প্রতিবাদ: দার্জিলিঙে চা শ্রমিকদের মিছিল। ২ অক্টোবর। পাসাং ইয়োলমো
বড় জোর হাজার তিনেক টাকা, কপাল ভাল হলে হাজার চার-পাঁচ। চা বাগানের শ্রমিকের যা মজুরি, তাতে ন’শতাংশ বোনাস, আর কুড়ি শতাংশ বোনাসের মধ্যে ফারাক এর বেশি নয়। ওই ক’টা টাকার জন্যে বৃষ্টির মধ্যে আট কিলোমিটার হেঁটে ব্লক অফিসে ডেপুটেশন, অবরোধ, অনশন, চাক্কা জ্যাম, বন্ধ? তেমনই দেখা গেল উত্তরবঙ্গের চা বাগানে। চায়ের বিজ্ঞাপনে, পর্যটনের প্রচারে, বা সিনেমায় সবুজ বাগিচায় হাস্যময়ী যে মেয়েদের চা তুলতে দেখা যায়, ঘাম-অশ্রুর দুনিয়ায় তাঁরা দিনের পর দিন রোদে পুড়ে, জলে ভিজে শ্রম দফতরের অফিস ঘিরে বসেছিলেন শিলিগুড়িতে। কেন? প্রশ্ন শুনে চটে উঠলেন রত্না ওঁরাও। “সারা বছর কাজ আমরা করব, কিন্তু বোনাস নিয়ে মিটিংয়ে আমাদের ডাকবে না, আমাদের এক বার জিজ্ঞেসও করবে না। মন্ত্রীরাই সব ঠিক করবে। এর মানে কী?” চা মজুরদের প্রায় নব্বই শতাংশ মেয়ে, কিন্তু শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে মেয়েদের সংখ্যা খুবই কম। তারা পুরো বোনাস (বাৎসরিক মজুরির কুড়ি শতাংশ) দাবি করলে উল্টে শ্রমিক নেতারাই ধমকে দেন, “তোমরা কি চাও বাগানটা বন্ধ হোক?”
গত বছর উনিশ শতাংশ বোনাস মিলেছিল। খরার জেরে এ বছর তরাই, ডুয়ার্সের বাগানগুলি নামাতে চেয়েছিল ৮.৩৩ শতাংশে। মজুরেরা বেঁকে বসল। ঘর সারানো, ছেলেমেয়ের নতুন জামা, উৎসবের খরচ, সব কিছুর জন্য ভরসা ওই টাকাটুকু। অন্য বছর যেখানে দু’তিন বারের বৈঠকেই বোনাসের অঙ্ক স্থির হয়ে যায়, সেখানে এ বার মজুরদের জেদাজেদিতে সাত-আট বার বোনাস-বৈঠকে বসেছে বাগান কর্তৃপক্ষ আর শ্রম সংগঠনগুলি। শেষে রাজ্য সরকার ষোলো শতাংশ বোনাস ঘোষণা করে দেয় ১ অক্টোবর। কিন্তু পাহাড় তাতেও ক্ষুব্ধ, কুড়ি শতাংশের দাবিতে অনড়। স্থির হয়েছে, ৬ নভেম্বর কলকাতায় বৈঠক হবে। মেয়েরা যাতে না থাকতে পারে, তাই সরকার কলকাতায় বৈঠক ডেকেছে, এমনই সন্দেহ করছেন মেয়ে শ্রমিকরা।
“আমাদের বাগানের কর্মী ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি মেয়েরাই। কিন্তু মালিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে ইউনিয়নের নেতারা তাদের কখনও ডাকে না,” বললেন সুমন্তি এক্কা। বাগডোগরার কাছে একটি চা বাগানের কর্মী সুমন্তির ক্ষোভ, “ডেপুটেশনেও ডাকে না মেয়েদের, নিজেরা কথা বলে নেয় মালিকপক্ষের সঙ্গে।” এ বছরে চেনা ছক একটু ভেঙেছে। শ্রমিক ভবনের একটি বোনাস বৈঠকে বছর চল্লিশের চা শ্রমিক সঙ্গীতা ছেত্রী দাঁড়িয়ে বলেন, “শ্রমিকরা কাজ করে তার দাম পাবে না? নীচে এসে শ্রমিকদের অবস্থা দেখে যান।” কথা শেষ করেন ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে। তাঁর উত্তপ্ত ভাষণে সরকারি আধিকারিক ও মালিক পক্ষের অনেকে চটেছেন। “ওরা আমাকে বলছিল, তোমার বলার পারমিশন নেই। তুমি চুপচাপ বসো। কিন্তু মেয়েদের উপর পীড়নের কথা মেয়েরা না বললে কে বলবে?” বললেন সঙ্গীতা।
মেয়ে মজুরদের নালিশ অনেক। চা বাগানে সাপ, জোঁকের উৎপাত, অথচ শৌচাগার নেই। জ্বালানি, চা পাতা, ছাতা-চপ্পল দেওয়া বন্ধ হয়েছে। কোয়ার্টারও আর সারিয়ে দেয় না। রেশন দেওয়ার ভার নিয়েছে সরকার। কয়েকটি বাগানে ক্রেশ চালায় এনজিওরা। বাকি সুবিধাগুলো (স্বাস্থ্য ক্লিনিক, স্কুল বাসের ব্যবস্থা) প্রায় উঠেই গিয়েছে। মাতৃত্বের ছুটিতে কাটছাঁট চলছে। পাঁচশো টাকা তেলের খরচ না দিলে অ্যাম্বুল্যান্স আসে না। এ সব কথা বৈঠকে ওঠে না।
তবে মেয়েদের রাগ-দুঃখের মূল কারণ মজুরি। রোদে-বৃষ্টিতে দিনে আট ঘণ্টা কাজ করে, পঁচিশ কেজি পাতা তুলে, মেয়েদের পাওনা আড়াইশো টাকা। প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ তা থেকে দৈনিক ত্রিশ টাকা কেটে নেওয়া হয়। সেই টাকা প্রায়ই জমা পড়ে না। কার্শিয়াঙের একটি চা বাগানের শ্রমিক গীতা দেবী রাউত জানালেন, শুধু তাঁদের বাগানেই পনেরো কোটি টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ড বকেয়া। মাসে সাড়ে ছ’হাজার টাকা বেতনের দারিদ্র-ফাঁদ এড়াতে পুরনো শ্রমিকরা বাগান ছাড়ছেন। তাঁদের জায়গায় আনা হচ্ছে ‘বিঘা’ বা ভাউচার শ্রমিকদের। কেউ বলেন এখন বিঘা শ্রমিক অর্ধেক, কেউ বলেন তারও বেশি।
চা শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন স্থির করতে ২০১৫ সালে সরকার কমিটি বানিয়েছিল। আজ অবধি একটিও সুপারিশ প্রসব করেনি সেই কমিটি। পঞ্চদশ শ্রম সম্মেলনের (১৯৯২) সুপারিশ মানলে ন্যূনতম মজুরি দাঁড়াবে দৈনিক ৬০০ টাকারও বেশি। সে হিসাবে রোজ ৩৫০ টাকা মজুরি বকেয়া থাকছে এই মেয়েদের। কিন্তু ক্ষতি সামলে চা বাগানগুলো এত টাকা দেবে কোত্থেকে? শুনে ফুঁসে উঠলেন গীতা। “এক-এক জন রোজ একশো কেজি পাতা তুলে দিচ্ছি না? যখন যত তুলতে বলে, তত তুলে দিই। তা হলে বাগানে লস হয় কী করে?”
প্রশ্নটা যত সহজ, উত্তর ততই কঠিন। চট এবং চা, বাংলার দু’টি প্রধান শ্রমনিবিড় শিল্পেই শনির দশা। এর কতখানি বৃষ্টির অভাব আর কতখানি বিনিয়োগের, কতটা বাজারের ওঠাপড়া আর কতটা চটজলদি লাভের আশায় মালিকের কলকাঠি নাড়া, ঠাহর করবে কে? দুই শিল্পেই কাজ ছাড়ছেন কর্মীরা। ফার্স্ট ফ্লাশ পাতা তোলায় দক্ষ মেয়েরা শিলিগুড়ির শপিং মলের সিকিয়োরিটি গার্ড হচ্ছেন, চটকলের দক্ষ মেশিন মিস্ত্রিরা কেরলে দিনমজুরি করছেন। পড়ে থাকছে সেই মেয়েরা, যাঁরা বাড়ি ছেড়ে দূরে যেতে পারেন না। শিল্প কি সত্যিই কর্মীকে যথেষ্ট মজুরি দিতে অপারগ? না কি, কর্মীর অপারগতার সুযোগ নিচ্ছে কিছু শিল্প?
কেরলের মুন্নারের চা শ্রমিকরা এ প্রশ্নটা উস্কে দিয়েছিলেন। ২০১৫-য় সেখানকার এক বাগানের পাঁচ হাজার মেয়ে-শ্রমিক ধর্মঘট করেন, ২০ শতাংশ বোনাস আর বেতন বাড়ানোর দাবিতে। সেখানেও বাগান কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ে ক্ষতি দর্শিয়ে ১০ শতাংশের বেশি বোনাস দিতে রাজি হননি। মেয়েরা কাজ বন্ধ করেন, রাস্তা অবরোধ করেন। কোনও ট্রেড ইউনিয়ন বা রাজনৈতিক দলকে, এমনকি কোনও পুরুষকেই মেয়েরা আন্দোলনের কাছে ঘেঁষতে দেননি। শেষ অবধি কেরলের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডির মধ্যস্থতায় বোনাস বাড়ানোর দাবি মেনে নেন বাগান কর্তৃপক্ষ। তবে বেতনের দাবি নিয়ে টানাপড়েন এখনও চলছে— বর্তমানে মেয়েরা দাবি করছেন সাতশো টাকা, পাচ্ছেন ৪৭০ টাকার কাছাকাছি। তবু মুন্নারের আন্দোলন বহুচর্চিত, কারণ তা শ্রমিক আন্দোলনের এক নয়া নজির, যা শ্রেণিবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্য, দুয়েরই মোকাবিলা করতে চেয়েছিল। এই মেয়েরা নিজেদের ইউনিয়নও গঠন করেছেন।
অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তী বলেন, “যে কোনও শিল্পে মজুরি বাড়াতে চাইলে দর কষাকষির বিকল্প নেই। কিন্তু দর কষাকষির প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমশই শ্রমিকের প্রকৃত চাহিদা থেকে দূরে সরে গিয়েছে। আর এটি হয়েছে শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার জুজুর ভয় দেখিয়ে। সরকারের একটি কাজ এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে কার্যকর রাখা। এগুলি দুর্বল হতে দেওয়া শিল্পের পক্ষেও ভাল নয়।” উত্তরবঙ্গে এ বছর দেখা গেল, অরাজনৈতিক ইউনিয়ন গড়ে মেয়ে-শ্রমিকদের একাংশ নিজেরা কথা বলার চেষ্টা করছেন। জোট বেঁধে চাপ তৈরি করতে চাইছেন সব পক্ষের উপরে। তাঁদের প্রশ্ন, কাজ করব সবটা, টাকা সবটা পাব না কেন? রাজনীতি আর
প্রশাসনকে জবাব তো দিতেই হবে, উত্তর খুঁজতে হবে শিল্পকেও। শ্রমিক কি নিজেকে দরিদ্র রেখে শিল্পকে বাঁচাবেন? না কি শিল্পই শ্রমিকের দারিদ্র ঘুচিয়ে বাঁচাবে এই দেশকে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy