ছবি: সংগৃহীত
ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। স্বভাবতই বাঙালি হয়ে মনের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আলাদা একটি ভালবাসা একটি আবেগ অনুভব হয় এই দিনটিতে। প্রত্যেকটি দেশের মানুষেরা এই দিনটিতে তাদের মুখবিবর থেকে উচ্চারিত মাতৃসমা মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি আয়োজন করে নানা কর্মযজ্ঞের। একই সঙ্গে আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে মাতৃভাষাকে আরও সমৃদ্ধশালী আরও পরিশীলিত করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য কী কী করণীয় তার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক করা হয়। অন্য দেশের মতো ভারতেও এ দিন নানা অনুষ্ঠানে মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।
জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ভাষার বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙলিদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা মাতৃভাষা বাংলাভাষার স্বীকৃতি পাই। সেই আন্দোলনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ১৯৯৯ সালে নভেম্বর মাসে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করলে ২০০০ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সকল দেশে এই দিনটি পালিত হচ্ছে।
সারা বিশ্বে বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলা প্রায় ত্রিশ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভীষণই গর্বের। কিন্তু বেশ কয়েক দশক ধরে একটি বিতর্ক মাথাচড়া দেয় বাংলা কেন পড়ব, বাংলায় কেন বলব? আধুনিক যুব সমাজ ভবিষ্যতের কর্মজীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে বাংলা ভাষা তাদেরকে কতটা সুদূরপ্রসারী ফল দিতে পারবে? অসংখ্য প্রশ্নচিহ্নের মাঝে রেখে তৈরি হচ্ছে ইংরেজি ভাষাচর্চার প্রতি আগ্রহ আর সেই উত্তুঙ্গ আগ্রহের বশবর্তী হয়ে কি বাংলা ভাষাচর্চা কি ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে? বাংলায় কথা বলা, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান তা হলে সত্যিই কি জীবনের সাফল্যের পরিপন্থী?
এই সকল প্রশ্ন শুধু এখন নয়, ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবেশের পর থেকে চলে আসছে। এখন যুগ বদলেছে, সমাজ ও সময় বদলেছে। কিন্তু সমস্যা একই থেকে গিয়েছে।
যুগের চাহিদার সপক্ষে অবশ্যই বলতে হবে শিক্ষাগ্রহণের প্রাক্কালে ইংরাজিচর্চা বাদ দেওয়া ভীষণই কষ্টকর। ইংরেজি ভাষা বর্তমানে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের ভাষায় নয় এই বিশ্বায়নের যুগে সভ্যতার অগ্রগতির প্রধান ভাষা। তাই এই সময়ে ইংরেজি ভাষাচর্চা থেকে বিচ্যুত হওয়া মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। কিন্তু তাই বলে বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতির ভাষাকে রপ্ত করতে গিয়ে নিজের মাতৃভাষাকে দুয়োরানি করে রাখব— এটাও মেনে নেওয়া যায় না। বিশেষ করে, যখন আমরা বাঙালি। কেননা বিশ্বে যখন আমরা আঞ্চলিক ভাষাভাষী জাতি হিসাবে প্রথম দশের মধ্যে আছি। তবুও দিনের পর দিন বাংলা ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে এই সঙ্কট দেখা দিচ্ছে।
এই সঙ্কটমোচন হতে পারে কী ভাবে সেই সমাধান সূত্রে আমরা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হতে পারি। তিনি ‘বাঙ্গলা ভাষা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থে একটি প্রবন্ধে যা লিখেছিলেন তার সূত্র ধরে বর্তমানের যুগোপযোগী করে বললে বলা হয় যে, শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষাও যাতে ভাল করে শেখানো হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষার ভিতর দিয়ে বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার পথ করে দিলে তাদের শিক্ষার ভার যখন হাল্কা হবে তখন তারা আরও বেশি করে ইংরেজি শিক্ষায় মন ও শ্রম দিতে পারবে। অর্থাৎ, শিক্ষায় মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিতেই হবে।
মাতৃভাষায় শিক্ষা শিক্ষাক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তির মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারি। ‘জীবনস্মৃতি’তে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন— ‘‘ছেলেবেলায় বাংলা পড়িতে ছিলাম বলিয়াই সমস্ত মনটার চালনা সম্ভব হইয়াছিলো। শিক্ষা জিনিসটা যথাসম্ভব আহার ব্যাপারের মতো হওয়া উচিত। খাদ্যদ্রব্যে প্রথম কামড়টা দিবামাত্রেই তাহার স্বাদের সুখ আরম্ভ হয়, পেট ভরিবার পূর্ব হইতেই পেটটি খুশি হইয়া জাগিয়া উঠে—তাহাতে তাহার জারক রসগুলির আলস্য দূর হইয়া যায়। বাঙালির পক্ষে ইংরাজি শিক্ষায় এটি হইবার জো নাই। তাহার প্রথম কামড়েই দুপাটি দাঁত আগাগোড়া নড়িয়া উঠে— মুখবিবরের মধ্যে একটা ছোটখাটো ভূমিকম্পের অবতারণা হয়। তার পরে সেটা যে লোষ্ট্রজাতীয় পদার্থ নহে, সেটা যে রসে পাক করা মোদকবস্তু, তাহা বুঝিতে বয়স অর্ধেক পার হইয়া যায়। বানানে ব্যাকরণে বিষম লাগিয়া নাক চোখ দিয়া যখন অজস্র জলধারা বহিয়া যাইতেছে অন্তরটা তখন একেবারেই উপবাসী হইয়া আছে। অবশেষে বহুকষ্টে অনেক দেরিতে খাবারের সঙ্গে যখন পরিচয় ঘটে তখন ক্ষুধাটাই যায় মরিয়া। প্রথম হইতেই মনটা চালনা করিবার সুযোগ না পাইলে মনের চলৎ শক্তিতেই মন্দা পড়িয়া যায়।’’
উপরের লেখা থেকে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি যে জন্মের পরবর্তীকালে শিশুকে যখন প্রথম শিক্ষাদান করা হয় তখন সেই শিক্ষাদান যদি মাতৃভাষায় না হয়ে কোনও বিদেশি ভাষা হয় তা হলে সেই শিক্ষার যে তাড়াতাড়ি পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই কারণেই ১৯১৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তৎকালীন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পের জন্য লীডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাইকেল স্যাডলারকে বলেছিলেন ‘‘শিক্ষার উন্নতি করতে হলে সর্বাগ্রে চাই প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মাতৃভাষা আর দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে শেখাতে হবে ইংরাজী।’’
আমরা আরও দেখেছি বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও জগদিন্দ্রনাথ রায় থেকে শুরু করে জগদীশচন্দ্র বসু, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রাজশেখর বসুর মতো অনেক বিজ্ঞানী বাংলাভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করেছিলেন। আচার্য সত্যেন বসু বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য গঠন করেছিলেন ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ এবং সেখানকার মাসিক মুখপত্র ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে যার কথা আরও স্মরণে আসে তিনি হলেন ডঃ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, যিনি উদ্ভিদ কীটপতঙ্গের উপরে গবেষণার ফল তাঁর মাতৃভাষা বাংলাতেই লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
কিন্তু বাংলায় বিজ্ঞানচর্চায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হল উপযুক্ত পরিভাষার। সে ক্ষেত্রে সকলেই মোটামুটি একমত যে, যেখানে উপযুক্ত পরিভাষা পাওয়া যাবে না সেখানে ইংরেজি শব্দ রেখে দিলে সমস্যার সমাধান অনেকটা হয়।
মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের সুফল প্রসঙ্গে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন— ‘‘মাতৃভাষায় শিক্ষা হইলে আমাদের প্রথম লাভ হইবে-সাধারণ ছেলেদের পক্ষে জ্ঞান অর্জনের পথ সহজ হইবে, অল্পেই তাহাদের বুদ্ধি খুলিবে। মাতৃভাষার মধ্যে দিয়ে শিক্ষার কোনও ফাঁকি চলিবে না। শিক্ষক হয়তো অনভিজ্ঞ, তার আবার ইংরাজি ভাষায় লেখা বই বা ইংরাজি ভাষা আশ্রয় করিয়া ব্যাখ্যা; ছাত্রও সব সময়ে এই ভাষা ভালো করিয়া বুঝে না এবং বুঝে না বলিয়াই ভয়ে চুপ করিয়া থাকে।..... কিন্তু মাতৃভাষায় বই পড়িয়া মাতৃভাষায় ভাবপ্রকাশ করিবার উদ্দেশ্য লইয়া শিখিতে আরম্ভ করিলে, ছাত্রেরা বুঝিবার বয়স হইতেই সহজে বুঝিতে পারিবে যে তাহাদের জ্ঞান লাভ হইতেছে কিনা, তাহাদের চিন্তাপ্রণালী মার্জিত হইবে, শিক্ষায় আনন্দ তাহারা পাইবে, শিক্ষা তাহারা সম্পূর্ণরূপে আত্মসাৎ করিতে পারিবে, শিক্ষা সত্য সত্যই তাহাদের মনের খোরাক জোগাইবে। এখন যে শিক্ষা ছেলেরা পায়, তাহাতে সামান্য একটু মুখস্ত করা বিদ্যা হয় মাত্র; ছেলেরা ইস্কুল কলেজ ছাড়িলেই যত শীঘ্র সম্ভব অতীত বিদ্যা ভুলিয়া যায়, মনে যেটুকু ছাপ পড়ে,তাহা নিতান্ত উপর উপর পড়ে।’’
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সময় থেকে বর্তমান সময়ের শিক্ষাপ্রণালির যে বিশেষ কোনও পরিবর্তন এসেছে সেটা জোর গলায় বলা চলে না।
তবুও আশার আলো দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক বাঙালি এখন তার নিজের মাতৃভাষায় কথা বলা, চর্চা করতে এগিয়ে আসছে। লোকদেখানো অপ্রয়োজনীয় হিন্দি, ইংরাজির স্থলে বাংলায় স্বচ্ছন্দ হচ্ছে, বাংলাটা ধীরে ধীরে তাদের কাছে আসছে। এই পরিবর্তনের মূলে অনেকাংশই অবদান রয়েছে যেমন নতুন বাঙালি হয়ে ওঠার তেমনই সোশ্যাল মিডিয়ারও। নবীন, যুবা, বয়স্কেরাও ইংরেজি-বাংলা রোমান হরফ ছেড়ে বাংলায় লিখে মনের ভাব প্রকাশ করছে। এগিয়ে আসছে প্রযুক্তিবিদেরা। কারণ বিশ্বের প্রায় ত্রিশ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষাকে সম্মান জানানো ছাড়া উপায়ও যে নেই। সময় এসেছে মোড় ঘোরানোর, এ বার আবারও প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের দিকে।
শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy