লড়াইয়ে হার-জিত থাকে। সবাই জানি। এটাও জানি, হেরোরা প্রচুর হ্যাটা হয় জেতা পার্টির কাছে। কিন্তু লড়াইয়ে হেরো আর জেতা পার্টি ছাড়া আরও একটি পক্ষ থাকে। তারা কোনও দলেই থাকে না। কিন্তু খামোকা চোট পেয়ে যায়। এদের চোটাঘাতের ব্যথা বর্ণনায় ইংরেজিতে একটি শব্দবন্ধ রয়েছে। ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’। অনিচ্ছাকৃত ক্ষয়ক্ষতি।
খুব জটিল হয়ে গেল বিষয়টি? উদাহরণ দিলে সহজ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম উদাহরণটা নীতিকথা থেকে দেওয়া যাক। সেই যে গল্পটা, দু’দল ছেলে পুকুরে ঢিল ছুড়ে আমোদে মেতেছিল। সেই পুকুরেই ছানাপোনা নিয়ে থাকত একটি ব্যাঙ। লাগাতার ঢিল ছোড়াছুড়িতে তাদের প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। এক সময়ে থাকতে না পেরে ব্যাঙ-মা হাজির ছেলেপুলেদের কাছে। জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে ব্যাঙ-মা জানাল, তোমাদের আনন্দ যেন অপরের দুর্দশার কারণ না হয়। ছেলেরা ঢিল ছোড়া বন্ধ করে লজ্জিত হয়ে ফিরে গিয়েছিল।
নীতিকথা শোনানো হল বলে কি গোসা হল? সত্যিই তো অযাচিত জ্ঞানদানের অভ্যাস মোটেও শোভনীয় নয়। তাহলে লৌকিক একটি ঘটনা শোনানো যাক। বাস্তব থেকে নেওয়া। এক প্রেমিক-প্রেমিকা। গিয়েছে কুঞ্জবিহারে। তবে সঙ্গে রয়েছে এক সুদামা। প্রেমিক-প্রেমিকার ‘কমন ফ্রেন্ড’। প্রেম তখন ‘যত রাগ তত অনুরাগ’ দশায়। দু’জনের রাগ হলে সামলায় সুদামা। যথারীতি রাগারাগি হল। কথাও বন্ধ হল। রাগ এবং রোম্যান্টিকতা একসঙ্গে প্রকাশের জন্য দু’জনেই সিদ্ধান্ত নিল, পিঠোপিঠি বসে পুকুরে ঢিল ছুড়বে। কিন্তু আশেপাশে অত ঢিল কোথায়? ঢিলের সন্ধানে যেতে হল সুদামাকে।
গল্প দু’টো মনে হল সাম্প্রতিক জয় যুক্ত নানা ধ্বনি ছোড়াছুড়িই রাজনৈতিক লড়াই দেখে। একদলের উল্লাস প্রকাশের লব্জ হল ‘জয় শ্রীরাম’। সেই জয়ধ্বনি আবার না-পসন্দ বিরোধী দলের। তাদের চেষ্টায় বাজারে এল আরও দু’টো জয়ধ্বনি, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় হিন্দ’। বিজেপি ঘোষণা করেছে, তারা ১০ লক্ষ পোস্টকার্ডে ‘জয় শ্রীরাম’ লিখে নবান্নে পাঠাবে। তার পাল্টা হিসেবে তৃণমূল ২০ লক্ষ পোস্টকার্ডে ‘জয় হিন্দ’ লিখে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতিকে পাঠাবার উদ্যোগ করেছে। ৩০ লক্ষের এই সংখ্যাতেই পোস্টকার্ড পড়েছে ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজে’র কবলে। এত পোস্টকার্ড তো ডাকঘরগুলিতে নেই! কিন্তু রাজনৈতিক দলের খেলাধুলো। বাচ্চারা স্কুলে খাতা ছিঁড়ে উড়োজাহাজ বানায়। তার পর ছুড়ে মারে সহপাঠীকে। এখানে পোস্টকার্ডের তির ছোড়াছুড়ি। পোস্টকার্ড ছোড়ার খেলায় মেতে ওঠা দল দু’টি আবার শাসক। একটি দল কেন্দ্রের। আরেকটি রাজ্যের। স্বাভাবিক ভাবেই চাহিদা পূরণে উদ্যোগী হতে হবে। উদ্যোগী হবে ডাক বিভাগই। নিয়ম অনুযায়ী, তাদেরই হতে হবে লৌকিক গল্পের সুদামা। সে ঢিল কুড়োতে গিয়েছিল। আর ডাক বিভাগকে যেতে হবে নাসিক সিকিয়োরিটি প্রিন্টিং প্রেসে। পোস্টকার্ড কুড়োতে। ওখানেই তো ছাপা হয় পোস্টকার্ড। এতদিনে সেখানে ‘রিক্যুইজিশন’ অথবা ‘অর্ডার স্লিপ’ জমা পড়ে গিয়েছে নিশ্চয়।
কিন্তু ঘটনা তো অন্য। পোস্টকার্ড মৃতপ্রায়। কেন মৃতপ্রায় তা আলোচনার আগে পোস্টকার্ডের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক। সময়ের ধারা মেনেই কাগজের নানা প্রকারভেদ আবিষ্কৃত হতে থাকে। বিশেষত চিঠি বা সংবাদ আদানপ্রদানের জন্য কাগজের নানা বিবর্তন হল। চিঠি পাঠানো এবং বিলি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাত ধরে সভ্য সমাজে একসময়ে চিঠিবিলির ব্যবস্থা নিতে হল প্রশাসককে। এই কাজে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বিলি ব্যবস্থার জন্য নির্দিষ্ট দফতরের প্রয়োজন হল। উদ্ভাবন হল ডাকব্যবস্থার পরিকাঠামো। ডাক বিভাগই একসময়ে আনল পোস্টকার্ড। ১৯৬১ সালে প্রথম বাণিজ্যিক পোস্টকার্ডের উদ্ভাবক ছিলেন আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার জন পি চার্লটন। স্বাধীনতার পরে ভারতে নাসিক সিকিয়োরিটি প্রেসে পোস্টকার্ড ছাপা হত। সেই পোস্টকার্ডে থাকত অশোকস্তম্ভের ছবি। ২০০২ সালের ২ সেপ্টেম্বর ভারতীয় ডাক বিভাগ প্রথম ‘মেঘদূত’ পোস্টকার্ড চালু করে। সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই ‘মেঘদূত’এর পরিকল্পনা।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে পোস্টকার্ডের উপর আক্রমণ শুরু হল। মোবাইলে কথার ফুলঝুরি আর ব্যাকরণহীন এসএমএস তখন বায়ুর গতিবেগে চলা কনকর্ড বিমান। পোস্টকার্ডের গোরুরগাড়ির বেগ। পাল্টা দিতে পারে! পোস্টকার্ড বাঁচাতে একটা চেষ্টা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় বাজেটে তার দাম পঞ্চাশ পয়সার বেশি না রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বাজারে আছড়ে পড়ল পঁচিশ পয়সার ‘মেঘদূত’ পোস্টকার্ড। তবুও জনগণ খুশি নন। তাঁরা পোস্টকার্ডের মৃত্যুই চান। কেন্দ্রীয় সরকারও আর ভর্তুকি দিয়ে ‘মেঘদূত’ বহন করতে চাইছিল না। ফলে ডাকঘরগুলিতে জোগান কমে এল। পোস্টকার্ড ব্যবহারকারী স্বল্পসংখ্যক নাগরিক হতাশ। তাঁরা বিকল্প কিছু খুঁজে নিতে চাইছিলেন। শ্বাস ওঠা একটি মাধ্যমের জন্য লেখালেখি, অশ্রুপাতও হল। কিন্তু শেষযাত্রায় পা বাড়ানো থেকে রোখা গেল না পোস্টকার্ডকে। ঘরের কোণে হাঁফাতে হাঁফাতে মৃত্যুর দিনগোনা অবহেলিত বৃদ্ধের মতোই ডাকবিভাগে বেঁচেছিল পোস্টকার্ড।
স্বাভাবিক ভাবেই মনে হতে পারে, রাজনৈতিক খেলায় পোস্টকার্ড যেন প্রাণ পেল। কিন্তু সেইখানেই রয়েছে ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজে’র তত্ত্বটি। পোস্টকার্ড ভর্তুকিতে চলে। ডাক বিভাগের বছর দুয়েক আগের রিপোর্ট বলছে, ছাপা থেকে প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত ১২ টাকার মতো খরচ হয়। অথচ পোস্টকার্ডের দাম মাত্র ৫০ পয়সা। ক্ষতির হিসেবটা ৩০ লক্ষের সংখ্যায় করলে মোবাইল ক্যালকুলেটরের স্ক্রিন ভরে উঠবে। সেই অর্থ ঘুরপথে যাবে করদাতাদের পকেট থেকে। ‘জয়’ধ্বনি ছোড়াছুড়িতে ক্ষতির ছোরা বসবে ডাক বিভাগের বুকে। বা নাগরিকের পকেটে।
১৯০৩ সালে ব্রিটেনের এক সংবাদপত্র মজা করে লিখেছিল ‘আগামী দশ বছরে ইউরোপ পোস্টকার্ডের কবরে শায়িত হবে’। সে বছর শুধু গ্রেট ব্রিটেনে ছ’কোটি পোস্টকার্ড বিলি করা হয়েছিল। ৩০ লক্ষ পোস্টকার্ড বিক্রি হলে ডাক বিভাগের বড়সড় ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব কী বলছে? মেদিনীপুর ডাক বিভাগের এক সূত্রে খবর, পোস্টকার্ড বিক্রি কমেছে। ১৫-১৬ বছর আগেও ছবিটা ছিল অন্যরকম। উৎসবের মরসুমে সেই সময়ে দিনে অন্তত ৬০০-৭০০ পোস্টকার্ড বিক্রি হত। আর এখন ১০০-১৫০! বছরের অন্য সময়ে বিক্রি আরও কম, দিনে গড়ে ৪০-৫০! কারণ এখন খুব কম লোকই চিঠি লেখেন। বেশিরভাগ মেসেজে বার্তা পাঠান। উৎসবের মরসুমে কিছু বার্তা পাঠানোর জন্য পোস্টকার্ডকেই কেউ কেউ নির্ভরযোগ্য মাধ্যম বলে মনে করেন। একই ছবি পূর্ব মেদিনীপুরে। তমলুক প্রধান ডাকঘর সূত্রের খবর, রাজনৈতিক খেলায় বিক্রি বাড়েনি পোস্টকার্ডের। অন্য সময়েও নয়।
ভাগ্যিস বাড়েনি। না হলে নীতিকথার ব্যাঙ-মায়ের মতো ডাক বিভাগই হয়তো বলে উঠত, তোমাদের খেলাধুলো আমাদের দুর্দশার কারণ না হয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy