অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে একের পর এক উল্লেখযোগ্য ইউরোপীয় শিল্পীর গন্তব্য হয়ে উঠেছিল প্রবাদপ্রতিম ঐশ্বর্যের দেশ ভারত। টিলি কেটল থেকে জোহান জোফানি, জর্জ চিনেরি-র মতো চিত্রশিল্পীদের এই ভারত অভিযানের লক্ষ্য ছিল ধনী ও প্রভাবশালীদের ছবি এঁকে চটজলদি রোজগার করা। তবে এ দেশের সাধারণ মানুষ ও তাঁদের জীবনযাত্রাকে উপজীব্য করেও ছবি এঁকেছিলেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিল্পী। তাঁদের প্রথমেই মনে পড়ে ফ্রান্জ় বালথাজ়ার সলভিন্স-এর নাম।
তবে এ পথে সলভিন্সের এসে পড়া অন্য ঘটনার সূত্রে। তখনকার প্রশাসনিক নিয়ম অনুযায়ী এ দেশে এসে কোনও পেশায় যুক্ত হতে গেলে সরকারি অনুমতি বাধ্যতামূলক ছিল। বেলজিয়ামের অভিজাত পারিবারের সন্তান হয়েও নানা কারণে সলভিন্স অনুমতিপত্র জোগাড়ে ব্যর্থ হন। ফলে অভিজাত সমাজের দরজা তাঁর জন্য বন্ধ হয়ে যায়। অন্য বহু শিল্পী যা পেয়েছিলেন, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সেই সদস্যপদও দেওয়া হয়নি তাঁকে। এই ‘প্রান্তিক’ অবস্থানের ফলে ধনী পৃষ্ঠপোষক না পাওয়ায় প্রাসাদ-অট্টালিকার অন্দরমহলের বদলে তাঁর আনাগোনা শুরু হয় ইউরোপীয় শিল্পীদের নজরের বাইরে থাকা ‘নেটিভ টাউন’ ও শ্রমজীবী পল্লিতে।
১৭৯১ থেকে প্রায় এক দশক কলকাতা ও বাংলার নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে আঁকা সলভিন্সের ছবিতে উঠে এল নানা পেশার মানুষ— তাঁতি, কামার, কুমোর, পালকিবাহক, ভিস্তি, সাফাইকর্মী থেকে মাঝিমাল্লা, গাইয়ে-বাজিয়েদের আটপৌরে জীবন। ফলে কালের মূল্যায়নে সফল চিত্রশিল্পীর পাশাপাশি ইউরোপীয়দের মধ্যে কলকাতার এদেশীয় জনজীবনের নৃতাত্ত্বিক তথ্যের প্রথম দিকের সঙ্কলক হওয়ার স্বীকৃতিও পেলেন সলভিন্স।
বালথাজ়ার সলভিন্সের নির্বাচিত কাজ নিয়ে আলিপুর মিউজ়িয়মে আগামী ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে প্রদর্শনী, ‘পিপল অব বেঙ্গল: কালার্ড এচিংস অব বালথাজ়ার সলভিন্স’। দিল্লি আর্ট গ্যালারি (ডিএজি) আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে তৎকালীন বাংলার নানা পেশার মানুষ ও অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে তাদের উৎসব, পালা-পার্বণ, সামাজিক পরিবেশের ছবি। সে সময় প্রচলিত নানা জলযান, বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও দেখা যাবে পশুপাখি ও গাছপালা, শিল্পীর পর্যবেক্ষণে উঠে আসা।
বঙ্গদেশ সম্পর্কে সে সময়কার ইউরোপীয় শিল্পীদের স্বভাবগত জাত্যভিমান ও উন্নাসিকতার পরিবর্তে সলভিন্সের তুলিতে ফুটে ওঠে সাধারণের প্রতি সহমর্মিতা, দরদ। কখনও লঘু চালে, কখনও বিষণ্ণতার মোড়কে উন্মোচিত হওয়া বালথাজ়ার সলভিন্সের দুনিয়া আমাদের ছবি দেখার আনন্দ তো দেয়ই, পাশাপাশি সে কালের সমাজ-ইতিহাসকে বোঝার ক্ষেত্রেও জরুরি হয়ে ওঠে। জাইলস টিলটসনের কিউরেশনে সেজে ওঠা প্রদর্শনীটির প্রিভিউ আলিপুর মিউজ়িয়মে আগামী ২৫ জুলাই বিকেল ও সন্ধ্যায়, চলবে ৫ জুলাই পর্যন্ত।

জন্মদিনে
অলিম্পিক্সের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে চিন্তামণি করের (ছবি) কীর্তি-কথা। প্রখ্যাত এই বাঙালি ভাস্কর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন, লন্ডনে ছিলেন ১৯৪৬-৫৬। তারও আগে ছিলেন প্যারিসে, আর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা তো এই কলকাতায়, ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট-এ। ১৯৪৮-এর লন্ডন অলিম্পিক্সের অঙ্গ ছিল শিল্প প্রতিযোগিতাও, সেখানে গ্রেট ব্রিটেনকে রুপোর পদক এনে দেয় তাঁর ভাস্কর্য ‘দ্য স্ট্যাগ’। দেশে ফেরার পর, দীর্ঘকাল অধ্যক্ষ ছিলেন সরকারি আর্ট কলেজের, প্রয়াত হন ২০০৫-এ। পদ্মভূষণ, দেশিকোত্তম-সহ নানা সম্মানে ভূষিত এই শিল্পীর স্মৃতি ও কৃতি ধরে রেখেছে কলকাতার দক্ষিণে নরেন্দ্রপুরের কাছে ভাস্কর ভবন। আজ, ১৯ এপ্রিল, শিল্পীর ১১১তম জন্মদিনে ভাস্কর ভবন মিউজ়িয়মের আমিনা কর গ্যালারিতে প্রদর্শনী ও অনুষ্ঠান সন্ধে ৭টায়, সর্বভারতীয় চারুকলা মন্দির ও ভাস্কর ভবন ট্রাস্ট-এর আয়োজনে। থাকবেন শিল্পজগতের বিশিষ্টজন।
চা-বাগান থেকে
কলকাতা থেকে বহুদূরে, উত্তরের চা-বাগানে আছে যে শিশুরা, আমরা কি মনে রাখি তাদের? চা-বাগানের শ্রমজীবী বাবা-মায়েদের জীবনের অনিশ্চয়তার ভার বইতে হয় তাদের, ফল: স্কুলছুট, কাজে ঢুকে পড়া, কমবয়সে বিয়ে। এই শিশুদের স্বপ্ন, অধিকার, সরকারের দায়িত্ব ইত্যাদি উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগ প্রকাশিত ছোটদের পত্রিকা হুল্লোড়-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায়। সেখানে লিখেছে ছোটরাও: গ্রাসমর চা-বাগানের আনারুদ মুন্দার ভাল লাগে অঙ্ক, টুয়েলভের মুসকান ভুজেলের স্বপ্ন নৃত্যশিল্পী হওয়ার, ক্লাস টেনের খুশবু প্রধানমন্ত্রী হলে গ্রামে রাস্তা তৈরি করে দেবে যাতে ছোটদের ইস্কুলে যেতে অসুবিধা না হয়।
সময়ের ছবি
বিচ্ছিন্নতা, অভিবাসন-সহ নানা অস্ত্রে আধিপত্যকামীরা যে ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে অমানবিকতার দিকে, তারই চালচিত্র ২২তম কল্পনির্ঝর আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রোৎসবে— কল্পনির্ঝর ফাউন্ডেশনের তরফে বলছিলেন এস ভি রামন। এই ফাউন্ডেশন এবং গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট-ম্যাক্সমুলার ভবন কলকাতার যৌথ উদ্যোগে উৎসবের ছবিগুলি ২১-২৫ এপ্রিল রোজ বিকেল ৪টে থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত দেখানো হবে, পার্ক ম্যানসনে গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট প্রেক্ষাগৃহে। স্পেন বেলজিয়াম জার্মানি ফ্রান্স বুলগেরিয়া আমেরিকা চিলি, নানা দেশের ছবি, সঙ্গে ‘কল্পনির্ঝর রেট্রো’য় থাকছে স্মৃতিমেদুর একটি প্যাকেজ। উদ্বোধনী ছবি কঙ্কনা চক্রবর্তীর রি-রুটিং, শেষ হবে অশোক বিশ্বনাথনের সাম্প্রতিকতম ডিসট্যান্সেস দিয়ে।
রাতের আকাশে
রাতের সব তারাই দিনের আলোর গভীরে আছে সে তো জানা কথা, তবে টেলিস্কোপ দিয়ে রাতের আকাশে গ্রহ-তারা দেখতে পারার আলাদাই এক রোমাঞ্চ। এই শহর ও রাজ্যের বিজ্ঞানপড়ুয়া আর বিজ্ঞানাগ্রহী সকলের জন্য সে ব্যবস্থাও করছে বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজ়িয়ম (বিআইটিএম)। ১৮-২০ এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে তাদের আয়োজনে মিউজ়িয়ম প্রাঙ্গণেই হবে ‘অ্যাস্ট্রো ইভনিং’, যার অন্যতম অঙ্গ এই ‘স্কাই-ওয়াচিং’, টেলিস্কোপ তাক করে গ্রহ-নক্ষত্র দেখা। এ অবশ্যই সন্ধ্যা তথা রাতের আকাশ পরিষ্কার থাকার উপর নির্ভরশীল, কে না জানে। সঙ্গে থাকবে ‘জুয়েলস ইন দ্য স্কাই’ শিরোনামে স্পট কুইজ়, আর আগামী কাল রবিবার হবে কর্মশালা— ‘প্ল্যানেটস ইন ইয়োর পকেট’।
নাট্যোৎসব
দশ বছর জুড়ে থিয়েটারের মতো একটি সজীব চলিষ্ণু শিল্পধারার চর্চায় ব্যাপৃত থাকা, তার শৈল্পিক ফসল মানুষের অঙ্গনে বিতরণের কাজটি সহজ নয়। সে কাজে ‘নৈহাটি ব্রাত্যজন’ সফল। এই সাফল্য উদ্যাপন করতেই আগামী ২৫-৩০ এপ্রিল অ্যাকাডেমি মঞ্চে এই নাট্যগোষ্ঠীর আয়োজনে নাট্যোৎসব; ২৫ তারিখ বিকেল ৫টায় উদ্বোধন করবেন ব্রাত্য বসু, পরে অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় দাদার কীর্তি-র শততম অভিনয়। পরের দিনগুলিতে দুপুর ৩টে ও সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এই সময়ের প্রতিষ্ঠিত নানা নাট্যদলের এক গুচ্ছ প্রযোজনা: কল্পনার অতীত, আনন্দ, রাণী কাদম্বিনী, ফেরারী ফৌজ, দায়বদ্ধ, টিনের তলোয়ার, আন্তিগোনে, বেসরকারী, এক মঞ্চ এক জীবন ও বসন্ত বিলাপ। এ ছাড়াও রোজ বিকেল ৫.১৫ থেকে নাট্যজগতের বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে ‘অঙ্গন কথোপকথন’, নাটকের গানও।

বহমান
মূলনিবাসী জনগোষ্ঠীগুলির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল, জীবনকে দেখার অনন্য দৃষ্টিকোণ। সৃষ্টির আদি নিয়ে এই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে, জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ ও সভ্যতার যাত্রাকেও ওঁরা দেখেন স্বতন্ত্র ভাবে। গল্প বলা, গান বাঁধা আর ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে এই দর্শন বহতা প্রজন্মান্তরে। ভারতের অন্যতম প্রাচীন জনগোষ্ঠী সাঁওতালরা তাঁদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় বাঁচিয়ে রেখেছেন কথ্য ও লেখ্য সাহিত্যে, চিত্রকৃতিতে (ছবি)। ১৮ এপ্রিল বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস উপলক্ষ্যে ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়মের দোতলায় সেই সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ, ছবি গল্প ইন্সটলেশনে সেজে ওঠা এক প্রদর্শনীতে। দক্ষিণ কলকাতার শিল্পচর্চা প্রতিষ্ঠান ব্রিজিং কালচার অ্যান্ড আর্ট ফাউন্ডেশনের (বি-সিএএফ) একটি প্রকল্পের অঙ্গ এই আয়োজন। দেখা যাবে আগামী ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত, সোমবার বাদে।

স্বতন্ত্র
কলেজবেলায় জোড়াসাঁকো, চিৎপুর, পোস্তা বাজার, উত্তর কলকাতার ঘিঞ্জি রাস্তা, ট্রাম-বাস ছিল ছবির রসদ। সেই জন-অরণ্য ছেড়ে শান্তিনিকেতনে এসে প্রকৃতিকে চিনতে-বুঝতে শেখেন সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রভারতীর স্নাতক, ন্যাশনাল স্কলার হিসাবে কলাভবনে আসেন ১৯৭৫-এ। পরে বিশ্বভারতীতেই শিক্ষকতা, সেখানেই অবসর গ্রহণ। সঙ্গে চলেছে আলপনা-চর্চা: নন্দলাল বসু কিরণবালা দেবী গৌরী ভঞ্জ যমুনা সেন ননীগোপাল ঘোষ প্রমুখ যে ভাবে আলপনাকে করে তুলেছিলেন প্রকৃতিপাঠের গুরুত্বপূর্ণ বাহক, তার সার্থক উত্তরসূরি তিনি, শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রাঙ্গণ, প্রার্থনামন্দির তাঁর আলপনায় সেজে উঠেছে দীর্ঘদিন। শিল্পীর কাজের প্রদর্শনী এ বার কলকাতায়, মায়া আর্ট স্পেস-এ। মণ্ডনধর্মিতা, স্থাপত্যগুণ ও প্রকৃতিনির্ভরতার সমন্বয় তাঁর কাজ (ছবি)। আগামী ২৫ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টায় উদ্বোধনে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়; ১ মে পর্যন্ত, দুপুর ২টো-রাত ৮টা।
তন্নিষ্ঠ
ছাত্রজীবনে আনন্দমোহন বসুকে নিয়ে আগ্রহ অর্ণব নাগকে নিয়ে আসে ব্রাহ্মসমাজে। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের লাইব্রেরিতে মগ্ন থাকতেন কাজে, সমাজের মুখপত্র তত্ত্ব-কৌমুদী পত্রিকার সম্পাদক এই তরুণ গবেষক ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস তুলে ধরেছেন নবপ্রজন্মের সামনে। তাঁর সম্পাদনায় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ থেকে প্রকাশিত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের রামমোহন ও ব্রাহ্ম সমাজ, আনন্দমোহন বসু: জীবন ও কর্ম প্রভৃতি; অন্য প্রকাশনা থেকেও কত না লিখিত ও সম্পাদিত বই: রাজনারায়ণ বসুর গ্রাম্য উপাখ্যান, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের রচনা সংগ্রহ, রমাপ্রসাদ চন্দের রাজা রামমোহন রায় প্রভৃতি। প্রচারবিমুখ, সুশান্ত মানুষটি মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে চলে গেলেন গত ১০ এপ্রিল। আগামীকাল রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ২১১ বিডন স্ট্রিটে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে তাঁর স্মরণসভা, বলবেন শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় আশিস খাস্তগীর ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী অমিত দাস-সহ ওঁর গুণমুগ্ধেরা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)