Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
কেমন করে অদৃশ্য হয়
Migrant Workers

অতিথি শ্রমিকের আবাস নিয়ে উদাসীন কলকাতা

কলকাতায় অন্তত দু’লক্ষ মজুর আসেন অন্য রাজ্য, অন্য জেলা থেকে।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

চলমান, অশরীরী। এই ভাবেই পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিচয় দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক। একটি পুজোসংখ্যায় তিনি লিখছেন, তাঁরা সর্বত্র আছেন কিন্তু আমরা দেখেও দেখি না, তাই ‘অশরীরী’। আবার তাঁরা চলমান— ‘‘শ্রম হল এমন এক সম্পদ যা নিজের ইচ্ছায় নিজের তাগিদে পায়ে হেঁটে আসে, দিবারাত অনলস পরিশ্রমে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে।’’ তাঁদের প্রয়োজনটা অনুভব করি বটে, কিন্তু সে যেন আলো বা হাওয়ার মতো— বন্ধ না-হওয়া পর্যন্ত খেয়ালই থাকে না যে আছে।

সত্যিই তাই। না হলে অতিমারির জনশূন্যতায় ওঁদের পথে হাঁটতে দেখে আমরা ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠলাম কেন? উন্নয়নের উল্টোবাগে পা, সার দিয়ে হেঁটে গেলেও সরকারি পরিকল্পনায়, রাজনীতির কর্মসূচিতে ছায়া পড়ে না, কী সাঙ্ঘাতিক! কারা এঁরা? আনলক পর্বে এঁরা ফের মিলিয়ে গেছেন, কিন্তু ভূত দেখার শকটা যাচ্ছে না। কলকাতার মণ্ডপে ত্রিনয়নী রূপে এলেন পরিযায়ী মজুর মা।

এই কলকাতায় অন্তত দু’লক্ষ মজুর আসেন অন্য রাজ্য, অন্য জেলা থেকে। যেমন রশিদা বিবি (৪৬) আসতেন ঘুটিয়ারি শরিফ থেকে। লকডাউন শুরু হতে কারখানাতেই থেকে গেলেন। রাতের ঘুম মোষের চামড়ার গাদার উপর। ট্যান-করা চামড়ার অন্তিম প্রসেসিং-এর কাজ চলে, সেই দুর্গন্ধের মধ্যেই জনা পঞ্চাশেক মহিলাকর্মীর রান্না-খাওয়া। এমনই কয়েক লক্ষ অতিথি শ্রমিকের বাসস্থান মেটিয়াবুরুজের কাপড় কারখানার কুঠুরি, নির্মীয়মাণ বাড়ি, সড়ক মেরামতের সরঞ্জাম রাখার তাঁবু। পিচের ড্রাম, ঢালাই মেশিন, সেলাই মেশিনের পাশে, বাস-ট্রাকের সিটে থাকে ছায়া ছায়া দেহ।

কাজের জায়গায় বসবাস ‘অদৃশ্যায়ন’-এর একটি উপায়। যন্ত্রপাতির মতো, কাজেরই উপকরণ যেন। যাঁদের শুধু দেহটাই উপকরণ, যেমন বড়বাজারের কুলিরা, তাঁরা থাকেন খোলা ফুটপাতে। দারভাঙা থেকে আসা মানুষগুলোর ত্রিশ-চল্লিশ বছরের বসবাস কলকাতার পথে। ভাইরাসের ভয়ে ক’দিন ‘সেফ হাউস’-এ পোরা ছাড়া ভিন্‌রাজ্যের শ্রমিকদের আবাসন নিয়ে মাথা ঘামায়নি সরকার।

সরকারের চোখে কাজের খোঁজে আসা মজুরেরা ভরহীন বস্তু, জ্যামিতির বিন্দুর মতো। ভারতের অধিকাংশ শহর তার ৮০ শতাংশ দরিদ্রের থাকার জন্য জমির ১-২ শতাংশ বরাদ্দ করেছে। ‘প্ল্যানড সিটি’ বিধাননগরের দিকেই দেখা যাক। আজ যেটা ওকাকুরা ভবনের কাছে এক নম্বর বস্তি, এক সময়ে সেটা ছিল সিটি সেন্টারের জমিতে। মিনতি সুব্বা সেখানেই থাকতেন। এখন এক নম্বর বস্তিতে থাকেন, কাজ করতে যান সিটি সেন্টারে। সাফাইয়ের ডিউটি সেরে ঝলমলে মল থেকে ঘরে ফিরে জ্বালেন সোলার ল্যাম্প। সল্টলেকে সোলার ল্যাম্প? হ্যাঁ, কারণ বিদ্যুতের লাইন নেই। এই ‘প্ল্যানড সিটি’-র ৭৪টি ব্লকে ছড়িয়ে থাকা বস্তির হাজার দশেক মানুষ এ ভাবেই বাঁচেন। শিশুরা পড়ে সোলার কিংবা কেরোসিনের বাতি জ্বেলে। ফোনের টর্চের আলোয় মায়েরা রান্না করেন, পাড়ার দোকানে ১০ টাকা দিয়ে মোবাইল চার্জ করান। পানীয় জলের কল এক কিলোমিটারেরও বেশি দূরে।

তবে বিধাননগরের অটো, ভ্যান, রিকশাচালক, দোকান-বাজারের কর্মী, গৃহপরিচারিকা অধিকাংশই আসেন কেষ্টপুর, বাগজোলা আর নিউ টাউনের খালপাড়ের বস্তি থেকে। তাঁরা কেউ নেতাকে ধরে ভোটার কার্ড পেয়েছেন, কেউ ‘জমি কিনেছেন’ (কাগজ নেই, পার্টিকে টাকা দিয়েছেন)। অবৈধতা আর বৈধতার মধ্যে নানা স্তরে বাস করছেন। ‘বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটি’ দীর্ঘ দিন জল-বিদ্যুৎ-শৌচাগারের জন্য নেতাদের সঙ্গে দাবি-দরদস্তুরের পালা চালাচ্ছে। আমপানে ঘর ভাঙার পর ক্ষতিপূরণ চাইতে গেলে কাউন্সিলর নাকি বলেছেন, বিধাননগরে কোনও বস্তি নেই।

শেষ অবধি ঘর পিছু পাঁচ হাজার টাকা আদায় হয়েছে, যদিও সরকারের ঘোষিত ক্ষতিপূরণ ছিল কুড়ি হাজার টাকা। না-বাসিন্দার সিকিপ্রাপ্তি। আবার শূন্যপ্রাপ্তিও হয়। টালা ব্রিজ মেরামতের জন্য যাঁদের বাড়ি ভেঙেছিল, তাঁরা আজ বছরখানেক বাস করছেন ফুটপাতে বা খালপাড়ে, কালো পলিথিনের নীচে। পানীয় জলের জন্য দরবার করতে গেলে নেতার সাঙ্গোপাঙ্গরা শুনিয়েছেন, এলাকায় থাকতে দেওয়া হচ্ছে, এই অনেক। দাবি আবার কী?

বিধাননগরের প্ল্যানিং যাঁরা করেছিলেন, কেন তাঁরা খেটে-খাওয়াদের বসবাসের জায়গা রাখেননি? আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যান্ড্রু রামবাক লিখছেন, এই প্রশ্নের উত্তরে প্ল্যানকর্তারা বলেছিলেন, ‘বস্তি’ থাকলে সল্টলেকের জমি-বাড়ির দাম কমে যাওয়ার ভয় ছিল।

যাঁরা প্লট পেয়েছেন, তাঁদের অনেকে লিজ় হস্তান্তর করেছেন পরিবারের বাইরে, যা বিধাননগরে অবৈধ। তাঁরাই অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করতে অনবরত দরবার করছেন। পরিচ্ছন্ন এলাকা চান তাঁরা। বাড়িতে যিনি রান্না করেন, তাঁর জায়গা হয় না খাবার টেবিলে। শহর গড়ে, সচল রাখেন যে শ্রমিক, তাঁর জায়গা হয় না শহরে। এতে কোনও দোষ কেউ দেখতে পান না। এ-ও এক রকম অ্যাপারথেড।

চিন তার দেশের মধ্যেই এক রকম পাসপোর্ট প্রথা (হুকোউ) তৈরি করেছে। গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস করার ছাড়পত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। ভারত বাধানিষেধ আরোপ করার কোনও নীতি তৈরি করেনি। কিন্তু ভোটার কার্ড-রেশন কার্ড না দিয়ে মজুরকে ‘অবৈধ’ করে রাখে। শহর পরিকল্পনায় স্থান না দিয়ে অদৃশ্য করে রাখে। এ কেবল অবহেলা নয়, এ হল পরিকল্পিত নীতিহীনতা। এর ফলে শিল্পের সুলভ, শর্তহীন শ্রম, এবং রাজনৈতিক নেতার সুলভ, শর্তহীন সমর্থন, দুটোই নিশ্চিত হয়।

অবৈধতার মাসুল দিতে পরিযায়ী শ্রমিক বিদ্যুৎ-জল-ঘরভাড়ার জন্য সাধ্যাতিরিক্ত খরচ করে। যাদবপুর রেল স্টেশনের ধারের বস্তিতে বিদ্যুতের একটা লাইন টানা হয়েছে পাশের বাজার কমিটির অফিস থেকে। ঘর-প্রতি মাসে পড়ে ১০০০-১৩০০ টাকা, দু’টি আলো, দু’টি পাখা চালানোর জন্য। আবার বাজার কমিটির মিটারে বাড়তি ইউনিট উঠলে তার টাকাও দিতে হয়। বেলেঘাটা খালপাড়ে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বৈধ বস্তির চাইতে অবৈধ বস্তিতে শিশুশ্রম বেশি, কারণ সেখানে প্রায় সব মেয়েকে রোজগারে বেরোতে হয়। বৈধ বস্তিতে (বৈধ ঠিকানার জন্যই) এলপিজি-র প্রচলন যথেষ্ট। অবৈধ ঝুপড়িতে উনুন জ্বলে কাঠ দিয়ে, ধোঁয়ায় গোটা বস্তিটা ভূতুড়ে হয়ে যায়।

আর যে মেয়েরা অবৈধ বস্তিতেও ঠাঁই পাননি? ক্যানিং, লক্ষ্মীকান্তপুরের গ্রাম থেকে তাঁরা কাজে আসেন কলকাতায়। এ রাজ্যে মেয়েদের সবচেয়ে বড় নিয়োগক্ষেত্র, গৃহপরিচারিকার কাজ। ট্রেন ফের চালু হয়েছে। গ্রাম থেকে হেঁটে এসে ভ্যান রিকশায় স্টেশন, ট্রেন থেকে নেমে ফের হেঁটে কাজের বাড়ি। তেমন করেই ফেরা। ওঁদের এক বছরের হাঁটা জুড়লে দিল্লি থেকে কলকাতা আসা যায়। রিয়েল এস্টেট-এর দাম চড়া রাখতে মানবসম্পদের এই অবমূল্যায়ন। রাষ্ট্রের চোখে যাঁরা কেউ নন, আলো ফোটার আগেই শীতের কুয়াশা-ভরা পথে হনহনিয়ে হাঁটেন তাঁরা। যেন চলমান অশরীরী।

অন্য বিষয়গুলি:

Migrant Workers Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy