Advertisement
৩১ জানুয়ারি ২০২৫
প্রবন্ধ ২

কলকাতা কি অন্য পথে হাঁটতে পারত না

১৯৯৭ সালে মুম্বইয়ে চলচ্চিত্র-জগতের চাঁইরা মিলে একটা সংস্থা তৈরি করেছিলেন, মুম্বই অ্যাকাডেমি অব মুভিং ইমেজ, বা সংক্ষেপে মামি। তাঁদের এক বার্ষিক প্রকল্প মামি মুম্বই ফিল্ম ফেস্টিভাল।

সোমেশ্বর ভৌমিক
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

১৯৯৭ সালে মুম্বইয়ে চলচ্চিত্র-জগতের চাঁইরা মিলে একটা সংস্থা তৈরি করেছিলেন, মুম্বই অ্যাকাডেমি অব মুভিং ইমেজ, বা সংক্ষেপে মামি। তাঁদের এক বার্ষিক প্রকল্প মামি মুম্বই ফিল্ম ফেস্টিভাল। এ বছরের উৎসব শুরুর কয়েক দিন আগে কর্তৃপক্ষ জানালেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ আমন্ত্রিত একটি ছবি জাগো হুয়া সবেরা-কে (পাশে ছবির একটি দৃশ্য) উৎসব থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হল। ১৯৫৯ সালে নির্মিত ছবিটি পাকিস্তানি। এই ঘোষণার ঠিক আগেই ঘটে গেছে কাশ্মীরের উরিতে পাক জঙ্গিদের হামলা এবং বদলাস্বরূপ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’। চলচ্চিত্র-প্রদর্শকরাও অতঃপর বলেছেন, মুম্বইয়ের যে সব ছবিতে পাকিস্তানি শিল্পী কাজ করেছেন, তাঁদের ছবি তাঁরা দেখাবেন না। দেখাদেখি মামি-র উদ্যোক্তারাও নিজেদের মতো একটা সার্জিকাল স্ট্রাইক করে দেখালেন। যাঁরা এই উৎসবের কর্ণধার, মূলত চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক আর অভিনেতা, তাঁরা মুখ খোলারও ঝুঁকি নিলেন না। আর, কিছু দিন পরে এঁদেরই একটি দল মহারাষ্ট্র সরকারের মধ্যস্থতায় প্রদর্শকদের কাছে মুচলেকা দিয়ে এলেন। সেই মুচলেকার প্রথম কথা, যে সব ছবিতে পাকিস্তানি শিল্পীরা কাজ করেছেন, সে সব ছবির মুক্তির জন্যে ছবিপিছু পাঁচ কোটি টাকা তাঁরা সেনাবাহিনীর ত্রাণ তহবিলে দেবেন, পাকিস্তানি হামলায় নিহত জওয়ানদের পরিবারের জন্যে। তা ছাড়া, ভবিষ্যতে পাকিস্তানি শিল্পীদের তাঁরা ছবিতে নেবেন না। সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য তাঁদের এই মহৎ দান প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়েছেন নিহত জওয়ানদের আত্মীয়কুল।

মামি-র কেউকেটাদের না-হয় উপায় নেই উদ্যোক্তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধাচরণ করার। কিন্তু জাগো হুয়া সবেরা-র এই অন্যায় অপসারণ নিয়ে মুম্বইয়ের বাইরেও চলচ্চিত্র-জগতে প্রতিবাদ হল কই? আমাদের এই সর্ববিষয়ে প্রতিবাদমুখর কলকাতাতেও কোনও সভা, ধরনা বা মোমবাতি মিছিলের খবর নেই। এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। পাকিস্তানি ছবি হলেও জাগো হুয়া সবেরা-র সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য যোগ আছে। এ ছবির উৎস মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝি। ছবির অভিনেতাদের সবাই মূলত বাঙালি। এক জন ছাড়া তাঁদের সকলেই অবশ্য অপেশাদার, কয়েক জন শখের মঞ্চাভিনেতা, অন্যান্যরা সাধারণ মানুষ, চরিত্রের প্রয়োজনে ক্যামেরার সামনে তাঁদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। একমাত্র পেশাদার অভিনেতার নাম তৃপ্তি মিত্র। এ ছবির সুরকার তিমির বরণ। ছবির শুটিং হয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকার কাছে মেঘনা নদীর তীরে। তবে হ্যাঁ, এ ছবির প্রযোজক (নুমান তাসির) আর পরিচালক (এ জে কারদার) দু’জনেই পাকিস্তানি। এবং ছবির চিত্রনাট্যকার প্রসিদ্ধ উর্দু কবি ফয়েজ আহ্‌মদ ফয়েজ।

গড়পড়তা বিনোদনমূলক কোনও প্রকল্প ছিল না এটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিমানবাহিনীর পাইলট হিসেবে কাজ করা এ জে কারদার যুদ্ধের পরে অবসর নিয়ে ব্রিটেনে চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে (পাকিস্তানে) ফিরে সুযোগ খুঁজছিলেন একটি ছবি বানানোর। প্রশিক্ষণ-পর্বে ইতালীয় নব বাস্তবতাবাদী ধারার চলচ্চিত্র এবং সেগুলি তৈরির বিবরণ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মনে রাখতে হবে, প্রায় একই সময়ে সত্যজিৎ রায়ও লন্ডনে বসে নব বাস্তবতাবাদী চলচ্চিত্র দেখে এবং সেগুলি তৈরি করার ইতিহাস জেনে স্থির করছেন ছবি করলে এ ভাবেই করবেন।

দেশে ফিরে সত্যজিৎ এক নতুন আদর্শে ভর করে শুরু করলেন পথের পাঁচালী বানানো। তার পর অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে সে ছবি বিশ্বজয় করল। কারদারের জাগো হুয়া সবেরা-র কাজ শুরু হয়েছিল অল্প কিছু দিন পরেই। পথের পাঁচালী-র মতো এ ছবির গঠনও প্রথাসিদ্ধ আখ্যানমূলক ধারার অনুসারী নয়। কিন্তু পথের পাঁচালী-তে যেটুকু নাটকীয়তা আছে, এ ছবিতে তা-ও নেই। এখানে আখ্যানের বুনোট খুবই আলগা। তার বদলে আছে শুধু নদী-তীরবর্তী মৎস্যজীবীদের জীবন আর জীবিকার সরল উপস্থাপন। এই উপস্থাপনা গড়পড়তা দর্শকের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বহু যোজন দূরের বস্তু। তা ছাড়া মানিকের উপন্যাসের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের মনেও মূল সাহিত্যের এই নিরাভরণ অনুবাদ খুব দাগ কাটেনি। তা ছাড়া, চিত্রনাট্যকার নিজে শক্তিশালী কবি হলেও ভিন্‌ ভাষার উপন্যাস থেকে চিত্রনাট্য তৈরির সময় কতটা উপন্যাসের মর্মে পৌঁছতে পেরেছিলেন, সে প্রশ্নও মনে আসে।

ইংরেজ ক্যামেরাম্যান আর এডিটরের হাতে রূপায়িত হলেও বক্স অফিসে একেবারেই সফল হয়নি জাগো হুয়া সবেরা। পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি মাত্র সিনেমাহলে মুক্তি পাওয়ার পরে এক সপ্তাহও চলেনি। আর পশ্চিম পাকিস্তানে? ১৯৫৯ সালে সেখানে যখন এ ছবির মুক্তির তোড়জোড় চলছে, ঠিক তখনই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশৃঙ্খলা দমনের অজুহাতে জেনারেল আয়ুব খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রশাসনের দখল নিল। আর রীতিমত হুমকি দিয়ে জাগো হুয়া সবেরা-র মুক্তি বাতিল করা হল। এর পরই শুরু হল দেশজুড়ে বামপন্থী কর্মীদের ধরপাকড়। সেই দলে ছিলেন ফয়েজ আহ্‌মদ ফয়েজ-ও। অবশ্য বিদেশিদের কাছে ভালমানুষি দেখানোর জন্যে ১৯৬০ সালে ছবিটিকে পাঠানো হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অস্কারের বিদেশি ছবির প্রতিযোগিতায়। পাঠানো হয়েছিল মস্কো-র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। সেখানে একটি পুরস্কারও জুটেছিল।

কিন্তু তার পর প্রায় পাঁচ দশক এ ছবির কোনও খোঁজ ছিল না। ২০০৭ সালে নুমান তাসিরের পুত্র অঞ্জুম বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা প্রিন্ট থেকে প্রদর্শনযোগ্য একটি সংস্করণ তৈরি করেন। পরে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে তাকে আরও উন্নত করা হয়। গত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়, এমনকী নামকরা চলচ্চিত্র উৎসবেও দেখানো হয়েছে এই ছবি। ২০১২ সালে একটি প্রদর্শনী হয়েছিল কলকাতায়। এ বছরই কান চলচ্চিত্র উৎসবে ধ্রুপদী চলচ্চিত্র বিভাগে ঠাঁই পায় জাগো হুয়া সবেরা। সেখানে মুম্বই চলচ্চিত্রের বেশ কয়েক জন চাঁই গিয়ে এ ছবি বেছে এসেছিলেন। তারই জেরে ছবির মামি মুম্বই ফিল্ম ফেস্টিভাল–এ আগমন। কিন্তু সাতান্ন বছর পর ফের উপমহাদেশের সংকীর্ণ রাজনীতির বলি হল ছবিটি।

তবে দুটো ঘটনার মধ্যে একটু তফাত থেকে গেল। ১৯৫৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে এ-ছবির প্রদর্শন বন্ধ হয়েছিল সামরিক বাহিনীর হুমকির জেরে। ২০১৬ সালে মুম্বইয়ের এক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এ-ছবির প্রদর্শন বন্ধ হল উদ্যোক্তাদের ফতোয়ায়।

সামনেই কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। অন্তত প্রতিবাদস্বরূপ এই উৎসবে কি জায়গা দেওয়া যেত না জাগো হুয়া সবেরা-কে?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy