বলিউডের অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতকে সম্প্রতি টুইটার থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যে পরিমাণ অসংবেদনশীল এবং বহুলাংশে উস্কানিমূলক কথাবার্তা কঙ্গনা টুইটারের মাধ্যমে বলছিলেন, তা কোনও দায়িত্বশীল সংস্থার পক্ষেই চুপ করে মেনে নেওয়া অসম্ভব। কিন্তু সরকারি আশীর্বাদের হাত যে অনুগত যোদ্ধার মাথায়, তাঁকে গলাধাক্কা দেওয়ার হিম্মত আন্তর্জাতিক সমাজমাধ্যমগুলির কোনওটিরই নেই। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, হঠাৎ কোন জাদুবলে টুইটার কর্তৃপক্ষের ঠুলিটি চোখ থেকে সরে গেল? পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, রহস্য গভীর। বাংলায় বিজেপি হারার পর নিষ্ফল আক্রোশে কঙ্গনা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলেন। জানিয়েছিলেন নির্বাচনোত্তর বাংলায় হিংসাপরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য নরেন্দ্র মোদীকে শূন্য দশকের অবতারে ফিরে আসা দরকার। অর্থাৎ, গুজরাত দাঙ্গার প্রেক্ষিতটিকে কঙ্গনা টেনে এনেছিলেন। এবং এ টুইট জ্যামুক্ত তিরের মতন ছুটে যাওয়া মাত্র অত্যুৎসাহী আইটি সেল ওই এক তিরে লাখ লাখ লক্ষ্যভেদে উদ্যোগী হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু কঙ্গনা একটি ব্যাপারে সম্ভবত ওয়াকিবহাল ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গুজরাত-পর্ব নিয়ে একটি কথাও বলতে চান না, একটি কথাও শুনতে চান না। এমনকি অবিমিশ্র প্রশংসা হলেও শুনতে চান না। আজ থেকে চোদ্দো বছর আগে সাংবাদিক করণ থাপারের গুজরাত দাঙ্গা সংক্রান্ত প্রশ্নবাণে জর্জরিত মোদী কথোপকথন অসমাপ্ত রেখেই উঠে পড়েছিলেন। আর এই চোদ্দো বছর ধরে তিনি গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে যে কোনও আলোচনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে এসেছেন।
মোদী যে ২০০২ সালে রাজধর্ম পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন, সে কথা কখনও অজানা ছিল না। অথচ, হাতেগোনা মানুষকে বাদ দিলে আমরা মোটের উপর গুজরাতপর্ব এড়িয়ে চলেছি। গত সাত বছর ধরে বিজেপির শাসনকালে সাম্প্রদায়িক হিংসা যা বেড়েছে, তার প্রেক্ষিতে গুজরাত নিয়ে আরও অনেক আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয়নি।
আমাদের এই সার্বিক ব্যর্থতা কেন্দ্রীয় সরকারকে স্বস্তিতেই রেখেছিল। কিন্তু মোদী অ্যান্ড কোং এই মুহূর্তে আদৌ স্বস্তিতে নেই। তাঁরা ফের সিঁদুরে মেঘ দেখতে পাচ্ছেন। কোভিড অতিমারিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী গত এক বছর ধরে যে অবিমৃশ্যকারিতা করেছেন, তাতে পৃথিবীর সব নামজাদা সংবাদমাধ্যম তাঁকে তুলোধোনা করে চলেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, মোদী দেশরক্ষা নয়, ব্যস্ত ছিলেন নিজের ইমেজ নিয়ে। গার্ডিয়ান বলছে, ভারতে এই মৃত্যুমিছিলের জন্য মূলত দায়ী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিহীন আত্মবিশ্বাস। এমনকি চিকিৎসাবিদ্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল ল্যানসেট-এর সম্পাদকমণ্ডলী জানিয়েছেন, অতিমারি চলাকালীন মোদী যে ভাবে ন্যায্য সমালোচনা আটকাতে উঠেপড়ে লেগেছেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। কেউ বলতেই পারেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে এ ভাবে অপদস্থ হতে দেখলে আমাদের খুশি হওয়া আদৌ উচিত নয়। না খুশি হচ্ছি না, বরং একটা তীব্র রাগ থেকে থেকে জেগে উঠছে। কারণ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম যে কাজটা করছে, সেটা আরও অনেক আগেই দেশজ সংবাদমাধ্যমের করা উচিত ছিল। করেনি। হাতেগোনা আঞ্চলিক সংবাদপত্র ব্যতিক্রম হিসেবে রয়েছে, কিন্তু তাদের উপরেও প্রতি মুহূর্তে বর্ষিত হচ্ছে ক্ষমতার আস্ফালন। ফেসবুক বা টুইটারের মতন সমাজমাধ্যমও ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষায় এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা তাদের নিজের দেশ আমেরিকাতেও দেখা যায় না। সপ্তাহ দুয়েক আগে #রিজ়াইনমোদী হ্যাশট্যাগটি দেখা মাত্র ফেসবুক সমস্ত পোস্ট ব্যান করছিল। পৃথিবীজোড়া প্রতিবাদের পর তাদের টনক নড়ে, এবং তড়িঘড়ি করে একটি দায়সারা বিবৃতি দেয়।
জরুরি খবর ধামাচাপা দেওয়ার ঐতিহ্যটি আজকের নয়। এবং, প্রক্রিয়াটি সুচারু ভাবে সম্পন্ন করার জন্য বারে বারে খুঁচিয়ে তোলা হয়েছে এক গোষ্ঠীগত আবেগকে। ২০০২-এর ভয়াবহতার পর ‘গুজরাতি অস্মিতা’র ধুয়ো তুলে নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দল ঘর সামলানোর চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ, গুজরাতে কী ঘটেছে তা শুধু গুজরাতিরা বুঝবে! বাইরের মানুষ কী বলছে, তা নিয়ে কথা বাড়ানো অনর্থক। মোদীর সমর্থকদের মূল দাবি ছিল গুজরাতবাসী যদি সত্যিই অসন্তুষ্ট হত, তা হলে বারংবার তারা ভোট দিয়ে মোদীকে ক্ষমতায় আনত না। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, নরেন্দ্র মোদী বেশ সাফল্যের সঙ্গে এই স্ট্র্যাটেজিটি ধরে রাখতে পেরেছিলেন। ফলে গুজরাত নিয়ে সামান্যতম কাটাছেঁড়াও মূলধারার মিডিয়ায় বহু দিন যাবৎ বন্ধ। বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই গুজরাতের দাঙ্গা ব্রাত্য বিষয় হয়ে পড়েছে। বরং ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে গার্ডিয়ান বা আল-জাজ়িরা’র মতন বিদেশি সংবাদমাধ্যম গুজরাত নিয়ে ফের কথা তুললে ‘টিম মোদী’ গুজরাতি অস্মিতা থেকে বেরিয়ে ভারতীয় অস্মিতাকে তুরুপের তাস করে তোলার চেষ্টা করে। এবং সেই লাইনেও নরেন্দ্র মোদী মোটের উপর সাফল্য পান। বছরখানেক আগে অবধিও বহু প্রবাসী ভারতীয় মোদীকে নিয়ে সামান্যতম সমালোচনাকে বহির্বিশ্বের ঈর্ষা বলে উড়িয়ে দিতেন। অথচ, গত সাত বছর ধরে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বত্র শুধু নৈরাশ্যের ছবি উঠে এসেছে। কিন্তু অন্ধ দেশপ্রেম সে সব দেখে না, দেখে শুধু বালাকোটের ‘বিস্ফোরণ’।
সমাজমাধ্যমগুলিতে এই মুহূর্তে শুধুই ঢিঢিক্কার। ডিমনিটাইজ়েশন বা লকডাউন-এর বিভীষিকাও মানুষ সহ্য করে নিয়েছিলেন, কিন্তু দেশজোড়া এই মৃত্যুমিছিল দেখার পর অধিকাংশ মানুষই আর চুপ করে বসে থাকতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রীর প্রাপ্য সমালোচনাটুকু তাঁরা সুদে-আসলে উগরে দিচ্ছেন। ২০০২ সালেও কিন্তু গোড়ায় দেশ জুড়ে সমালোচনার ঢেউ বয়েছিল। যার ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী নরেন্দ্র মোদীকে রাজধর্ম পালনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। গুজরাতের অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে এই মৃদু তিরস্কার নিতান্তই হাস্যকর। কিন্তু মেরুকরণের রাজনীতিকে অবলম্বন করে যে নেতাদের উত্থান, সেই বাজপেয়ী বা আডবাণীরা আর কী-ই বা করতে পারতেন? নরেন্দ্র মোদী বাজপেয়ীদের দেখানো পথেই যে হেঁটেছেন।
মোদীর রাজনীতিতে ধর্ম আর জাতি তো প্রাধান্য পেতই, ক্রমে আঞ্চলিকতাও প্রাধান্য পেতে শুরু করল। যে গুজরাতি অস্মিতা দিয়ে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন মোদী, সেই একই হাতিয়ার নিয়ে তিনি লড়াই শুরু করেছিলেন ‘দিল্লিওয়ালা’ কংগ্রেসিদের বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালে সনিয়া গাঁধী যখন নরেন্দ্র মোদীকে ‘মৃত্যুর সওদাগর’ বলে অভিহিত করেছিলেন, তখন এই গুজরাতি ভ্রাতৃত্ববোধের দরুন আসল ট্র্যাজেডিটি বেবাক উড়ে গিয়ে পড়ে ছিল দিল্লি বনাম গুজরাত মার্কা এক অনর্থক দ্বন্দ্ব। এবং সে দ্বন্দ্বের পূর্ণ ফয়দা তুলেছিলেন নরেন্দ্র মোদী।
আবারও তাই সিঁদুরে মেঘ দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বজোড়া সংবাদমাধ্যম যে নির্মম সমালোচনা করে চলেছে, তাতে খুব শীঘ্রই কোভিডকালের দুর্বিষহ স্মৃতি মুছে গিয়ে পড়ে থাকতে পারে ভারত বনাম বহির্বিশ্ব জাতীয় কোনও পড়ে পাওয়া লড়াই। তার উপর স্বাধীনতার ৭৫ বছর আসছে— জাতীয়তাবাদের আঁচে রাজনীতিতে সেঁকে নেওয়ার এই সুযোগ মোদী হারাবেন বলে বিশ্বাস হয় না। এ নেহাত কথার কথা নয়— ভিন্দেশি শত্রুতার গল্প খাড়া করে অনেক একনায়কতন্ত্রই জেঁকে বসেছে, অনেক অন্যায়ই অবাধে চলছে। রোহিঙ্গা প্রশ্ন নেহাতই অভ্যন্তরীণ, বাকি বিশ্বের এ নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত নয় জাতীয় কথা বলতে বলতে গণতন্ত্রের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে মায়ানমারে। পশ্চিমি দুনিয়া তুরস্কের ক্ষমতায় ভীতসন্ত্রস্ত— এহেন ধোঁকার টাটি খাড়া করে সে দেশের মসনদে পাকাপাকি ভাবে বসে পড়েছেন এক চরম স্বৈরাচারী শাসক। তাই এ বার অন্তত আমাদের নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিটি বজায় রাখা ছাড়া গতি নেই। লড়িয়ে দেওয়ার প্রলোভন যতই আসুক, অনাবশ্যক ভারতীয় অস্মিতা বর্জন করা এখন আমাদের দায়িত্ব। কিছুটা রাজনৈতিক দায়িত্ব, তবে কোভিডকালে হারিয়ে যাওয়া লাখ লাখ দেশবাসীর কথা ভাবলে মূলত নৈতিক দায়িত্ব।
অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy