সমরেশ বসুর ‘আদাব’ ছোটগল্পে মাঝি এক ভারী জরুরি প্রশ্ন তুলেছিল— “আমি জিগাই মারামারি কইরা হইব কী? তোমাগো দু’গা লোক মরব, আমাগো দু’গা মরব। তাতে দ্যাশের কী উপকারটা হইব?” উত্তর মাঝি পায়নি। সংঘর্ষ-বিধ্বস্ত অঞ্চলের নাগরিকরাও পাবেন না। যা পাবেন, তা হল প্রতি দিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক চরম অনিশ্চয়তা। যেমনটি, গত কয়েক দিনে মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জ, ধুলিয়ানে দেখা গিয়েছে। ভারী বুটের শব্দ তুলে পুলিশি টহল, বন্ধ ইন্টারনেট আর ১৬৩ ধারা— এমনটাই গত কয়েক দিন যাবৎ এই অঞ্চলগুলিতে দৈনন্দিনতায় পরিণত। সংশোধিত ওয়াকফ আইন বিরোধী আন্দোলনে বহু মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন, চোখের সামনে দেখেছেন দুষ্কৃতীদের লুটপাট করতে, ঘরে-দোকানে আগুন ধরিয়ে দিতে, বোমাবাজি করতে। সামান্য সম্বল আঁকড়ে, ডিঙি নৌকোয় ভেসে গঙ্গার অন্য পাড়ে মালদহের পারলালপুরে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। এখনও অনেকে নিজের ভিটেমাটিতে ফিরে আসার ভরসাটুকু জোগাড় করে উঠতে পারেননি। ফলে তাঁদের ভবিষ্যৎও যেমন অনিশ্চিত, ঠিক তেমনই অনিশ্চিত যে স্কুলগুলিতে তাঁরা আশ্রয়শিবির বানিয়ে অবস্থান করছেন, সেই স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক পঠনপাঠন শুরু হওয়ার বিষয়টিও। সাম্প্রদায়িক অশান্তির আঁচে তাদের শিক্ষাবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলি ইতিমধ্যেই পুড়তে শুরু করেছে।
সাম্প্রদায়িক হিংসা এমনই, তা শুধুমাত্র মারামারি, ঘরে আগুন লাগানো, রক্তপাতে সীমাবদ্ধ থাকে না। এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দৈনন্দিন যাপনকে তা নষ্ট করে দেয়। রাজনীতিবিদরা পরস্পরকে দোষারোপে লাভের কড়ি ঘরে তোলেন, মৃতদেহ নিয়ে রাজনৈতিক তরজায় মাতেন, প্রশাসন ক্ষতিপূরণের অঙ্কে নিজ ব্যর্থতাকে ঢেকে দিতে চায়। কিন্তু এর বাইরেও যে ক্ষতির চিত্র জ্বলজ্বল করে, কোনও অঙ্কে তার পরিমাপ করা দুঃসাধ্য। পড়াশোনার ক্ষতিটি সেই গোত্রেই পড়ে। জীবন, জীবিকা বাঁচানোর প্রশ্নটি যেখানে গুরুতর হয়ে ওঠে, সেখানে পড়াশোনার বিষয়টি বহু পিছনে চলে যায়, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যেখানে বেশ কয়েক বছর যাবৎ সরকারি শিক্ষাক্ষেত্রটি নিদারুণ প্রশাসনিক উদাসীনতার শিকার। সরকারি এবং সরকারপোষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে অজস্র ছুটির চাপে পঠনপাঠনের কাজটি চালাতে বহু বাধা অতিক্রম করতে হয়। এই বছরও খাতায়-কলমে গ্রীষ্মের বরাদ্দ ছুটি যা ছিল, মুখ্যমন্ত্রীর বদান্যতায় সরকারি ও সরকারপোষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে তা অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তদুপরি রয়েছে মালদহের মতো বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে স্কুলবাড়িগুলিকে বন্যার্তদের আশ্রয়শিবির বানিয়ে তোলা। সেই সময়ও স্কুলগুলির পঠনপাঠন কার্যত বন্ধই থাকে। যে কোনও বিপর্যয়ে যদি স্বাভাবিক পড়াশোনার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়, তবে পরপ্রজন্ম মানুষ হবে কী করে?
উপদ্রুত অঞ্চলগুলিতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি, যাতে ঘরছাড়ারা নির্ভয়ে নিজ অঞ্চলে ফিরে যেতে পারেন, স্কুলগুলিতে আবার ক্লাস শুরু হয়। শুধুমাত্র দুর্গতদের খাবার বিলি করাতেই প্রশাসনের দায়িত্ব শেষ হয় না। রাজনীতির আবর্জনার মাঝে স্কুলগুলিই এমন এক জায়গা, যেখানে আজও সন্দীপ-সোলেমান পাশাপাশি বসে শান্তিতে ক্লাস করে, মিড-ডে মিল খায়। এই কথাটি মনে রাখা রাজ্য প্রশাসনের এই মুহূর্তে প্রধান দায়িত্ব।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)