জম্মুর রাস্তায় মানুষ প্রতিবাদে মুখর হলে মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর কুর্সি বাঁচানো বড় কঠিন। শেখ আবদুল্লার মতো ব্যক্তিত্বও তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর পদ বাঁচাতে পারেননি। ১৯৫৩ সালে প্রজা পরিষদের বিদ্রোহে রাগী জম্মু তাঁকেও সরে যেতে বাধ্য করেছিল। ১৯৮৪ সালে যখন তাঁর পুত্র ফারুক আবদুল্লাকে জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে মানুষ সরিয়ে দিল তখন সে দিন প্রথম আগুন লেগেছিল এই জম্মুতেই। বিদ্রোহের আগুন। ২০০৮ সালে গুলাম নবি আজাদ বিদায় নিলেন। অমরনাথ জমি বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন তিনি। সেই আন্দোলনের গোড়াও ছিল জম্মুতে। পীরপঞ্জাল পর্বতশ্রেণি শ্রীনগর আর জম্মুর মধ্যে বিভাজনের রেখা টেনে দেয়। আর সাধারণ ভাবে আমাদের মনে হয়, হরতাল-ধর্মঘট-সন্ত্রাস সবই শ্রীনগর উপত্যকায়। আসলে কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েও জম্মু এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জম্মু আর কাশ্মীর দুই পৃথক এলাকা, তার মানে কি পৃথক ধর্মীয় মেরুকরণ, পৃথক জাতিসত্তা? তাও তো আমরা জম্মু-কাশ্মীর যখন একসঙ্গে উচ্চারণ করি, তখন লাদাখের কথা ভুলেই যাই।
জম্মুর কথায় ফিরে আসি। ১৮৪৬ থেকে ১৯৪৭, জম্মুর ডোগরার রাজাদের শাসনকাল এই দীর্ঘ সময়ে। শেখ আবদুল্লা যখন কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেন, তখন জম্মুর মানুষের ধারণা হয়, আসলে এই আন্দোলন ডোগরার হিন্দু রাজাদের সরানোর জন্য। জম্মুতে শতকরা ৬৪ ভাগ হিন্দু। চিনাও উপত্যকা এবং পীরপঞ্জাল পার্বত্যভূমি অবশ্য মুসলিম প্রধান। শতকরা ২৯ ভাগ মুসলিম, শতকরা ২৩ ভাগ ব্রাহ্মণ, ২০ ভাগ তফসিলি জাতি, ১২ ভাগ রাজপুত, ৭ ভাগ শিখ এবং অন্যান্যরা ৯ শতাংশ। মুফতি মহম্মদ সইদ যখন কংগ্রেস ও জাতীয় কনফারেন্সের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে সরকার গঠনের জন্য বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধলেন, তখন অনেকে প্রমাদ গুনেছিলেন। ২০১৫ সালে পিডিপি-বিজেপি জোটের সরকার গঠনের পর এক সাক্ষাৎকারে সইদ সাহেব বলেছিলেন, ‘‘আপনার মনে হচ্ছে তো উত্তর আর দক্ষিণ মেরু কী ভাবে মেলাব? কিন্তু এটাই কাশ্মীর রাজনীতির জন্য খুব ভাল। প্রয়োজনীয়।’’ বিজেপি কাশ্মীরি ও কাশ্মীরিয়তকে সম্মান জানানোর এক রাজনৈতিক সুযোগ পেয়েছিল। ২০১৪ সালে জম্মুতে বিজেপি দারুণ ফল দেখায়। এমনকী, ছিনাব উপত্যকাতেও বিজেপি ভাল ফল করে। কংগ্রেস ও জাতীয় কনফারেন্সের সঙ্গে বোঝাপড়া হলে জম্মুর ভোটারদের যথেষ্ট ক্ষমতায়ন হবে না বলে মুফতি ভেবেছিলেন। বরং তাতে জম্মুর মানুষ আরও বিচ্ছিন্ন হত। ২০১৫ সালে কাশ্মীরে পিডিপি এবং বিজেপির বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সইদ মুফতি সাহেবের এ যুক্তি শুনতে খুবই ভাল লেগেছিল। কিন্তু পাল্টা যুক্তি হল, রাজ্যে ধর্মনিরপেক্ষ অন্য দলগুলিকে পিডিপি সে দিন অক্সিজেন দিতে চায়নি।
কিন্তু এর পরিণতি কী হল? কাশ্মীর উপত্যকায় জঙ্গি কার্যকলাপ বাড়তে লাগল আর জম্মুতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতারও গগনভেদী রব শোনা যেতে লাগল। এ বার কাঠুয়ায় যে নাবালিকার উপর গণধর্ষণ হল, এখন দেখা যাচ্ছে, এ তো শুধু গণধর্ষণের ঘটনা নয়, এই গণধর্ষণকে ধর্মীয় মেরুকরণ, উপজাতি পরিচয়সত্তা এবং জম্মু বনাম কাশ্মীর রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। মেয়েটি গুজ্জর উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। কাশ্মীরে এই গুজ্জররা মূলত মুসলমান। গুজ্জর-বাকারওয়াল নোমাডিক উপজাতি।
ইন্ডিয়া গেটের সামনে কাঠুয়া ঘটনার প্রতিবাদ। ফাইল চিত্র পিটিআই।
অরণ্য অধিকার আইন ২০০৬ সালে সংসদে গৃহীত হয়। অদ্ভুত ব্যাপার, জম্মু-কাশ্মীরে আজও এটি বাস্তবায়িত হয়নি। এই নোমাডিক উপজাতি দুগ্ধ প্রদানকারী পশুদের পালন করে। গ্রীষ্মে তারা কাশ্মীরে চলে যায় আর শীতে জম্মুতে ফিরে আসে। মূলত অরণ্যেই থাকে তারা। কিন্তু অরণ্য আইন কার্যকর না হওয়ায় এই উপজাতিদের কোনও অধিকার এই অরণ্যের জমিতে নেই। গোটা রাজ্যের জনসংখ্যায় এই গুজ্জর তফসিলি মুসলমানরা আছে শতকরা ১১ ভাগ। অরণ্যের অধিকার আইন বাস্তবায়িত করার দাবিতে এই উপজাতি আন্দোলন চলছে অনেক দিন থেকেই। এখন এই গণধর্ষণের পর তারা, মানে এই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, এই ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মুসলিম-উপজাতি-দলিত বিরোধী। আবার জম্মুর হিন্দু সংগঠন, বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার বলতে শুরু করেছে, শ্রীনগর থেকে বহু মুসলিম জম্মুতে এসে বসবাস করতে শুরু করেছেন। এর মধ্যেও আছে গভীর ষড়যন্ত্র। জম্মুর জনসংখ্যার ধর্মীয় চরিত্র বদলানোর চেষ্টা হচ্ছে। তার মানে কাঠুয়ার ঘটনা জম্মু-কাশ্মীরে ধর্মীয় মেরুকরণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কংগ্রেস ও জাতীয় কনফারেন্সের মতো দলগুলিও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করতে গিয়ে জম্মুতে জম্মুর মতো, কাশ্মীরে কাশ্মীরের মতো আবরণ অনুসরণ করছে। কিন্তু সে তো আরও ভয়ঙ্কর।
আসলে জম্মু ও কাশ্মীরের এই বিবাদ ঘোচানো আজ খুব জরুরি। কার্গিল ও লেহ্-তে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর, দু’পক্ষকে নিয়ে এখনই যুগ্ম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা প্রয়োজন। এমনকী, অরণ্যবাসী উপজাতি তফসিলি মানুষের জন্য এ রকম পরিষদ প্রয়োজন। তা না হলে শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy