শাহ মীর কাশ্মীরের শাসক হন ১৩৩৯ সালে। তার পর উপত্যকার অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ষোড়শ শতাব্দীেকে নবিংশ শতক অবধি মুঘল ও আফগান দুররানি সম্রাটেরা শাসন করেন কাশ্মীর। ১৮১৯ সালের গোড়ায় রঞ্জিত সিংহ কাশ্মীর দখল করেন, তার পর ইংরেজ। পরে জম্মুর রাজা গুলাব সিংহ ব্রিটিশদের কাছে কাশ্মীর ক্রয় করেন এবং ১৯৪৭ পর্যন্ত তাঁর বংশধরেরা কাশ্মীরের শাসক ছিলেন। কাশ্মীর নিয়ে স্বাধীনতা (১৯৪৭) পরবর্তী ইতিহাস সকলেই জানেন।
দেশভাগ ও স্বাধীনতার পর থেকে শান্ত কাশ্মীরে অশান্তি লেগেই আছে। কাশ্মীরের রাজা ভারতভুক্তির পক্ষে মত দিয়েছিলেন, সেই হিসেবে কাশ্মীর ভারতের অঙ্গ। অন্য দিকে, পাকিস্তান চায় কাশ্মীর তাদের হোক। চিনও আক্রমণ শানায় মাঝেমধ্যে। কিন্তু সমস্যা হল, একটিই। এরা সকলেই কাশ্মীরি ভূখণ্ড চায়। কিন্তু কাশ্মীর কি শুধুই একটি ভূখণ্ড? কাশ্মীরি জনগণ ছাড়া কি কাশ্মীর হতে পারে? তাঁদের ভাল থাকা নেই? তাঁরা তো শান্তিতে থাকতে চান। সব সাধারণ মানুষের মতো চান বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সুখে শান্তিতে ঘরকন্না করতে। অশান্ত জীবনে না হয় কাজকর্ম, না হয় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা। একদা দর্শন ও সংস্কৃতির পীঠস্থান কাশ্মীর তাই আজ ধুঁকছে। অন্য রাষ্ট্র কাশ্মীরের ভূখণ্ডের উপর লোলুপ শকুনির দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে। কাশ্মীরিদের মৃতদেহের উপর তারা শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কাশ্মীরিদের বাদ দিয়ে কাশ্মীর বলে কিছু হতে পারে না, এই সত্যটা কাশ্মীরের শত্রু-মিত্র সবাইকেই বুঝতে হবে। জওয়ানেরা যেমন ভারতের, তেমনই কাশ্মীরিরাও ভারতের। যদি কাশ্মীরিদের মৃত্যু ভারতবাসীর কাছে দুঃখের ও শোকের না হয়, তবে জানতে হবে আমরা সচেতন ভাবে ওঁদের ভারতবাসী বলে মনে করি না এবং কাশ্মীরকেও ভারতের অঙ্গ বলে মনে করি না। আমাদের এই ভাবনার বদল দরকার। যদি আমরা দাবি করি, কাশ্মীর আমাদের, ভারতের অঙ্গ; তবে প্রথমে কাশ্মীরিদের ভারতীয় হিসাবে সুরক্ষা দিতে হবে। সুরক্ষা মানে সুস্থ জীবন।
পুলওয়ামার হামলায় ৪৯ জন জওয়ান নিহত হওয়ার পর দেশ জুড়ে কাশ্মীরিদের উপর বিক্ষিপ্ত হামলা হচ্ছে। যুক্তি কী? সেনার উপর হামলা হয়েছে। কারা করেছে? কাশ্মীরি, পাকিস্তানি, মুসলিম। অতএব, তুমি দায়ী। তুমি কে? তুমি কাশ্মীরি। তা হলে কি অজান্তে আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি, কাশ্মীরি ও কাশ্মীর ভূখণ্ড আমাদের নয়? জাতীয়তাবাদের ঠিকাদারদের দেশপ্রেমী হিসাবে এই প্রশ্ন করছি।
কলকাতার দক্ষিণে বাস করেন এক হৃদয়বিশেষজ্ঞ। তিনি কাশ্মীরি। কলকাতায় আছেন দু’দশকেরও বেশি সময়। নামী হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর চিকিৎসা পরিষেবা নেওয়ার সময় কোনও রোগীই বলেননি যে আপনি কাশ্মীরি অতএব আমার হৃদয়ের চিকিৎসা করবেন না। কিন্তু পুলওয়ামার ঘটনার পর ২০/৩০ জন যুবক, মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বেঁধে ডাক্তারকে হুমকি দিয়ে যায়, কলকাতায় থাকা যাবে না, কাশ্মীরে চলে যেতে হবে। প্রশ্ন করছি, কেন? ওই গেরুয়া ফেট্টিরা কি কলকাতাকে ভারত আর কাশ্মীরকে অন্য দেশ মনে করেন? নিশ্চয় করেন, না হলে এমন ফতোয়া তাঁরা দেন কী প্রকারে? গেরুয়া-ফেট্টির এই রাজনীতির নাম দেশদ্রোহিতা। চিকিৎসক ভয় পান না। কিন্তু ওঁরা আবার আসেন। প্রাতর্ভ্রমণে বেরোচ্ছেন তিনি, অমনি আবার ঘিরে ধরা হয় তাঁকে। এই বার ভয় পান তিনি, তড়িঘড়ি বাড়ি চলে আসেন। ফোন করেন বন্ধুদের। প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়। বন্ধুরা পাশে দাঁড়ায়। গেরুয়া ফেট্টিরা চলে যায়। এই ধাপগুলো জরুরি। প্রশাসনের এগিয়ে আসা, বন্ধুদের পাশে থাকা এবং তীব্র প্রতিবাদ জাগিয়ে রাখা। তর্কের পাশাপাশি দরকার প্রতিরোধ। এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশকে কঠোর ভাবে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। শুধু পুলিশ নয়, নাগরিকদের সচেতন থাকতে হবে অনেক বেশি। কারণ ভোট আসছে। রাজনীতি ভুলে সমস্ত অসাম্প্রদায়িক ও দেশপ্রেমিক মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে, ধর্মের নামে, উগ্রপন্থার নামে, বিভেদের নামে এই ভোটবাজির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ভীষণ প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের একটা আলাদা সুনাম আছে, তার ঐতিহ্য যেন কোনও ভাবে ধুলোয় গড়াগড়ি না খায়।
আর একটা জরুরি কথা। নিজেদের সন্তান, অল্পবয়সীদের এই সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের স্রোতে গা ভাসাতে দেখলে তাদের সচেতন করা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। মনে রাখতে হবে, আক্রান্ত যেমন বিপদের মধ্যে পড়ছেন, তেমনি এই অল্পবয়সীরাও সারা জীবনের জন্য বিপদ্গ্রস্থ হয়ে পড়ছেন। তাদের স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা, সুস্থ তর্ক করার মানসিকতা খুন হলে তারাও ভবিষ্যতে সুনাগরিক হতে পারবে না। স্কুলে যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বলে অন্য সহপাঠী তার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তা হলে দু’পক্ষই মানসিক সমস্যার শিকার হবেন আজীবন। এতে দেশের ক্ষতি। নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে এমন চিন্তা ও প্রতিরোধ অত্যন্ত জরুরি। ভাড়াটে গুন্ডারা আসবে, তাদের প্রতিহত করা সহজ নয়। তাই ভরসা থাকুক পুলিশ-প্রশাসনে। ভরসা থাকুক সাধারণ মানুষের প্রতিবেশি-প্রীতিতে—পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেতো দূরে/ সে আর লালন একখানে রয় মাঝে লক্ষ যোজন ফাঁক রে…।
বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের দর্শনের বিভাগীয় প্রধান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy