কোভিড অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গ চলাকালীন অর্থনীতিবিদেরা খানিকটা মধ্যপন্থা রেখেই আর্থিক বৃদ্ধি সম্পর্কে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। বেশির ভাগ ব্যাখ্যাকর্তাই স্বীকার করেছেন, এই বছরের শেষে অর্থনীতি তার দু’বছর আগের অবস্থানেই ফিরে যাবে। এখন প্রশ্ন, তার পর কী হবে? কেউ কি দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধির আশা করবেন, নাকি এক মধ্যমানের অবস্থান থেকে হতাশার জন্ম হবে? এর উত্তর খুঁজতে হলে আর্থিক বৃদ্ধির সাম্প্রতিক হার খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
প্রথম মনে রাখতে হবে যে, কোভিডের আগে বৃদ্ধির গতি ধীরই ছিল। মোদী-জমানার তুঙ্গ সময়ে এই হার ছিল ৮ শতাংশ। ২০১৯-’২০ নাগাদ তা কমে অর্ধেক হয়ে নেমে আসে ৪ শতাংশে। দ্বিতীয়ত, গত তিন বছরে সরকারি ক্ষেত্রে কেনা-বেচার কারণে তা খানিকটা বেড়ে গিয়ে হয়েছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। সেই একই সময়ে অসরকারি কেনা-বেচার নিরিখে তা ছিল ২.১ শতাংশ। স্থায়ী পুঁজিতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল বেশ খারাপ। গত তিন বছরের তুলনায় ৮.৭ শতাংশ কম। যা থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, মন্দাকালীন পরিস্থিতিতে আর্থিক বৃদ্ধির প্রাথমিক গতিটাই এসেছিল সরকারি ক্ষেত্র থেকে। কিন্তু এই অবস্থানকে ঝুঁকিবিহীন অবস্থায় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। যখন সরকারি ঋণ মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) দুই তৃতীয়াংশ থেকে বেড়ে ৯০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছয়।
তৃতীয়ত এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কর্মনিযুক্তির ক্ষেত্রে ক্রমাবনতির প্রবণতা এবং বৈষম্যের ক্রমবৃদ্ধি অসরকারি ক্ষেত্রে কেনাবেচাকে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় এসে পৌঁছতে বাধা দেয়। কর্মনিযুক্ত হতে ইচ্ছুক জনসংখ্যার পরিমাণও কমে। এমন পরিস্থিতিতে বেকারত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এবং যাঁরা প্রকৃত কর্মনিযুক্ত ছিলেন, যাঁরা কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন (আসলে কম পারিশ্রমিকের নিযুক্তিকরণ), তাঁদের সংখ্যা বাড়ে। কারণ, এই সময়ে শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভাবে চাকরির সুযোগ উদ্বায়িত হয়। এমন অবস্থাতেই বেশির ভাগ মানুষ তাঁদের ব্যয়ক্ষমতার স্বাভাবিক প্রবণতাকে রক্ষা করতেই হিমশিম খেতে শুরু করেন। যদি আর্থিক ভোগমাত্রার বৃদ্ধি খুব ধীর গতির হয়, বর্তমান উপযোগ-ক্ষমতার নিচু মাত্রা নবীকৃত হয়ে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে কমপক্ষে ২-৩ বছর সময় লাগবে। এই মধ্যবর্তী সময়ে বিনিয়োগের হার কম থাকায় সার্বিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দ্রুত গতিছন্দ আশা করাই যায় না।যদি না কেউ দেশীয় চাহিদার ঘাটতি পূরণে রফতানি চাহিদার বৃদ্ধিকে কাজে লাগান। এখন অবশ্য এটা আশা করাই যায়। কারণ, বিশ্ব-অর্থনীতির মধ্যে একটা পুনরুজ্জীবনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাণিজ্য বাড়ছে এবং পশ্চিম গোলার্ধের অর্থনীতি চিনকে পাশ কাটিয়ে সরবরাহের অন্য সূত্র খুঁজে পেতে চাইছে। কিন্তু এই সুযোগকে কাজে লাগাতে গেলে রফতানিকারীদের সাহায্য করা প্রয়োজন। এখন এই ‘আত্মনির্ভর’ তকমা লাগানো প্রচার সেই সহায়তার বাতাবরণ কতটা তৈরি করতে পারে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
তবে এর পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেরও সম্প্রসারণ প্রয়োজন। কেউই চায় না যে, ভারতীয় অর্থনীতি লাতিন আমেরিকার মতো হয়ে দাঁড়াক। যেখানে বৈষম্যের মাত্রা চরম। অথচ ভারতে প্রায় তেমনই ঘটতে চলেছে। ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের ফারাক ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন ধনাঢ্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাকিদের অবস্থানের পার্থক্য ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শেয়ার বাজারে হঠাৎ আলোর ঝলকানির পিছনে যে বৃহৎ সংস্থাগুলির অবদান বর্তমান, তা-ও স্পষ্ট। কিন্তু একই সঙ্গে কাঠামোর বাকি অংশ যে ডুবন্ত, সেটাও পরিষ্কার বোঝা যায়। লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে যেমন বেশির ভাগ মানুষই শিক্ষার আওতা থেকে বহু দূরে, ফলে তারা উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে খাপ খায় না। এমন ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ চাহিদা সীমিত হয়ে পড়ে এবং আর্থিক বৃদ্ধি বাধা পায়।
নীতি-নির্ধারকদের সেই দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, যাকে আমেরিকান সাহিত্যিক স্কট ফিৎজেরাল্ড রচিত উপন্যাস (এবং সেই উপন্যাসের উপর আধারিত সিনেমা) অনুসরণে ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি কার্ভ’ বলা হয়। যেখানে আমেরিকান সমাজের অর্থনৈতিক ও শ্রেণিগত বৈষম্যকে একটা অতিমাত্রিক বৃদ্ধির কালপর্বে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এই ‘কার্ভ’ বা ‘বাঁক’ দু’টি অবস্থানের মধ্যবর্তী পরিসরে পথ কেটে অগ্রসর হয়। যার এক দিকে থাকে বৈষম্য আর অন্য দিকে থাকে প্রজন্ম-অন্তর্বর্তী গতিময়তা। অর্থাৎ এমন সম্ভাবনা যে, পরের প্রজন্মই আর্থিক সিঁড়ির উচ্চতর ধাপে উঠে আসবে। কম আয় থেকে মোটামুটি স্বচ্ছল আয়ের দিকে ধাবিত হবে। এই বাঁকের ব্যাপারে উত্তর ইউরোপের দেশগুলি বা নর্ডিক দেশগুলি সব থেকে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে তা ভাল ভাবে উতরোয়নি। আর সব থেকে ব্যর্থ হয়েছে লাতিন আমেরিকার বৃহৎ অর্থনীতি। যদি ভারত অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আন্তঃপ্রজন্ম গতিময়তার সঙ্গে মেলাতে চায়, তবে পূর্ব এশিয়ার মতো দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধির হারের মতো নয়, তার বিপরীতে লাতিন আমেরিকার মতো অধোগতির ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
এই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব যদি দেশের রাজকোষকে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করা যায়। যদি করবৃদ্ধির বিষয়টাকে সঠিক ভাবে পরিচালনা করা যায়, যদি স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনও বাধা না রেখে বিনিয়োগ করা যায়, যদি শ্রমনিবিড় কিন্তু গুণমান-বৃদ্ধিকারী নিয়োগ-নীতি গ্রহণ করা যায়। কিন্তু গৃহীত নীতিগুলি ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং উন্নততর কর্মনিযুক্তির সুযোগকে পাশ কাটিয়ে গেলে আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভরাডুবি ঘটবে। উন্নয়নের বদলে যা পরিদৃশ্যমান হবে, তা হল সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ। যে চাপ থেকে লাতিন আমেরিকা ক্রমশ স্বৈরাচারী গণতন্ত্রের দিকে ঢলে পড়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy