নাবালিকা পাচারকে ‘আধুনিক দাস ব্যবসা’ বলিয়া চিহ্নিত করিবার দাবি তুলিয়াছে কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন। ইতিহাসের প্রেক্ষিতে সে দাবি কতটা সঙ্গত, তাহা লইয়া বিতর্কও বাধিয়াছে। তবে পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিক্রয়চক্রের রূপটি কিছু কম ভয়ানক নহে। দাস ব্যবসায়ের জন্য নিবেদিত জাহাজ থাকিত, বন্দিদের বশে রাখিবার সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা থাকিত। আজ নাবালিকা পাচার করিবার চক্রগুলিও অতিশয় বিস্তৃত এবং সংগঠিত। নাবালিকা মেয়েরা কোথা হইতে আসিবে, কোথায় থাকিবে, কী উপায়ে স্থানান্তরিত হইবে এবং ক্রয়-বিক্রয়ের শর্ত কী হইবে, সে সকলই সুশৃঙ্খল ভাবে নির্ধারিত হইতেছে। পার্থক্য এইটুকুই যে, পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের উপর শ্বেতাঙ্গদের স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত করিবার আইন ছিল। আজ গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক ভারতে নাবালিকা পাচারের সপক্ষে আইন নাই, বরং পাচার অবৈধ করিয়া আইন তৈরি হইয়াছে। এই সামান্য অসুবিধাটুকু দূর করিতে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ দৃশ্যত তৎপর। সন্দেহ হয়, রাজনৈতিক নেতা হইতে পুলিশ-প্রশাসনের পদস্থ কর্তা, অনেকেই পাচারচক্রের নিকট বন্দি। সন্দেহটি ভিত্তিহীন নহে। যাবতীয় আইন ও সরকারি প্রচারকে হেলায় অগ্রাহ্য করিয়া দিনের পর দিন যে ভাবে নারীপাচার চলিতেছে, তাহা কি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সাজশ ভিন্ন সম্ভব?
পাচার সম্পর্কিত সর্বাপেক্ষা উদ্বেগজনক সংবাদ বোধ হয় ইহাই যে, ইহা কোনও ‘সংবাদ’ নহে। অর্থাৎ, এই অসহনীয় অন্যায়টি এত বার ঘটিয়াছে যে তাহার মধ্যে নূতনত্ব আর অবশিষ্ট নাই। কিছু মেয়ে বাড়ি হইতে নিরুদ্দেশ হইবে, আর ফিরিয়া আসিবে না, এবং হাতে-গোনা কয়েক জনকে পুলিশ উদ্ধার করিলেও তাহারা কার্যত ব্রাত্যের জীবন কাটাইবে, ইহাই এখন ‘স্বাভাবিক’ ঘটনাক্রম হইয়া উঠিয়াছে। জনমানসে ইহার প্রভাব মারাত্মক বলিয়াই আশঙ্কা। পুরুষতন্ত্রের ধর্মই মহিলাদের খাটো করিয়া দেখিতে শেখানো। তাহার উপর, মেয়েরা যদি কার্যত পণ্যে পরিণত হন— একেবারে বাজারদর বাঁধিয়া যদি তাঁহাদের কেনাবেচা চলে— অনেকেই হয়তো মহিলাদের সম্মান করিবার যৌক্তিকতাটুকুই বুঝিতে অস্বীকার করিবেন। দাস ব্যবসায়ীরা শ্বেতাঙ্গ ছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গদের তাঁহারা মনুষ্যপদবাচ্য বলিয়া মনেই করিতেন না। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে যে মনুষ্যবাণিজ্য চলিতেছে, সেখানে প্রেমিক প্রেমিকাকে, মাসি বোনঝিকে, গৃহস্থ তাহার প্রতিবেশীর কন্যাকে বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী বলিয়া মনে করিতে অভ্যস্ত হইতেছে। বর্ণ নহে, এ ক্ষেত্রে অপরায়নের মাপকাঠি হইল লিঙ্গ।
নাবালিকা ও নারী পাচার একটি জটিল, বহুমাত্রিক অপরাধ। পরিবার হইতে সরকারি হোম, সকলেই কিশোরী কন্যাকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ। অতএব রাষ্ট্রকেও উপযুক্ত প্রতিকার খুঁজিতে হইবে। যৌনপল্লি হইতে নাবালিকা উদ্ধার, এবং অপরাধীর গ্রেফতার ও শাস্তির পরিসংখ্যান দিয়া দায় সারিতে পারে না প্রশাসন। কেবল পাচারচক্র ভাঙিলে হইবে না, তাহারও মূলে রহিয়াছে পাচারের প্রতি প্রশ্রয়ের যে চক্র, তাহাকে ভাঙিতে হইবে। মার্কিন দেশকে দাস ব্যবসায়ের কলঙ্ক হইতে মুক্ত করিতে সে দেশের নেতারাই যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছিলেন। আজ কি ভারত তথা বাংলার নেতারা পাচারকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করিয়া বসিয়া থাকিবেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy