছেন অনলাইন ক্লাসে। নোটবন্দির পর থেকেই কাগুজে নোটে যৎসামান্য লেনদেন করতাম। এখন তো স্পর্শবিহীন লেনদেন আবশ্যিক হয়ে পড়েছে।
গরিব মানুষ প্রগাঢ় পারস্পরিক সামাজিক নির্ভরশীলতায় জীবনযাপন করেন। করোনা মহামারি সেই নির্ভরতার বন্ধনকেই সন্দেহ ও ভয়ের মোড়কে মুড়ে ফেলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই মহামারি প্রাণহানির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক বন্ধনকেও এলোমেলো করে দিয়ে যাবে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমাজের আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষই।
এই শহরেই সোয়াইন-ফ্লুয়ের তাণ্ডব দেখেছি এবং বুঝেছি প্রকৃতির কাছে কত অসহায় আমরা। এমন কঠিন সময়ে, জীবনের সাধারণ নিয়মেই, জীবন নতুন রাস্তা খুঁজে নেয়। সমাধানের নতুন নতুন উপায় তৈরি হয়। করোনার পর পৃথিবী অনেকটাই আলাদা হবে। ঠিক তেমনই আলাদা হবে করোনা-পরবর্তী পুণে শহরও। প্রার্থনা করছি, সেই নতুন ভোর যেন তাড়াতাড়ি দেখতে পাই, যেখানে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি অনেক বেশি মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে বিরাজমান থাকবে।
সমৃত মাইতি
হিঞ্জেওয়াড়ি (পুণে), মহারাষ্ট্র
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy