কংগ্রেসের মতে, সংবিধানের জয়। সংশোধিত ওয়াকফ আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে কয়েকটি মামলা ওঠার পর ভারতের সর্বোচ্চ আদালত তিনটি ধারায় স্থগিতাদেশ জারি করতে পারে বুঝে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই কয়েক পা পিছিয়ে গেল। কিসের জয় এই ঘটনার মধ্যে, তা যদি স্পষ্ট না-ও হয়— অন্তত পিছিয়ে যাওয়ার পরাজয়টি সরকারকে স্বীকার করতেই হবে। ওয়াকফ আইনের সংশোধন নিয়ে সংখ্যালঘু সমাজে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। নানা স্থানে সঙ্কট ছড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সংঘর্ষ সমগ্র দেশকে ত্রস্ত করেছে। এই সঙ্কটের একশো শতাংশ দায় কেন্দ্রীয় সরকারেরই। এত সংবেদনশীল একটি বিষয়ে এমন অসংবেদনশীল পদ্ধতিতে সংশোধনী আইন পাশ হল, কোনও উপযুক্ত বিতর্কের অবকাশ ছাড়াই সংখ্যাগুরুবাদী দল আইনটিতে সিলমোহর দিয়ে দিল। গোটা প্রক্রিয়াটিকে কোনও মতেই গণতন্ত্রসম্মত বলা চলে না। আশা করা যায়, সুপ্রিম কোর্টের প্রতিক্রিয়া দেখে কেন্দ্রীয় সরকার তা অনুধাবন করতে পারছে। স্থগিতাদেশ জারি করলে সরকারের মুখ যতখানি পুড়ত, আপাতত কয়েকটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসার ফলে তা কিয়দংশে সামাল দেওয়া গিয়েছে। তবে, ভারতীয় গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য যে, ওয়াকফ বোর্ড ও পর্ষদে অমুসলমানদের নিয়োগ করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে স্পষ্ট অপ্রসন্নতা দেখিয়েছে, পাল্টা প্রশ্ন করেছে, তার পরও কেন্দ্রীয় সরকার অবিচলিত। সংখ্যার জোর, শরিকদের সমর্থন, দেশের হিন্দু সমাজের এক বড় অংশের অন্ধ মুসলমান বিরোধিতা শাসক দলকে এতই বলীয়ান করে রেখেছে যে বিচারবিভাগের ভর্ৎসনাকেও তাঁরা অবলীলায় পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন। বড় মাপের নৈতিক পরাজয়কেও তাঁরা ‘আপাতত’ পরাজয় হিসাবে দেখতে পারেন।
সুতরাং, ‘আপাতত’ কেন্দ্রীয় ওয়াকফ পর্যদ ও রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে নতুন নিয়োগ করা হবে না, অমুসলমানদের আনা হবে না। যে সব সম্পত্তি দীর্ঘ দিন ধরে ধর্মীয় কাজে ব্যবহার হচ্ছে বলে ওয়াকফ হিসাবে চিহ্নিত, সেগুলি ওয়াকফের তালিকা থেকে বাদ যাবে না, তার চরিত্রও পাল্টাবে না। কেন্দ্রীয় সরকার লিখিত রিপোর্ট জমা দেওয়া পর্যন্ত ও ফের শুনানি হওয়া পর্যন্ত এই সাময়িক বন্দোবস্তই চলবে। তবে এরই মধ্যে সময়সুযোগ পেলে কেন্দ্রীয় সরকার ভেবে দেখতে পারে, বিচারবিভাগের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মূল উৎসটি কী ও কেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পদ নিয়ে বিচারবিবেচনার মধ্যে সেই সম্প্রদায়ের কাউকে প্রতিনিধি হিসাবে না রাখার সিদ্ধান্ত কতখানি গণতান্ত্রিক। কিংবা যে ভাবে অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের সম্পদের হিসাব হচ্ছে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্য সেই একই হিসাব না করাটা কতখানি নৈতিক।
বর্তমান শাসক পক্ষ সম্ভবত বলবে যে, প্রশ্নগুলি আদৌ উঠছে কেন, ওঠার দরকার কী। দেশের নাগরিক সমাজকেই উত্তরটি ভাবতে হবে। তাঁরা যদি মনে করেন, গণতন্ত্রের অর্থ— সমাজের বড় অংশটি অন্যান্য অংশের বিষয়ে যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা হলে বলতে হয়, গণতন্ত্রের অর্থ তাঁরা এখনও বোঝেননি। বোঝেননি যে, দেশের বড় বা ছোট যে কোনও সমাজের যে কোনও প্রথারই সংস্কার নিয়ে আলোচনা ও বিবেচনা চলতে পারে, কিন্তু সেই আলোচনা কোনও পক্ষের হয়ে অন্য পক্ষ করে দিতে পারে না, প্রক্রিয়াটিকে একটি গণতন্ত্রসিদ্ধ পথেই চালিত করা জরুরি। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির কাজ, এই যুক্তিটির প্রচার করা— কেবল ভোটের তাগিদের নয়, নৈতিকতার তাগিদে— জন স্টুয়ার্ট মিল বা আলেক্স ডি তোকভিলের ভাষায়, ‘টির্যানি অব দ্য মেজরিটি’ থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষার তাগিদে। অথচ এই ভারতে বিরোধী দলগুলিও আসলে শাসক দলের মতোই কেবল কোন পথে ভোট ও কোন দিকে ক্ষমতা— এই হিসাবেই মত্ত। রাজনীতির এই সর্বান্তঃকরণ অবনমন ও নৈতিক স্খলন আজ আক্ষরিক অর্থেই ভারতীয় সমাজকে খণ্ডিত-বিখণ্ডিত করতে বসেছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)