“বুকের রক্ত মুখে তুলে যারা মরে/ওপারে ঢাকায় এপারের শিলচরে/তারা ভালোবাসা-বাংলাভাষার জুড়ি—/ উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি।”— লিখেছিলেন অমিতাভ দাশগুপ্ত।
প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এগিয়ে এলেই বাঙালি নড়েচড়ে বসে। উথলে ওঠে আমাদের ভাষাপ্রীতি। আর বিভিন্ন সংগঠনে চলে শহিদবেদিতে মাল্যদানের পর্ব, আলোচনা ও কবিতাপাঠের আসর। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি হোক বা ১৯ মে— এর ভিতরেই কি সীমাবদ্ধ থাকবে আমাদের ভাষাপ্রীতি? ভাষা নিয়ে আবেগ বোধ হয় এ পার বাংলার চেয়ে ও পারের মানুষেরই বেশি। তবুও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবের অংশীদার এ পারের বাঙালিরাও।
কিন্তু সমকালে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে, আমাদের বাংলাভাষা কি সঙ্কটের মুখে? বাংলা কি এক দিন লুপ্তপ্রায় ভাষায় পরিণত হবে? এই সকল প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া যায়— না, অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে সেই রকম আশঙ্কা এখনও তৈরি হয়নি। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মাতৃভাষাভাষী সংখ্যার নিরিখে বিশ্বে বাংলার স্থান পঞ্চম কি ষষ্ঠ। প্রথম চিনা ভাষা (প্রায় ১২৮ কোটি ৪০ লক্ষ); দ্বিতীয় স্থানে আছে স্পেনীয় ভাষা (৪৩ কোটি ৭০ লক্ষ); ইংরাজি তৃতীয় স্থানে (৩৭ কোটি ২০লক্ষ); আরবি আছে চতুর্থ স্থানে (২৯ কোটি ৫০ লক্ষ)। পঞ্চম স্থানটি নিয়ে বাংলার লড়াই হিন্দির সঙ্গে। হিন্দি যাদের মাতৃভাষা, তাদের সংখ্যা ২৬ কোটি; কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে বাংলাভাষীর সংখ্যা ২৬ কোটি ৫০ লক্ষ।
তবুও ভাষাবিজ্ঞানীরা আশঙ্কিত। ভাষার বিলুপ্তি সম্পর্কে প্রথম সচেতন করে দিয়েছিলেন আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিষয়ক গবেষক মাইকেল ক্লাউস; তিনি ভাষাকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন— ক) বিপন্ন ভাষা, খ) প্রায় বিপন্ন ভাষা, গ) নিরাপদ ভাষা। ২০০৭ সালে একটা তথ্যে তিনি বলেছিলেন, আগামি ১০০ বছর যে ভাষা দৈনন্দিন কাজে বা মানুষের মুখে ব্যবহৃত হবে, সেই ভাষা হল নিরাপদ ভাষা। পৃথিবীর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৭০০০ ভাষার প্রত্যেকটির অস্তিত্ব কি এখনও মেলে?
২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার হাসপাতালে মারা গেলেন ‘আকা বো’ ভাষায় কথা বলা শেষতম মানুষ সিনিয়র বোয়া। দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে তিনি মাতৃভাষায় বাক্যালাপ করার সঙ্গী পাননি। আর এই যন্ত্রণা বুকে নিয়ে তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে। সেই সঙ্গে পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে গেল এই ভাষাটি। ১৮৫৮ সালে ইংরেজেরা আন্দামানে উপনিবেশ গড়ে তোলার সময় বো উপজাতির মানুষের সংখ্যা ছিল ৫০০০ জন। বোয়া সিনিয়র মারা যাওয়ার সময়ে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৫২-তে, যাদের মধ্যে কেউ-ই এই ভাষায় কথা বলতে জানতেন না।
বিপন্ন ভাষা সম্পর্কিত একটা সম্মেলন প্রথম সংঘটিত হয় কানাডার কুইবেক শহরে ১৯৯২ সালে। সেখানে ইউনেসকো বিপন্ন ভাষাগুলি তালিকাবদ্ধ করে তাদের প্রকাশ করে ‘দি রেড বুক অফ এন ডেঞ্জেরাস ল্যাঙ্গুয়েজ’ পুস্তিকায়। আর এই বিষয়ে বিশ্বকে সচেতন করার জন্য ১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনের আহ্বান জানায়। মনে রাখতে হবে, সারা পৃথিবীতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের আগ্রাসনে অনেক ভাষাই এখন বিলুপ্তির পথে। মেক্সিকানদের আদিভাষা কেউ জানেন না, এক সময়ে আফ্রিকার ফরাসি কলোনিগুলির মাতৃভাষা কী ছিল, তা কেউ বলতে পারে না। মরিসাসের আফ্রিকান ও ভারতীয়দের ভাষা হয়ে গিয়েছে ফরাসি ও ইংরাজি। আমেরিকার কালো মানুষেরা ভুলে গিয়েছে তাদের মাতৃভাষা। এই করালগ্রাস থেকে আমাদের দেশ ভারতও রেহাই পায়নি। আন্দামানের ৯টি জনজাতির ভাষা আজ লুপ্ত। এ ছাড়াও অহম, অপভ্রংশ, প্রাকৃত, অরবি (তামিলনাড়ুর একটা মুসলিম গোষ্ঠীর ভাষা) ইত্যাদি ভাষায় আজ আর কেউ কথা বলেন না।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটা প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমাদের দেশের প্রায় ৪০টিরও বেশি ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে। এর কারণ মাত্র কয়েক হাজার মানুষ এই ভাষাগুলি ব্যবহার করেন। ইউনেস্কোর তালিকা অনুযায়ী যে সব ভাষা বিলুপ্তপ্রায়, তাদের মধ্যে রয়েছে আন্দামান নিকোবর দীপপুঞ্জের ১১টি ভাষা (গ্রেট আন্দামানিজ, জারওয়া, ল্যামংসে, লুরো, মুয়োট, অনগে, পু, সানেনো, সেন্টিলেজ, শম্পেন এবং টাকাহানিনিং), মণিপুরের ৭টি ভাষা (আমল, আকা, কইরেন, লামগাং, লাংগ্রং, পুরম এবং তারাও), হিমাচল প্রদেশের ৪টি ভাষা (বাঘাতি, হান্দুরি, পাঙ্গভালি এবং সিরমাদিও)। অন্য ভাষাগুলির মধ্যে রয়েছে ওড়িশার মান্দা, পারজি ও পেঙ্গু; কর্ণাটকের কোরাঙ্গা ও কুরুবা; অন্ধ্রপ্রদেশের গাদাবা ও নাইকি, তামিলনাড়ুর কোটা ও তোদা; ঝাড়খণ্ডের বিরহোর, মহারাষ্ট্রের নিহালি, মেঘালয়ের রুঘা এবং পশ্চিমবঙ্গের তোতো।
১৯৯৯, ২০০১ ও ২০১১ সালের জনগণনার তুলনামূলক বিচার করে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা মানুষের শতকরা হিসাবের একটা পরিসংখ্যান বিচার করা হয়েছে। সেখানে হিন্দি ছাড়া আর সমস্ত ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যার শতকরা হার কমেছে ১৯৯১ সালের তুলনায়। অথচ, প্রত্যেক রাজ্যের জনসংখ্যা কিন্তু কমেনি। তা হলে ধরে নেব প্রত্যেক ভাষাভাষীর একটা অংশ তার নিজের ভাষায় কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে বা মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না!
তা হলে কি হিন্দি আর সমস্ত আঞ্চলিক ভাষাকে গিলে খাচ্ছে না? এ রকম একটা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি আমরা।
তবুও আমরা আশাবাদী। আমরা জানি, গত ১৯৬১ সালের ১৯ মে মাতৃভাষার দাবিতে অসমের শিলচর স্টেশনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে অসম পুলিশের গুলিতে নারী-সহ ১১ জন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের স্মারক রূপে বর্তমানে শিলচর স্টেশনের নাম হয়েছে ‘শহিদ স্টেশন’। বরাকের মানুষ প্রথম এই দাবিতে সরব হয়েছিল। শেষপর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তাদের দাবি মেনে নেয়। আমরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা জানি। রফিক-সফিক-জব্বার প্রমুখের আত্মদানের কথা স্মরণ করে থাকি। কিন্তু আমাদের দেশেরই এক জন স্বাধীনতাসংগ্রামী পট্টি শ্রীরামালু (১৯০১-১৯৫২) ভাষার নিরিখে রাজ্য বিভাজনের জন্য অনশন করে প্রাণত্যাগ করেছেন; তাঁর কথা আমরা ক’জন জানি? ১৯৫২ সালে তিনি দাবি তুলেছিলেন—তেলেগু ভাষার ভিত্তিতে অন্ধ্রপ্রদেশকে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি থেকে আলাদা করা হোক। তৎকালীন ভারত সরকার তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি, তখন টানা ৫৮ দিন অনশন করে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। টনক নড়ল সরকারের। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু শ্রীরামালুর মৃত্যুর তিনদিন পরে অন্ধ্রকে নবগঠিত পৃথক রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করলেন। ফলস্বরূপ, ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হল স্টেট রি-অর্গানাইজেশন কমিশন। ১৯৫৬ সালে ভাষার ভিত্তিতে এ দেশে রাজ্যগুলি পুনর্গঠিত হল। তাই ভারতবাসীর ভাষাভক্তির প্রতীক হয়ে রইলেন পট্টি শ্রীরামালু। আজ ভাষাদিবসের প্রেক্ষাপটে এক জন ভাষাপ্রেমী হিসাবে তাঁর প্রতি রইল অন্তরের বিনম্র শ্রদ্ধা।
শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy