বাবার হাত ধরে যখন ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতায় এসে পড়াশোনা শুরু করলেন, সে এক অদ্ভুত সময়। ১৮২৯ সাল। রামমোহন রায়ের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় সতীদাহ প্রথা রদ আইন পাশ হচ্ছে সেই বছর। নয় বছরের বালক ঈশ্বরের কানে বিষয়টা ভেসে এসেছিল কি?
বাংলার সমাজে বিরাট পরিবর্তনের সময় শুরু হচ্ছে তখন। হিন্দু সমাজের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয় সতীদাহ— তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে ব্রিটিশ রাজের আইনকানুন। কেউ সেই সংস্কারের পক্ষে, অধিকাংশই বিপক্ষে। সমাজ-সংস্কার, কিংবা ধর্ম-আন্দোলন, যে ভাবেই বলা যাক না কেন, এর পরের কয়েক দশকে বাঙালি হিন্দু সমাজ কতটা তোলপাড় হতে চলেছে, আমরা জানি। জানি ইয়ং বেঙ্গলের প্রমত্ততার কথাও। হিন্দু ধর্মের অসারতা ও হিন্দু সমাজের অনৈতিকতা নিয়ে ইংরেজি শিক্ষিত যুবকরা তখন দিনরাত কুবাক্যবর্ষণে ব্যস্ত। এ দিকে, রক্ষণশীলদের সঙ্গে সহনশীল হিন্দুও মানতে পারছেন না এই উদ্দামতা। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় খ্রিস্টধর্মান্তরিত হচ্ছেন (১৮৩২) জেনে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ছে— ঈশ্বরচন্দ্র তখন মোটে বারো, সংস্কৃত কলেজের ‘ব্যাকরণ’ শ্রেণিতে। পরবর্তী কালে যিনি হিন্দু বিধবার আবার বিয়ে দেওয়ার মতো বিস্ফোরক কাজে পা দেবেন, ১৮৩০-এর দশকের কাণ্ডকারখানা দেখে তিনি কী ভাবছিলেন, জানতে ইচ্ছে করে। অথচ জানা যায় এইটুকুই যে— ধুতি-চাদর গায়ে রোজ গোলদিঘি-পাড়ায় পড়তে যাচ্ছেন তিনি তখন। ঘরে ফিরেও, পড়ার জন্য চলছে অমানুষিক কষ্টসহন।
আরও এগারো বছর পর, ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, যে ঘটনাটি ঘটেছিল তা নিশ্চিত ভাবেই ঈশ্বরের কানে গিয়েছিল। অনুজতুল্য ইংরেজিনবিশ ছাত্র মধুসূদন দত্ত সে দিন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হচ্ছেন, কৃষ্ণমোহন সেখানে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত। পাদরি সাহেবরা উত্তেজনায় ছটফট করছেন, সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে মধুসূদনকে লুকিয়ে পড়তে হচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে। তেইশ বছরের বিদ্যাসাগর কী ভাবছিলেন সে দিন? উনিশ শতকের নানা গবেষণা, জীবনী, কাহিনি থেকে জানতে পারি নব্যশিক্ষিত যুবারা এ সব নিয়ে বহু গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের নেতৃত্বে ইয়ং বেঙ্গলের দল ও দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ব্রাহ্মদের দল, দুই পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে করতে হিন্দু রক্ষণশীলদের প্রতিরোধ করছেন। সামাজিক বিবাদবিতণ্ডা প্রায় ফুঁড়ে ফেলছে নাগরিক সমাজকে। এর মধ্যে বিদ্যাসাগর কিন্তু একটুও যোগ দেননি। ‘‘ধর্মান্দোলনের এই কোলাহলে একটি দিনের জন্যও বিদ্যাসাগর তাঁর কণ্ঠ যোগ করেননি। নীরবে দূরে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।’’ (বিনয় ঘোষ)
কেন?— আমাদের মনে এ প্রশ্ন জাগবেই। ধর্ম-সমাজের বিপক্ষেই তো তাঁর কথা বলার কথা ছিল। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কদাচার ও অত্যাচার প্রবিষ্ট বলে কিছু দিন পরই যিনি নিজের প্রাণটিকে পর্যন্ত পণ করে লড়াইয়ে নামবেন, তাঁর কি মনে হয়নি, হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারে নিজেকে একটু হলেও জড়াতে? অন্তত নিজে কী ভাবছেন, তা স্পষ্ট করে বলতে— যাকে আজ আমরা বলি, একটা ‘অবস্থান’— নিতে?
না, এ সব কিছুই করেননি তিনি। কেন করেননি, জানা নেই। আন্দাজ করা যায় যে, তাঁর মনে হয়েছিল, কোনও কাজের কাজ হবে না এ পথে। বিবাদ-বিতর্কের মধ্যে শক্তিক্ষয়ই হবে, আধ্যাত্মিক আদর্শ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় সময় নষ্ট হবে। তাই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বেদান্ত-বাদীরা যখন খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধতায় কোমর বেঁধে নামছেন— তত্ত্ববোধিনী সভা ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত দুই জন মানুষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত, এ বিষয়ে কোনওই উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। ধর্মচর্চা, আধ্যাত্মিক অনুশীলন, ইত্যাদি ছেড়ে এঁদের এক জন মনোনিবেশ করছেন শিক্ষাসংস্কারে ও সামাজিক অন্যায়ের প্রতিকারের শাস্ত্রবাদী পথ নিয়ে, আর অন্য জন বস্তুবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার নিয়ে। দেবেন্দ্রনাথের বিরক্তি বেশ টের পাওয়া গেল: ‘‘কতকগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে, ইহারদিগকে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে আর ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের সুবিধা নাই।’’ ‘নাস্তিক’ শব্দটির প্রতি কত যে বিরূপতা ছিল তাঁদের, বোঝা যায় রাজনারায়ণ বসুর মন্তব্যেও: ‘‘নাস্তিকতা অপেক্ষা পৌত্তলিকতা ভাল।’’ নাস্তিক যাঁরা পছন্দ করতেন, সেই কৃষ্ণকমলরাও অবশ্য তাঁকে নাস্তিকই মনে করতেন— ‘‘বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন এ কথা বোধহয় তোমরা জানো না, যাঁহারা জানিতেন তাঁহারা কিন্তু সে বিষয় লইয়া তাঁহার সঙ্গে কখনও বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইতেন না।’’
এত সব সত্ত্বেও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশ থেকে বারো বছর, অর্থাৎ ১৮৫৫ পর্যন্ত অক্ষয় দত্ত ছিলেন এর সম্পাদক। এবং ওই সভার সভ্য থাকার শেষ দিন পর্যন্ত পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, আর সীমিত সময়ের জন্য সম্পাদক ছিলেন বিদ্যাসাগর। এই দুই অমিতপ্রতিভাধারী, ভিন্ন ধারার চিন্তকের কথা আজ একসঙ্গে স্মরণ করার দিন: কেননা দুই জনেরই জন্ম ছিল এক সালে, দুই জনেরই দুশো বছরের সূচনা হল ২০১৯-এ।
ধর্মের আন্দোলনে বা আলোচনায় তো কোনও আগ্রহ ছিলই না, ঈশ্বরচন্দ্র ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তরও তাই মেলে না। এই প্রসঙ্গে ঘোর যুক্তিবাদী অক্ষয় দত্তের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথাটা আর একটু না বললেই নয়। ঈশ্বরচন্দ্রের সহানুভূতি ও সমর্থন ছাড়া কিন্তু অক্ষয়কুমার একা তত্ত্ববোধিনীর হাল ধরতেই পারতেন না। অক্ষয় দত্তের পাশে বিদ্যাসাগরের সঙ্গেও দেবেন্দ্রনাথের সংঘর্ষ বেধেছিল। পত্রিকায় যখন ধর্মতত্ত্বের বদলে বিধবাবিবাহকেই বেশি গুরুত্ব দিতে বললেন বিদ্যাসাগর, শুধু দেবেন্দ্রনাথ কেন, ব্রাহ্মসমাজভুক্ত সকলেই বিরক্ত হয়ে উঠলেন। তাঁরা তো হিন্দুসমাজের প্রতিরোধ করছিলেন তত্ত্বে। আর বিদ্যাসাগর তা করছিলেন, কাজে। ধর্ম, ব্রহ্ম, তত্ত্ব, আন্দোলন, এ সবের থেকে তাঁর মনে অনেক বেশি জায়গা জুড়ে ছিল ক্লেশ, দুর্দশা, অ-জ্ঞান, অনাচার, এই সব শব্দ। মানুষের ‘ছোট’ জীবনকেই তিনি সহনীয়তর করে তোলার চেষ্টায় ছিলেন— ‘বড় বড়’ কথাবার্তায় আগ্রহ ছিল না। সমাজ বা ধর্ম নিয়ে ‘আন্দোলন’ বা ‘প্রতিরোধ’ করতে হবে— সেই ‘বড়’ লক্ষ্য নয়, কী ভাবে দুঃখী ভাগ্যহীন দরিদ্রের ‘সেবা’ ও ‘সাহায্য’ করতে পারবেন, এই ধরনের ছোট লক্ষ্য ঘিরেই তাঁর যা-কিছু কাজকর্ম ভাবনাচিন্তা।
দুই সহচারী, সহকারী। কিন্তু অক্ষয় দত্ত ও বিদ্যাসাগর, দুই জনের কথা একসঙ্গে বলার বিপদও আছে কিছু। অক্ষয় দত্তের সেই অসামান্য সমীকরণটির কথা তো আমরা জানি, যেখানে পরিশ্রম+প্রার্থনা=ফসল, পরিশ্রম=ফসল, সুতরাং প্রার্থনা=শূন্য। আর বিদ্যাসাগর? কথায় কথায় স্বর্গলোক পরলোক ইত্যাদি নিয়ে ব্যঙ্গ করতে তিনি ছাড়তেন না। ইহলোক ছাড়া কিছুর প্রতি যে তাঁর কোনও বিশ্বাস নেই তা বুঝিয়ে দিতেন। সাংখ্য, বেদান্ত ইত্যাদি দর্শনে সমাজের কত ক্ষতি হচ্ছে, বলতে বাকি রাখতেন না। আবার তিনিই কিন্তু আজীবন উপবীত পরতেন। চিঠিপত্রের শিরোনামে শ্রীশ্রীদুর্গাশরণম্, শ্রীশ্রীহরিশরণম্ লিখতেন। যিনি বিবাহের মতো গুরু ক্ষেত্রে সামাজিক আচার ভাঙতে পারেন, চিঠির মতো লঘু ক্ষেত্রে যে তিনি আচার মেনে চলবেন, এমন ভাবা যায় কি? ঈশ্বর প্রসঙ্গে কী বলেছিলেন তিনি? ‘‘তাঁকে তো জানবার যো নাই। এখন কর্ত্তব্য কি? আমার মতে কর্ত্তব্য, আমাদের নিজেদের এরূপ হওয়া উচিত, সকলে যদি সেরূপ হয় পৃথিবী স্বর্গ হয়ে পড়বে। প্রত্যেকের চেষ্টা করা উচিত যাতে জগতের মঙ্গল হয়।’’ বিদ্যালয়শিক্ষাতেও ধর্মপাঠ ঢোকাতে রাজি ছিলেন না তিনি। রামকৃষ্ণের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের কিছু বিষয়ে মিল ছিল। তবু যে তাঁদের দেখা হতে কথাবার্তা বেশি দূর এগোয়নি, দেখাও আর পরে ঘটে ওঠেনি, তাও হয়তো এই কারণেই যে, ধর্মবোধ ঈশ্বরচেতনা, এ সব বড় ‘ব্যক্তিগত’ ছিল তাঁর কাছে (‘‘বড় কাজ একাই করতে হয়’’, শঙ্খ ঘোষ, আবাপ ২৬-৯)। ভক্তিমার্গের কর্মবিমুখতা আর জ্ঞানমার্গের কূটকচালি, দুইয়ের বদলেই তিনি নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন কর্মমার্গ এবং নিরলস ব্যস্ততা। রবীন্দ্রনাথের সেই অবিস্মরণীয় বাক্যটিতে তাই ‘এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন’-এর ঠিক পরই এল ওই শব্দগুলি: ‘কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক’ ‘জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল’...।
বিরাট বড় কিছু নয়, ভাবতে গেলে। অনেকেই সেই সময়ে অনেক কিছু নিয়ে ভাবিত, বিপর্যস্ত। আর তিনি ভাবছেন, কার কার নিয়মিত মাসোহারা দরকার, কোন কোন জায়গায় ইশকুল করা যায়, ভাল শিক্ষক কোথায় পাওয়া যায়, বিধবাবিবাহের ব্যবস্থা কোথায় করা যায়, এই সব। প্রবল ব্যক্তিত্ব, বিদ্যা, পৌরুষ, ঔদার্য, যুক্তিবাদিতা— এ সব কিছু নিয়ে নিজে কেমন হবেন, কী করবেন, কী করবেন না, নিজেই ঠিক করে নিতেন। নিজের চরিত্র ও লক্ষ্য নিজেই গড়তেন। ভেসে যেতেন না।
এমন মানুষ যে বাঙালি সমাজে একক আর নিঃসঙ্গ হয়ে থাকবেন, তাঁর মূর্তি যে সমানেই ভাঙা হয়ে চলবে— স্বাভাবিক নয় কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy