জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া ঘিরে ক’দিন ঝড় বয়ে গেল। ফের উঠে এল পুরনো কয়েকটা কথা, যার সারাংশ করলে দাঁড়ায়, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেন গায়ের জোরে হিন্দি আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করে। কিন্তু সরকার কী বলতে চায় তা না বুঝলে, বিপদ ঠিক কত দূর, ভাল করে ঠাহর করা যাবে না।
খসড়া বলছে, “স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের উচ্চবিত্ত শ্রেণি নিজেদের ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে গ্রহণ করেছে; দেশের মাত্র ১৫% লোক ইংরেজিতে কথা বলে, এবং এই জনসংখ্যার প্রায় পুরোটাই উচ্চবিত্তের সমার্থক (তুলনীয় উদাহরণ: ৫৪% লোক হিন্দিতে কথা বলে)।” এই মত অনুসারে, ইংরেজিমুখী মানসিকতার জন্যই অভিজাত সমাজ ও তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলদের থেকে পৃথক হয়ে রয়েছে। এবং সেই দুর্বল অংশে বহু কর্মঠ, ঝকঝকে, যোগ্য, মেধাবী ও শিক্ষিত মানুষ রয়েছেন, যাঁরা ঘটনাচক্রে উপনিবেশ এবং বর্তমান অভিজাতদের ভাষা বলেন না। নয়া নীতির পথ কী? ভাষার এই ক্ষমতা-কাঠামোকে রুখে দিয়ে সমাজ, শিক্ষা ও চাকরিতে প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠা। জরুরি পদক্ষেপ হবে যদি অভিজাত ও শিক্ষিতরা আরও বেশি মাতৃভাষা ব্যবহার করেন, এবং ভাষাগুলিকে প্রয়োজনীয় স্থান ও মর্যাদা দিতে হলে চাকরি, সামাজিক অনুষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দৈনন্দিন কথাবার্তাতেও সেগুলির ব্যবহার বাড়ান। অন্য দেশের উদাহরণ চিহ্নিত করে খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘বেশির ভাগ উন্নত দেশে যোগাযোগ ও লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা ব্যবহৃত হয়।’ ভারতও তা-ই করুক বলেই সুপারিশ। অন্যথায়— প্রায় হুঁশিয়ারির সুরে— ঐতিহ্যবাহী ভাষা, সংস্কৃতি ও অভিব্যক্তি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।
কথাগুলো বেশ। উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক সমতা, বিদেশি ভাষার একাধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই ও দেশের অসংখ্য মাতৃভাষার ঐতিহ্যকে সামনে সারিতে তুলে আনা। ভাষার কারণে ধনীদের ক্ষমতা আর আধিপত্য হ্রাস, অতীত ঘিরে গর্ব, শিকড়কে ভালবাসা। দেশীয় ভাষার প্রচারে এর চেয়ে শুভ ভাবনা কী-ই বা হতে পারে?
খসড়া আর একটু ঘাঁটলে বোঝা যাবে নীতি-আদর্শ যতটা শুভ মনে হচ্ছে, ততটা নয়। কারণ এর বাহন। ভারতীয় ভাষার প্রচারের জন্য স্কুল স্তরে থ্রি ল্যাঙ্গোয়েজ ফর্মুলা চালু রাখার কথা বলা হয়েছে। ১৯৬৮ সালে তৈরি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের এই সূত্র অনুসারে সব রাজ্যের শিক্ষার্থীকে তিন ভাষার পাঠ নিতে হবে। হিন্দি ও ইংরেজি বাদে অহিন্দিভাষীরা শিখবেন আঞ্চলিক ভাষা, হিন্দিভাষীরা শিখবেন আধুনিক ভারতীয় ভাষা। যার অর্থ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হিন্দি পড়তে হবে। এ বার প্রবল প্রতিবাদের পর এই পরিকল্পনা একটু বদলে সরকার জানাল— ‘নমনীয়তার নীতি হিসেবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যে পড়ুয়ারা তিন ভাষার এক বা একাধিক ভাষা বদল করতে চায়, তারা গ্রেড ৬ বা গ্রেড ৭-এ তা করতে পারে’, কারণ তাদের পরিবর্তিত মত, তিনটি ভাষায় দক্ষতা থাকাটাই আসল ব্যাপার।
আসলে হিন্দিপন্থী ও হিন্দিবিরোধীদের তর্কটা গোড়াতেই। এক দলের বক্তব্য, ভারতের সংযোগ ভাষা হোক ভারতীয়। পাল্টা প্রশ্ন, ইন্দো-আর্য বংশের ভাষা কেন ব্যবহার করবেন দ্রাবিড়ীয়রা? প্রথম দলের যুক্তি গা-জোয়ারি, সংখ্যার জোরেই তার দাবি। হিন্দি বলয়ের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি হতে পারে কিন্তু দেশকে যদি এক সুরে বাঁধতেই হয় তা হলে তামিল, গুজরাতি, মরাঠি, পঞ্জাবি, বাংলা, অসমিয়া-সহ ২১টা তফসিলভুক্ত ভাষাকে বাদ দিয়ে কী করে সম্ভব? সংবিধান অনুসারে প্রত্যেকেরই জোর সমান। ক্ষমতাবানদের নানা প্রচেষ্টায় বোঝা যায়, তিন ভাষা নীতি হোক বা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা, যেন তেন প্রকারেণ হিন্দি চাপিয়ে দেওয়াই নিহিত উদ্দেশ্য।
তিন ভাষা নীতি নিয়ে তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আন্নাদুরাই একটা মজার কথা বলেছিলেন, “দু’টি সংযোগ ভাষার ধারণা হল একটা দেওয়ালে বিড়ালের জন্য বড় ফুটো আর বিড়ালছানার জন্য ছোট ফুটো করা। যে ফুটো দিয়ে বিড়াল গলবে, তা দিয়ে নিশ্চয়ই বিড়ালছানাও গলে যেতে পারবে।” বস্তুত, রাজনীতি বাদ দিয়ে সঙ্কটটা বোঝা মুশকিল। ঐতিহাসিক ভাবে হিন্দি বলয়ের সঙ্গে পোক্ত বন্ধন ছিল আরএসএস ও জনসঙ্ঘের। অতএব, সেখানকার দাবি তুলে ধরাই তাদের প্রাথমিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, যার মধ্যে অন্যতম হল হিন্দির শক্তিবৃদ্ধি। গবেষক ব্রুস ডেসমন্ড গ্রাহাম বলেছিলেন, ঠিক এই কারণেই হিন্দুদের জাতীয় স্বার্থরক্ষার দাবি করার পরেও দেশের সব প্রান্তে ছড়াতে পারেনি জনসঙ্ঘ। তামিলরা আজও বিজেপিকে ‘হিন্দি পার্টি’ বলেই চেনেন, যাঁরা ইংরেজি-বিরোধীও বটে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য কেন্দ্রের যে শাসক দলই (যেমন কংগ্রেস) হিন্দিকে হাতিয়ার করেছে, তাদেরই মুখ পুড়েছে। আবার এ-ও ঠিক যে দেশ জুড়ে ক্ষমতা বিস্তার করতে গেলে ভাষার অস্ত্রে শান দেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই জাতীয় দলগুলির।
তবু, বৈচিত্রই আজও ভারতের বল। লোকাল ট্রেনের গায়ে অনেক সময় ‘সারে জঁহা সে অচ্ছা’ গানের দুটো লাইন লেখা থাকে, “হিন্দি হৈঁ হম, ওয়তন হৈ হিন্দুসিতাঁ হমারা।” হিন্দি প্রচার করতেও ভরসা উর্দু গজল!
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy