অন্য: কাম্বোডিয়ার ভাস্কর্যে লক্ষ্মণ, রাম ও সুগ্রীব। দেশ, কাল, ধর্ম, সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে রামায়ণও
সমুদ্র নিরাপত্তা, নীল অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, কৌশলগত রাজনীতি। এই সব ক্ষেত্রেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ গভীরতর করার তাগিদটা বাড়ছেই। আর তাই দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে থাকতে দেওয়া চলে না আসিয়ান-পাড়াকে! সেটি নিশ্চিত করতে এখন গলদ্ঘর্ম সাউথ ব্লক, রাজধানীর এই শৈত্যপ্রবাহেও! সব নজির ভেঙে দিয়ে প্রজাতন্ত্র দিবসে পূর্ব এশিয়ার দশ জন রাষ্ট্রপ্রধানকে বিশেষ অতিথি করাটা যার একটা দিকমাত্র। ভারতের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ১০ শতাংশ এবং পূর্বের পঞ্চাশ শতাংশ সমুদ্রবাণিজ্য যাদের সঙ্গে হয়— সেই আসিয়ান ব্লকের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবি়ড় করতে মোদী সরকারের এখন রাম ভরসা!
আন্তর্জাতিক রামায়ণ সম্মেলন শুরু হয়েছে দেশে। বাল্মীকির পুঁথি থেকে তির-ধনুক হাতে উঠে এসেছেন অযোধ্যার রাজা রাম, লখনউ-এর মেগা-মঞ্চে। এর পর অন্যান্য কিছু শহর ঘুরে, দিল্লির অডিটোরিয়ামেও। এই শহরগুলিতে তাঁর হাত মেলানোর কথা তাইল্যান্ডের অপেক্ষাকৃত দুর্বল আর এক রামের সঙ্গে। কাম্বোডিয়ার রাম-সীতা— দুই ভাই-বোনও সেখানে ঘুরে বেড়াবেন অক্লেশে। জৈন রাম থাকবেন তাঁর অহিংস চেতনা নিয়ে মোক্ষ লাভ পর্যন্ত। পাশে বীর লক্ষ্মণ— যিনি শেষ পর্যন্ত রাবণ বধ করে দশাননের সঙ্গেই নরকবাসী হবেন।
কাণ্ডটা কী? মোদী সরকারের টনক নড়েছে, গত দু’হাজার বছর ধরে আসিয়ানের দশটি দেশের সঙ্গে ভারতের মহামূল্যবান সংযোগের প্রধান সেতুটিই হল রামসেতু! অর্থাৎ, রামায়ণ। সাউথ ব্লকের কর্তা বলছেন, ‘আসিয়ানের দেশগুলিতে রামায়ণ কালবাহিত জনপ্রিয় মহাকাব্য। তাঁরা তাঁদের মতো করে রামায়ণ চর্চা করেন। আমরা তাই ভারতে এমন রামায়ণ সম্মেলন করছি, যেখানে এই দেশগুলির রাম-কথকরা আসবেন। আসবেন গায়ক, বাদ্যযন্ত্রী, নৃত্যশিল্পীরা। আদানপ্রদান হবে রাম-কথনের। বাড়বে সাংস্কৃতিক লেনদেন। যা পরে বাণিজ্যিক লেনদেনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
উদ্যোগটি অভিনব, সন্দেহ নেই। বিদেশ-বিশেষজ্ঞরা ঘাড় নেড়ে বলছেন, ইতিবাচকও। কিন্তু পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলে তৈরি হচ্ছে আশঙ্কার বীজও। অযোধ্যায় না আগুন ধরে যায়! যে-রামকে সামনে রেখে গো-বলয়ে ভক্তি ও সম্ভ্রমের সুনামি তৈরি করা হয়েছে এত কাল ধরে; চৌরা, গলি মহল্লা, মন্দির, পঞ্চায়েত বার বার গর্জে উঠেছে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে, ভোটবাক্সে যে উন্মাদনার প্রতিফলন পড়েছে বহু বার— সেই রামচরিতে না কালির ছিটে লাগে। কারণ সেই রাম তো একান্ত ভাবেই হিন্দুত্বের প্রধান পুরুষ। সেই রাম তো বাল্মীকির রাম, যা ছত্রে ছত্রে মনুসংহিতার সঙ্গে মিলে যায়। নিছক রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কেন তিনি বিনা দোষে বালীকে পিছন থেকে অপ্রস্তুত অবস্থায় হত্যা করেছিলেন, কেনই বা সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হল— এই সব অস্বস্তিকর প্রশ্নের যেখানে কোনও উত্তর মেলে না।
ইন্দোনেশিয়া, কাম্বোডিয়া, তাইল্যান্ড, মায়ানমারের রাম, দেশকালের ভিন্নতায় অনেকটাই পৃথক পৃথক। শুধু তা-ই নয়, রাম-চরিত্রের দেবত্বও সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই মাপে খাটো। তাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, এমন একটি মুক্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে রামায়ণ-আদানপ্রদান কি কিছুটা বিপজ্জনক নয়, গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে? শুধুমাত্র নৃত্যশিল্পী বা কথকরাই তো নন, উপস্থিত থাকবেন এই দেশগুলির পুরাণ, ইতিহাস, সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞরাও। তাঁরা যদি এমন প্রশ্ন বের করে আনেন, যা চিরকাল ঝোলার মধ্যে রেখে দিয়েছে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদ? তা ছাড়া অযোধ্যা থেকে স্বল্প দূরেই যদি নেচেগেয়ে দেখানো হয় রামচরিত্রের প্রকারভেদ (অনেক ক্ষেত্রে দুর্বলতাও) তা হলে সেটা কী সংকেত বহন করবে যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ তথা মোদী-অমিত শাহ শাসিত ভারতে?
আরএসএস তথা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটা বড় অংশ কিন্তু এখনই সিঁদুরে-মেঘ দেখতে পাচ্ছেন। নাগপুরের এক বড় নেতা তো ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, ‘আমরা যোগীকে বলেছি, সম্মেলনে যেন এই মহান হিন্দুশাস্ত্রের কোনও অসম্মান না হয়। শ্রীরামকে নিয়ে যেন মাথা হেঁট করতে না হয় আমাদের।’ বাল্মীকির রামায়ণের উপর যাঁরা নিজেদের সাংস্কৃতিক মালিকানা জাহির করেছেন যুগ যুগ ধরে— নড়েচড়ে বসছেন তাঁরাও।
‘ভিনদেশি’ যে রামায়ণগুলির নৃত্যগীতরূপ দেখতে পাওয়া যাবে, তার আদি শিকড় রয়েছে পঞ্চম শতকে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রথম হিন্দু রাজত্ব ফুনানে (আজকের কাম্বোডিয়া) পাথরে খোদাই করা ছবিতে রামায়ণ। কাম্বোডিয়ার আঙ্কর ভাট মন্দিরের গায়ে লঙ্কার যুদ্ধ এখনও সমুজ্জ্বল। মায়ানমারের পাগান-এ রামায়ণের চরিত্রগুলির ওই একই সময়কার স্থাপত্যকর্ম রয়েছে। তাইল্যান্ডের পুরনো রাজধানী আউথিয়া তৈরি হয়েছিল ১৩৪৭ সালে। অযোধ্যার ধাঁচেই নাকি গড়া হয়েছিল সেই শহর। লাও, জাভা, মালয়, বালি, বর্মাতে নৃত্যনাটক, পুতুলনাটিকা, ছায়া-নাটিকার মাধ্যমে রামায়ণ ছড়িয়ে যায় সেই সেই দেশের সংস্কৃতি, রীতিপ্রথা এবং লোকশিল্পকে অনুসরণ করে। শুধু সংস্কৃতি বা লোককথা নয়, ধর্মের সঙ্গেও বিস্তর বদলেছে বাল্মীকির রামায়ণ। যখন দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মূল ভূখণ্ড বৌদ্ধধর্মের শরণ নেয়, তখন রামও হয়ে যান বোধিসত্ত্ব। বুদ্ধের যাবতীয় গুণ আরোপিত হয় রামের উপর। হনুমান অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে থাকেন বীরত্বের নিরিখে।
রামায়ণের একটি বৌদ্ধ সংস্করণ দশরথ জাতক-এ বলা হয়েছে, দশরথ ছিলেন কাশীর রাজা। তিনি দ্বিতীয়া পত্নীকে বর দিতে চেয়েছিলেন। মৃত প্রথম বউয়ের তিন ছেলেমেয়ে: রাম, সীতা এবং লক্ষ্মণ। দ্বিতীয় মহিষী চান, তাঁর ছেলে ভরত রাজা হোক। ফলে দ্বিতীয় বউয়ের আকাঙ্ক্ষা-পূরণে রাজা তিন ছেলেমেয়েকে বারো বছরের জন্য বনে পাঠিয়ে দেন। ভরত রাজ্যগ্রহণে অসম্মত হন। এ দিকে, ন’বছর পরে দশরথ মারা যান। ভরত তখন দাদা-দিদিদের ফেরত আনতে বনে গেলেন। খবরটা পেয়ে সীতা আর লক্ষ্মণ খুব কান্নাকাটি করলেন। রাম তাঁদের সংসারের অনিত্যতা সম্বন্ধে উপদেশ দিলে তাঁরা শান্ত হন। অতঃপর রাম ভরতকে তাঁর পাদুকা দিয়ে, কাশীতে ফিরে রাজ্যশাসন করতে বললেন। বারো বছর পর দেশে ফিরে রাম সীতাকে বিয়ে করলেন এবং ষোলো হাজার বছর রাজত্ব করে, স্বর্গবাসী হলেন। এই রামায়ণে সীতার অপহরণের উল্লেখমাত্র নেই। বরং কথা শেষ করে গৌতম বুদ্ধ জানান, সে জন্মে তিনিই ছিলেন রাম, শুদ্ধোদন ছিলেন দশরথ। আর গোপা বা যশোধরা ছিলেন সীতা।
প্রাচীন হিন্দু রাজ্য চম্পা, ফুনান, চেনলাতে (যা আজকের দক্ষিণ ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া এবং পূর্ব তাইল্যান্ড) ষোড়শ শতকে যোগাযোগ গড়ে ওঠে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির। খেমের ভাষায় লিখিত রূপে পাওয়া যায় রামায়ণ। বুদ্ধের পূর্বজন্মের অবতার হিসাবেই সেখানে গড়ে ওঠে রামের চরিত্র। মালয়দ্বীপের মুসলিম রাজসভাগুলির সাহিত্যচর্চায় আরবিক অক্ষরে খোঁজা হয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ শিকড়কে। তেরো থেকে পনেরো দশকের মাঝে রচিত হয় সেখানকার রামায়ণ, যার নাম হিকায়ৎ সেরি রামা। মালয়ের সেই প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপিটি এখন রাখা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় লোককথাগুলির সংমিশ্রণে তৈরি এই আখ্যানে, লক্ষ্মণের সাহস ও বীরত্বকে রামের তুলনায় অনেক গৌরবান্বিত করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর গুরুত্ব বেশি। আবার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমারের কিছু অংশে জৈন সংস্করণে, রাম, লক্ষ্মণ, রাবণ তিন জনেই জৈন ধর্মাবলম্বী, অহিংসার পূজারি। লক্ষ্মণকেই অগত্যা রাবণ বধ করতে হয়। লক্ষ্মণ ও রাবণ দু’জনেরই স্থান হয় নরকে। রাম হয়ে যান জৈন সাধু।
বিভিন্ন রামায়ণের এই মণিহারে শেষ পর্যন্ত ভারত-আসিয়ানের পঁচিশ বছরের সম্পর্ক কতটা সেজে উঠবে, বা উঠলেও অদূর ভবিষ্যতে তাতে ‘রামরাজ্য’-এর মহিমা ক্ষুণ্ণ হবে কি না— এই প্রশ্ন তাই ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। রামচরিত্র যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, সে জন্য সংঘের নির্দেশেও বহু রামায়ণী কথার স্বীকৃতি নেই। বাল্মীকির রামায়ণে তাড়কা বধের আগে বিশ্বামিত্র রাম, লক্ষ্মণকে ডেকে দেন, ‘ওঠো, সন্ধ্যারতির সময় হয়েছে।’ বনে যাওয়ার আগে রাম কৌশল্যার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কৌশল্যা তখন পুত্রের মঙ্গলকামনায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞে। এই সন্ধ্যারতি, যজ্ঞসংস্কার— আসিয়ান দেশগুলিতে আদৌ আছে?
আলোচনা, মত বিনিময় হতেই পারে। কিন্তু সেটি বাল্মীকির রামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য নয়। হিন্দুত্ববাদীদের জানা উচিত, মধ্যযুগের ভারতে আঞ্চলিক ভাষায় হিন্দি তুলসীদাস থেকে তামিল কম্বন, অনেকেই বাল্মীকির ছক ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। তুলসীদাস, কম্বন দু’জনেই সীতা বিসর্জনের অন্য ব্যাখ্যা দেন, রাবণ মায়াসীতা অপহরণ করেছিল। ভারতেই রামচরিত্রের এক এবং একটিমাত্র বয়ান নেই, এখন গোরক্ষপুরে কী হয় সেটাই দেখার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy