যতই ক্ষমতা থাকুক না কেন আমাদের, সে সবই শেষ হবে মৃত্যুতে। গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
১০ ফুট দূর থেকে দেখছি অ্যান্টিসেপ্টিকের গন্ধে ভরা হাসপাতালের ঘরে নিওন আলোর নীচে শায়িত বাবা।
আমি ওঁকে কোনওদিন চিৎ হয়ে শুতে দেখিনি। সবসময় বাঁ’দিকে পাশ ফিরে শুতেন। তাই ওই কলজের ভেতর কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়া ঠান্ডাঘরে বুকের দু’পাশে হাত রেখে চিৎ হয়ে শোওয়া লোকটাকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে একটু। ওই অ্যাঙ্গল থেকে মুখটা একটু বড় আর ফুলে ওঠা মনে হচ্ছে যেন। পরে জেনেছিলাম, ওটা কিডনিজনিত অসুবিধার শেষ ফলাফল।
হাতে একটা পাজামা-পাঞ্জাবি আর শাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শালটা মা দিয়েছেন বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়। অবুঝ যুক্তি দিয়ে— যদি বাড়ি ফেরার সময় ঠান্ডা লাগে, গায়ে জড়িয়ে দিস। এখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুজন। আমি আর আমার ভিতরের গোপনবাসী আরেক সত্তা। আমরা জড়িয়ে পড়েছি এক এপিক তর্কে। এবারে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে আসাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত ছিল সেই প্রশ্নে। চতুর্থ বার স্ট্রোক হওয়ার পর উনি আর ফিরে আসতে পারবেন না, একথা কি আমাদের জানা ছিল না? যে মানুষটি সারাজীবন সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলেছেন, শেষযাত্রার প্রাক্কালে তাঁকে এত নিঃসঙ্গ, নির্জন, বিষন্ন বিদায় দেওয়াটা কি খুব জরুরি ছিল ?
বাবা গত হয়েছেন কয়েক বছর। কালের নিয়মে স্মৃতি ফিকে হয়ে আসছে ক্রমে ক্রমে। বিশেষ কিছু মুহূর্ত ছাড়া অনুপস্থিতি সেভাবে মনেও থাকে না আর। কিন্তু সেদিনের সেই প্রশ্নটা আমার সঙ্গে সেঁটে আছে মাল্টিপ্লেক্সের সিটে আটকে থাকা নাছোড়বান্দা চুইংগামের মত। হাউ মাচ ইজ টু মাচ? যথেষ্ট আর আতিশয্যের মাঝে যে সূক্ষ্ম রেখা, প্রিয়জনের চিকিৎসার সময় সেটা নির্ধারণ করা খুব দুরূহ জানি। কিন্তু অসম্ভব কি? কোথায় গিয়ে দাগ টানব আমরা? শেষের দিকে এই চিকিৎসা কি শুধুই রোগীর ভালর জন্য? নাকি সেটা আমরা মূলত নিজেদের ভাল রাখার জন্যে, নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হয়ত বা নিজেদের অজান্তেই করে থাকি?
এ প্রশ্ন ক্রমে আমাকে পেয়ে বসায় পেশাগত বিদ্যার শরণ নিলাম। একটা ছোট পরিধির মার্কেট রিসার্চ, যাকে বিজ্ঞাপনী ভাষায় বলা হয় ‘ডিপস্টিক রিসার্চ’, শুরু করলাম। বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, দূরসম্পর্কের আত্মীয় আর সামাজিক ভাবে পরিচিত হাতেগোনা কিছু মানুষ, মূলত কলকাতার বাসিন্দাকে নিয়ে। সব মিলিয়ে জনা পঞ্চাশেক। ফোনালাপ করে বুঝতে চাইলাম তাদের বয়স্ক নিকটাত্মীয় বিয়োগের খুঁটিনাটি। তবে আমার এই রিসার্চ স্যাম্পল দেশ, রাজ্য বা এমনকি, একটা জেলারও প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই এখানে বলে রাখা ভাল, যা শুনলাম এবং বুঝলাম, সেটা আমার মতো অনেকের মনের কথা হলেও সকলের কথা নয় নিশ্চয়ই।
গবেষণার ফলাফল খানিকটা এইরকম দাঁড়াল— প্রায় প্রত্যেক পরিবারে বয়স্ক নিকটাত্মীয়র মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে। বেশ খানিকটা রোগভোগের পর। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আমারই মতো দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন শেষদিকের সিদ্ধান্ত নিয়ে। কেউ কেউ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, যে তাঁরা শেষ দেখে ছেড়েছেন! অর্থের কার্পণ্য না করে। সম্ভাবনারহিত মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে বেঁচে বাড়ি ফিরেছেন, এমন বিরল ঘটনার কথাও শুনেছি। প্রায় প্রত্যেককে অনুযোগ করতে শুনেছি বৃদ্ধ রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করানোর অসুবিধার ফিরিস্তি নিয়ে। মনে হয়েছে, সেবাএবং সময়ের পরিবর্তে অর্থব্যয়, অনেকটা পুজোর বিধি না মেনে তজ্জনিত মূল্য ধরে দেওয়ার মতো, আমাদের আরবান এবং স্মার্ট হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
গত কয়েক দশকে চিকিৎসাবিদ্যার অসামান্য উন্নতি হয়েছে, একথা অনস্বীকার্য। হাইজিন আর খাদ্য, এই দুইয়ের উন্নতির ফলে গড় আয়ু বেড়েছে বেশ অনেকটা। কিন্তু বয়সকালে ভাল থাকার বিদ্যা এখনও সেভাবে আমাদের আয়ত্তের মধ্যে আসেনি। দু’এক পুরুষ আগেও বয়স্ক মানুষের মৃত্যু সাধারণত হত বাড়িতে। আত্মীয়-পরিজনদের মাঝে। তখন মৃত্যু ছিল এক স্বাভাবিক ঘটনা। জন্মেরই মতো অমোঘ। এখন বল্গাহীন ভোগবাদের সুবাদে আমরা বড্ড বেশি বাঁচতে চাই। যে বেঁচে থাকায় অন্যের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করারও সময় নেই। মৃত্যুকে অস্বীকার করার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়েছে সমাজের একটা অংশের মধ্যে। রোগীর মৃত্যুতে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়মিত ভাঙচুর আর ডাক্তারনিগ্রহ সম্ভবত তারই পরিণাম। আমরা ভুলে যাই, যতই ক্ষমতা থাকুক না কেন আমাদের, সে সবই শেষ হবে মৃত্যুতে।
আরও পড়ুন: নেতৃত্ব মানে পথ দেখানো, ‘পাবলিক’-এর তালে তাল দেওয়া নয়
তার মানে কি রোগে আমার ভয় নেই? রোগ থেকে মৃত্যুর পরিণতি আমায় উদ্বিগ্ন করে না? দয়া করে ভুল বুঝবেন না। গড়পড়তা বাঙালির মতো আমিও রোগকে ভয় পাই খুব। কিন্তু মৃত্যুকে নয়। যেনতেনপ্রকারেণ মৃত্যুকে এড়িয়ে বাঁচব, এই ভাবনাটাকেই বরং বড্ড ভয় পাই ইদানীং।
পরিশেষে আসুন, তাঁর মনের কথা ভাবার চেষ্টা করি, যিনি মৃত্যুপথযাত্রী। সেই বিশেষ সময়টিতে তাঁর যদি কিছুমাত্র চেতনা থাকে, তিনি কী ভাবে নেবেন এই বিষণ্ণ নির্জনতা? বেলাশেষে তাঁর হাতে কী থাকল? যে পথে যেতে হবে, সে যাত্রা শুরু হওয়ার আগে কি আমরা সকলেই একা? সে যাত্রা শুরু হবে হাসপাতালের হাইড্রলিক বেডের সাদা বেডকভার বিছানো শয্যা থেকে? শেষ পারানির কড়ি বলতে অ্যান্টিসেপটিকের ঘ্রাণ আর ঘোলাটে চোখের পাতায় নিওন আলোর আঁকিবুঁকি? প্রিয়জনের স্পর্শ, ওষ্ঠে একটু জল, কপালে কারও হাত কি শুধু থাকবে ছেলেবেলায় শোনা গল্প আর সিনেমার পর্দায়?
আরও পড়ুন: কৃষি আইন আর তার প্রতিবাদ, দু’দিকেই উপেক্ষিত বাংলার চাষি
নাহ্, আমি কোনও উপসংহারে পৌঁছতে চাইনি। চাই না। প্রিয় মানুষের মৃত্যু ঘিরে শোক, বেদনা, যন্ত্রণা, হাহাকারের এই চলমান কথোপকথন এবং শব্দপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আমি আমার মতো অগণিত মানুষের মনে জমে থাকা দ্বিধা ও সংশয় ভাগ করে নিতে চেয়েছি মাত্র। আমার শুধু জানতে ইচ্ছা করে, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটির চেতন এবং অবচেতন জুড়ে থাকে কোন ইচ্ছে? প্রিয় মানুষ এবং স্বস্থান থেকে দূরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে একাকী শেষপথে একটু বিলম্বিত যাত্রা? নাকি প্রিয়জনের সান্নিধ্যে কিঞ্চিৎ আগে পাড়ি দেওয়া চিরনিশ্চিন্ত ঠিকানায়? মৃত্যু ঘিরে স্মৃতিকথা, কান্না, শোক আর বেদনার ভিড়ে এই প্রশ্নটাকে কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারি না।
(লেখক বিজ্ঞাপন জগতের বর্ষীয়ান বিশারদ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy