হিন্দু মুসলিম শিখ ইসাই/ আপস মে হ্যায় ভাই ভাই। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’— ভারতের নানা অঞ্চলের গলি থেকে রাজপথে প্রতিধ্বনিত এই স্লোগান আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সংগঠিত প্রতিরোধের অতীত মুহূর্তগুলিতে। আমাদের দায়িত্ব এই ঐতিহাসিক সময়ের তাৎপর্য অনুধাবন করা। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম ‘সেকুলার’ শব্দটি উপর থেকে রাজনৈতিক নেতা এবং বুদ্ধিজীবীদের চাপিয়ে দেওয়া একটি স্লোগান এবং নীতিকথা হয়ে না থেকে এক সংগ্রামের আহ্বান হয়ে উঠেছে, যে আহ্বান উঠে এসেছে নীচের তলা থেকে, নাগরিকদের নিজস্ব অনুভূতি থেকে, সিএএ-এনআরসি চালু হলে যে নাগরিকেরা অনেক কিছু হারাবেন।
প্রায় দেড়শো বছর আগে আর্ন্স্ট রেনান মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘(এমনকি) ঐতিহাসিক ভুলকে ...ভুলে যাওয়াটা নেশন নির্মাণের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।’ আমরা কি ভুলে গিয়েছি যে, সেকুলারিজ়ম-এর সমালোচনা বরাবর করা হয়েছে এই বলে যে তা হল উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটি আদর্শ?
১৯৪৭-এর নভেম্বরে মহাত্মা গাঁধী শেষ বারের মতো জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক মুনশিয়ানা নিয়ে তাঁকে সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রশ্নে বিরূপ গণ-আবেগের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। দেশভাগ সত্ত্বেও, কিংবা দেশভাগের কারণেই, তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন: “ভারত বরাবর একটি মৌলিক ঐক্যের দেশ ছিল, এখনও আছে। এই মহান দেশকে একটি গণতান্ত্রিক সেকুলার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলাকেই কংগ্রেস আপন লক্ষ্য বলে মনে করেছে— এমন এক দেশ যেখানে সমস্ত নাগরিক তাঁদের মৌলিক অধিকারগুলি ভোগ করেন, তাঁদের ধর্মপরিচয় নির্বিশেষে রাষ্ট্রের কাছে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার যেখানে স্বীকৃত। গণপরিষদ একে ভারতীয় সংবিধানের মূল নীতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই আদর্শকে মর্যাদা দেওয়া প্রতি ভারতবাসীর কর্তব্য।’’
গাঁধী ‘সেকুলার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। একের পর এক প্রার্থনাসভার শেষে তিনি জোর দিয়ে বলে চলেছিলেন, মুসলমানদের জন্য দিল্লিতেই জায়গা আছে, থাকবে, ভয়, হিংসা আর অগ্নিকাণ্ডের তাড়নায় তাঁদের যে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে হয়েছে সেখান থেকে তাঁদের নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এই সব কথা বলার কারণে তাঁকে কালো পতাকা দেখানো হচ্ছিল, যুবকেরা দল বেঁধে ‘গাঁধী মুর্দাবাদ’ বলে তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল। দেশভাগ-লাঞ্ছিত উত্তর ভারতে ঘটে-চলা হিংসার মধ্যে তাঁর কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝেই খুব নিঃসঙ্গ শোনাচ্ছিল। তাই খুব স্বাভাবিক মনে হয় যখন দেখি, ১৯৪৬-এর শেষে নোয়াখালির পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি আপন মনে গুনগুন করছেন রবীন্দ্রনাথের ‘একলা চলো রে’। উনিশশো সাতচল্লিশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁর অবিচল দায়বদ্ধতা ছিল নৈতিকতায় এবং আদর্শে যথাযথ। সেই আদর্শেই নিষিক্ত ছিল এমন এক দেশ তৈরি করার আকাঙ্ক্ষা, যেখানে সমস্ত ধর্মগোষ্ঠীর মানুষ সমান মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে বাস করতে পারবেন। এই আকাঙ্ক্ষা ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতাদের পথ দেখিয়েছিল।
প্রায় তিন দশক পরে, ১৯৭৬ সালে ইন্দিরা গাঁধী যখন সংসদের দুই সভায় ৫৯টি অনুচ্ছেদ সংবলিত ৪২তম সংবিধান সংশোধনী বিলটি পেশ করেন, তাঁর বিরোধীরা বলেছিলেন, সংবিধান সংশোধনের অধিকার তাঁর নেই। দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাঘম-এর এরা সেঝিয়ান শ্রীমতী গাঁধীকে মনে করিয়ে দেন, তাঁদের বেশ কিছু সহকর্মীকে তিনি গ্রেফতার করেছেন, এই দীর্ঘ বিলটি নিয়ে আলোচনার কোনও সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয়নি, তিনি হিটলারের মতো সংবিধানকে কাজে লাগিয়ে সংবিধান পাল্টে দিতে চাইছেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না। পরে, প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে লেখা চিঠিতে ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতি পি বি গজেন্দ্রগডকর লিখেছিলেন, ওই বিলটি অস্বাভাবিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলেই তিনি শ্রীমতী গাঁধীকে তা নিয়ে জাতীয় বিতর্ক আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধন করে ভারতকে ‘সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, সেকুলার, সমাজতন্ত্রী প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণার প্রস্তাবটি ছিল এই বিভিন্ন অংশের অন্যতম। ইন্দিরা গাঁধী সেকুলার বলতে কী বোঝেন, গজেন্দ্রগডকর তাঁকে সেটা পরিষ্কার করতে বলেছিলেন।
লোকসভা ও রাজ্যসভায় সে দিন যে বিতর্ক হয়, সেটাই বলে দেয়, ‘সেকুলার’ শব্দটি কতটা ইতিবাচক আবেগ এবং মর্যাদা অর্জন করেছিল। জনসঙ্ঘ, কমিউনিস্ট পার্টি, মুসলিম লিগ, রিপাবলিকান পার্টি অব ইন্ডিয়া, ডিএমকে, ইন্দিরা গাঁধীর কংগ্রেস— বিভিন্ন জাতি, জনজাতি এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি এই সব দলের সদস্যেরা দাবি জানিয়েছিলেন, সরকার ‘সেকুলার’ বলতে ঠিক কী বোঝাতে চাইছে সেটা স্পষ্ট করে বলুক, যাতে ‘আমাদের গণতন্ত্রের বিষয়বস্তু আরও সুদৃঢ় হয় এবং আরও সেকুলার হয়।’ (এই তীক্ষ্ণ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন সিপিআইয়ের ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত।) পরে মোরারজি দেশাইয়ের সরকার ইন্দিরা গাঁধীর আনা কয়েকটি সংবিধান সংশোধনী রদ করিয়েছিলেন, কিন্তু প্রস্তাবনার এই সংশোধনীটিতে হাত দেওয়া হয়নি। সেকুলারিজ়ম-এর আকাঙ্ক্ষার প্রতি তখন সত্যিকারের একটা আকর্ষণ ছিল, বহু দলের বহু মতের মানুষের মন তাতে সাড়া দিত।
১৯৭৬ সালে ভারতের সেকুলার হতে চাওয়ার অর্থ ঠিক কী ছিল? প্রশ্নটা মূল্যবান, কারণ অন্তত উচ্চকোটির সাংসদদের স্তরে এ বিষয়ে ঐকমত্য ছিল যে, সেকুলার আদর্শটা ভাল, সত্যিই ভাল। একের পর এক সদস্য সংসদে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা করলেন যে, ভারতে সেকুলার মানে ‘ঈশ্বরবিরোধী নয়, ধর্মবিরোধীও নয়’, কথাটার মানে হল সমস্ত ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এবং সেই কারণেই বেশ কিছু সদস্য আইনমন্ত্রীকে অনুরোধ করলেন, সংবিধানের সংশোধিত প্রস্তাবনাটির হিন্দি অনুবাদ তৈরি করার সময় সেকুলার-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি ব্যবহার না করতে (শেষ পর্যন্ত সেকুলারের তর্জমা হয় ‘পথ-নিরপেক্ষক’)। আইনমন্ত্রী এইচ আর গোখলে এই সব চিন্তাভাবনাকে বিশেষ কোনও রাখঢাক না করে উড়িয়ে দিলেন। সংবিধান পরিবর্তন বিষয়ক কংগ্রেস কমিটির প্রধান, সর্দার স্বর্ণ সিংহ বললেন, ‘‘আমি মনে করি, ‘সেকুলার’ শব্দটি এখন আমাদের ভারতীয় ভাষাগুলিতে জায়গা করে নিয়েছে। কি পঞ্জাব, কি গুজরাত, কি দক্ষিণ ভারত, যেখানেই যান, দেখবেন স্থানীয় মানুষেরা নিজেদের ভাষায় যখন বক্তৃতা করেন, তখনও ‘সেকুলার’ শব্দটিই ব্যবহার করেন। তার কারণ, এই শব্দের একটা নির্দিষ্ট অর্থ স্বীকৃতি পেয়েছে— অর্থটি হল এই যে, আমাদের সংবিধানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে আইনের চোখে সমান গণ্য করার নির্দেশ আছে।... এর মধ্যে কোনও ধর্মবিরোধী মনোভাবের স্থান নেই, এটি বাস্তবিকই সর্বধর্মে সমভাবের ধারণা।’’
কিন্তু এর পাশাপাশি অন্য একটা ব্যাপারও লক্ষণীয়। খুরশেদ আলম খানের মতো কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতা, কমিউনিস্ট পার্টির ভূপেশ গুপ্ত এবং ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, রিপাবলিকান পার্টির এন এইচ কুম্ভারে প্রমুখ সাংসদেরা সংবিধান সংশোধন করে কয়েকটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব দিলেন। যেমন, শিক্ষায় ও চাকরিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণ চালু করা, সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা, এমন ব্যবস্থা করা যাতে তফসিলি জাতি ও জনজাতির মানুষ হিন্দু বা শিখ ধর্ম ছেড়ে গেলে সেটা তাঁদের সংরক্ষণ পাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি না করে। এই প্রস্তাবগুলি কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদের সমর্থন পেল না। ওই সাংসদেরা যখন দাবি করলেন যে, সরকার সেকুলার কথাটার মানে স্পষ্ট করে বলুক এবং সংবিধানের প্রস্তাবনায় এই শব্দটি যোগ করে ঠিক কী করতে চাইছে সেটা বোঝানোর জন্য (সংখ্যালঘুদের জন্য) কার্যকর সুযোগসুবিধা ও রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করুক, তখন কিন্তু তাঁদের সামনে প্রতিরোধের প্রাচীর তুলে দেওয়া হল, বলা হল ইন্দিরা গাঁধীর ওপর ভরসা রাখতে, সংখ্যালঘুদের জন্য যা করার তিনি করবেন, এবং তাঁদের সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবগুলিকে ভোটে হারিয়ে দেওয়া হল। সংবিধান সংশোধনের সরকারি প্রস্তাবের ওপর যতগুলো কার্যকর সংশোধনী আনা হয়েছিল, প্রত্যেকটি নাকচ হয়ে গেল। বোঝা গেল, প্রস্তাবনায় ‘সেকুলার’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে সেকুলারিজ়ম-এর ধারণাটিতে মৌখিক সমর্থন জানানোর কৌশল হিসেবে।
তা হলে, আজ দেশ জুড়ে সিএএ-এনআরসি-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত নাগরিকেরা যে প্রায় প্রার্থনার মতো করে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করছেন— ভারতের ইতিহাসে এ এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত। নিজের ধর্মপরিচয়ের সঙ্গে সৌভ্রাত্রবোধের জয়ধ্বনি দিয়ে এমন স্লোগান হিন্দি ফিল্মের জগতের বাইরে কখনও শোনা যায়নি। আজ যদি আমরা স্মরণ করি যে, সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সেকুলার’ শব্দটি যোগ করার সঙ্গে সঙ্গে সে দিন যে সব কার্যকর পরিবর্তনের কথা অনেকেই ভেবেছিলেন, বাস্তবে সেগুলি আনতে দেওয়া হয়নি, তা হলে সেটা সেকুলারিজ়মকে একটা জন-আকাঙ্ক্ষার বিষয় হিসেবে পুনরুদ্ধারের কাজে আমাদের সহায় হতে পারে। সেকুলারিজ়ম-এর ওপর বরাবর অনেক বোঝা চাপানো হয়েছে, সেই বোঝা সে বইতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে যে সব দাবি এবং প্রত্যাশা মেটেনি, মেটানোর চেষ্টাও হয়নি, সেগুলোই হয়ে উঠতে পারে আলোকবর্তিকা, যা হয়তো আমাদের সুড়ঙ্গ থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে। তবে সেকুলার ভারতের জন্য যে লড়াই, সেটা সাধারণ মানুষকেই লড়তে হবে, সে লড়াই জেতার দায় তাঁদেরই। রাজনীতিকদের কাছে তাঁরা জোরদার এবং নির্ভরযোগ্য সমর্থন পাবেন বলে ভরসা হয় না।
ইতিহাসবিদ, ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy