Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Visva Bharati

গ্যাগাসুর

রকমসকম দেখিয়া সন্দেহ, বিশ্বভারতীতেও আপাতত গ্যাগাসুরের ভর হইয়াছে।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

মুদ্রণপ্রমাদ নহে, নব্য বানানবিধিও নহে। এই আখ্যান প্রকৃতই গ্যাগাসুরের, উপেন্দ্রকিশোর-বর্ণিত ঘ্যাঁঘাসুরের নহে। ঘ্যাঁঘার তুলনায় গ্যাগা অর্বাচীন, কিন্তু কে না জানে, করোনাভাইরাসের ন্যায় অসুরেরও নবরূপ মাত্রেই বহু গুণ শক্তিশালী ও অদম্য হইয়া থাকে। গ্যাগাসুরের মহিমাবর্ণনের পূর্বে নামের ব্যুৎপত্তি বুঝিয়া লওয়া যাউক। গ্যাগাসুর ভাষাসংকর শব্দ। তাহার আদিতে ইংরাজি গ্যাগ— ক্রিয়াপদে যাহার অর্থ, বলপ্রয়োগপূর্বক কাহারও মুখ বন্ধ করিয়া দেওয়া; এবং অন্তে সংস্কৃত অসুর। অর্থাৎ, যে অসুর বলপ্রয়োগ করিয়া বা সেই হুমকি দিয়া লোকের মুখ বন্ধ করিয়া দেয়, তাহাই গ্যাগাসুর। তাহাকে দেখিতে কেমন, বলিবার উপায়মাত্র নাই— কারণ, দুষ্ট অসুরেরা স্বভাবতই বহুরূপী হইয়া থাকে— বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকের মধ্যে গ্যাগাসুরের ভর হয়। অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ অনুসারে, সেই দুর্ভাগা লোকটির আত্মাকে বোতলবন্দি করিয়া গ্যাগাসুর তাহার শরীর, এবং বিশেষত মনের দখল লয়। অবশ্য ইহাও সত্য যে গ্যাগাসুর প্রকৃত স্বাধীনচেতাদের এড়াইয়াই চলে। যাহাদের চিত্ত দুর্বল, যাহারা গ্যাগাসুরের হাতে আত্মা বন্ধক দিতে এক রকম রাজিই থাকে, গ্যাগাসুর তাহাদের উপরই ভর করে। এক বার ভর হইলে গ্যাগাসুরের তাণ্ডব দেখিয়াই তাহার উপস্থিতি বুঝিতে হয়। এক কালে গ্যাগাসুরের ভর হইলে কর্তারা খবরের কাগজ ছাপিবার পূর্বে তাহা দেখিবার দাবি করিতেন। এখন তাঁহারা বিজ্ঞাপন বন্ধ করিয়া ভাতে মারিতে চাহেন। গ্যাগাসুরের নজর পড়িলে ‘ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে’ ছয় মাস ইন্টারনেট বন্ধ থাকে, দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতবিরেতে মেয়েদের হস্টেলে গুন্ডা ঢুকিয়া পড়ে, পুলিশের সম্মুখে বন্দুকবাজ গুলি চালাইয়া দেয়।

রকমসকম দেখিয়া সন্দেহ, বিশ্বভারতীতেও আপাতত গ্যাগাসুরের ভর হইয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফরমান জারি করিয়াছেন, অতঃপর কোনও শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মী মিডিয়ায় মুখ খুলিতে পারিবেন না। খুলিলে, ‘যথোপযুক্ত ব্যবস্থা’ গ্রহণ করা হইবে। সেই ব্যবস্থাটি ঠিক কী, কর্তৃপক্ষ জানান নাই, কিন্তু গ্যাগাসুর কী করিতে পারে, বিশ্বভারতী ইতিমধ্যেই দেখিয়াছে— প্রজাতন্ত্র দিবসে উপাচার্য মহাশয় ভাষণ দিতেছিলেন, এক ছাত্র সেই ভাষণ রেকর্ড করায়, এবং সেই রেকর্ডিং প্রকাশ হইয়া পড়ায় ছাত্রটিকে হস্টেল হইতে উৎখাত করা হইয়াছে। কেহ জানিতে চাহেন নাই, যে কথা পাঁচকান হইলে উপাচার্য মহাশয় বিব্রত বোধ করেন, সেই কথা তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণে বলেন কেন? গ্যাগাসুরের ভর হইলে বোধবুদ্ধি গুলাইয়া যায়। ফলে, বিশ্বভারতীর কর্তারা নিজেদের নির্দেশের অবিশ্বাস্য অলীকতা দেখিতে পান নাই। বিশ্ববিদ্যালয় হইল মুক্তচিন্তার সর্বোচ্চ পরিসর। যে কোনও কথা ভাবিবার, যে কোনও বিশ্বাস, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা প্রথাকে নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করিবার অধিকার সেই মুক্তচিন্তার অপরিহার্য পূর্বশর্ত। অন্য দিকে, সংবাদমাধ্যম হইল নিজের চিন্তাকে বৃহত্তর জনসমাজের সম্মুখে পেশ করিবার প্রকৃষ্টতম পথ। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সেই পথে কাঁটাতার লাগাইয়া জানাইয়াছেন, গণমাধ্যমে যদি কিছু বলিতে হয়, তবে তাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ আধিকারিকের মাধ্যমে বলিতে হইবে। গ্যাগাসুরের লেজ হইতে পালক ছিঁড়িয়া আনিবার দুঃসাহস যে কাহারও নাই, তেমনটা নহে— তবে, মুক্তচিন্তা করিলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে স্থান হইবে না, এমন ঘোষণায় জরুরি অবস্থা বা ফ্যাসিতন্ত্রের উদাহরণও বাসি হইল বলিয়া।

অদৃষ্টের পরিহাস, এই কুনাট্যটি যে মঞ্চে অভিনীত হইতেছে, তাহার নাম বিশ্বভারতী। যে পরিসরটিকে রবীন্দ্রনাথ এমনকি দেওয়ালের ঘেরাটোপেও আটকাইতে চাহেন নাই। ইহাই গ্যাগাসুরের মহিমা— যখন সে যে পরিসরটির উপর ভর করে, তাহার যাবতীয় উদারতা, বোধ, প্রাণশক্তি সে চিবাইয়া খায়। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে কোপাইয়ের অগভীর জলে ভাসাইয়া দিয়াছেন। কে বলিতে পারে, অতঃপর হয়তো গ্যাগা ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিয়া উঠিবে, “গেগি, রাষ্ট্রদ্রোহের গন্ধ পাইতেছি— নির্ঘাত কেহ ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’ গাহিতেছে।” কর্তৃপক্ষও হয়তো ফরমান জারি করিবেন, এই গান গাহিলেই ‘হাতে হাতে ফল’। তবে, তাঁহারা এক বার গানটি শুনিয়া লইতে পারেন। বোঝা ভারী হইলেই যে তরীখান ডুবিবে, ইহা নেহাত গানের বাণী নহে— প্রকৃত প্রস্তাবে ইহা দৈববাণী। ভারতীয় গণতন্ত্র সাক্ষী, গ্যাগাসুর কখনও শেষ অবধি জেতে নাই। দুর্বলের যে বল, তাহার সম্মুখে গ্যাগাকে হারিতেই হইয়াছে। প্রতি বার।

অন্য বিষয়গুলি:

Visva Bharati JNU Jamia Milia Islamia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy