Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

একটি ভাষার প্রাধান্যে বাড়বে বিচ্ছিন্নতা

ত্রিভাষা শিক্ষানীতিতে হিন্দি ভাষা ‘চাপিয়ে দেওয়া’র বিষয়টি বিতর্ক তৈরি করেছিল। তার প্রতিবাদ হয়েছে। ইতিমধ্যে তা আবশ্যিকের পরিবর্তে ঐচ্ছিক বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তামিলনাড়ু এই নীতির বিরোধিতা করলেও চুপ ছিল পশ্চিমবঙ্গ। লিখছেন স্বপনকুমার মণ্ডল সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন খসড়া শিক্ষানীতিতে যে-সব বিষয় সারা দেশে চর্চার পরিসর তৈরি করেছে, তার মধ্যে নতুন শিক্ষানীতিতে সেই ভাষিক বিস্তার নতুন করে বিতর্ককে আমন্ত্রণ জানায়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে দুই খুদে। ফাইল চিত্র

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে দুই খুদে। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৯ ০২:১৭
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’-এ মানুষ দেহে স্বতন্ত্র হলেও মনে ঐক্যপ্রত্যাশী হওয়ার কথা তুলে ধরেছেন। দেশের মানুষের ক্ষেত্রেও সে ঐক্যবোধ স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে ভারতের মতো বহু ভাষার দেশে জাতীয়তাবোধে ভাষিক ঐক্যচেতনার বিষয়টি আপনাতেই প্রাসঙ্গিকতায় উঠে আসে এবং তার বাস্তবায়নে সক্রিয় উদ্যোগও শুরু হয়। অথচ, তার মান্যতায় অনৈক্যবোধের পরিচয়ও সুবিদিত।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন খসড়া শিক্ষানীতিতে যে-সব বিষয় সারা দেশে চর্চার পরিসর তৈরি করেছে, তার মধ্যে নতুন শিক্ষানীতিতে সেই ভাষিক বিস্তার নতুন করে বিতর্ককে আমন্ত্রণ জানায়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ত্রিভাষা শিক্ষানীতিতে হিন্দি ভাষা ‘চাপিয়ে দেওয়া’র বিষয়টি বিতর্ক তৈরি করে এবং তার প্রতিবাদ হয়। ইতিমধ্যে তা আবশ্যিকের পরিবর্তে ঐচ্ছিক বলে ঘোষণা করা হয়।

এ ভাবে বহু ভাষাভাষী দেশে একটি ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া নিয়ে বাংলায় সে ভাবে প্রতিবাদ দেখা যায়নি। তামিলনাড়ুর মতো নিজের ভাষার মতো তীব্র স্বাভিমানবোধ বাঙালিমানসে নিবিড় হয়ে ওঠেনি। ভাবটা যেন হলেও ভাল, না-হলেও মন্দ নয়। এ রূপ উদাসীন মানসিকতা কতটা প্রত্যাশিত ও স্বাস্থ্যকর, তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। বিশেষ করে যে বাঙালি আন্দোলনের মাধ্যমে বিশ্বে মাতৃভাষার প্রতি সম্মানবোধ এনে দিয়েছে, সেই বাঙালির মধ্যে অন্য ভাষার আরোপিত আধিপত্যকে মেনে নেওয়ার মধ্যে বিরূপ মানসিকতার অভাব এত তীব্র কেন, তা ভাবিয়ে তোলে। শুধু তা-ই নয়, যে হিন্দি ভাষার আগ্রাসী আধিপত্যে বাঙালিকে স্বদেশে পরবাসী হতে হয়েছিল, সেই হিন্দির প্রাধান্যে বাংলার প্রতিবাদ গর্জে ওঠে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও ১৯৪৮-এর ১৪ জুন থেকে ১৯৫৬-এর ১ নভেম্বর পর্যন্ত মানভূমের ধারাবাহিক ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতাও সেখানে বিস্মৃত হয়ে পড়েছে।

দেশের প্রধান ভাষা হিসেবে হিন্দির প্রচলনে উদ্যোগী হওয়ার বিষয়টি দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব থেকে সক্রিয় ছিল। সেখানে তার তীব্র প্রতিবাদও লক্ষণীয়। বিশেষ করে তামিলনাড়ুতে তীব্র অনীহা গর্জে ওঠে। এ জন্য ঐক্যমত্যের অভাবে ও বিচ্ছিন্নতাবোধে ১৯৫০-এ দেশে সংবিধান গ্রহণের সময় পরিকল্পনামাফিক প্রথম পনেরো বছর পর্যন্ত সরকারি কাজের ভাষা রূপে দেবনাগরী হরফে হিন্দির সঙ্গে তার সহায়ক ভাষা হিসেবে ইংরেজিকেও শামিল করা হয়। সে ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে ইংরেজি ব্যবহার হ্রাস করে, প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে হিন্দিকেই শেষে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করার লক্ষ্য ছিল। দক্ষিণ ভারতে অহিন্দিভাষী মানুষের কাছে সেই পরিকল্পনা ষড়যন্ত্র হয়ে ওঠে এবং তার তীব্র প্রতিবাদ সংগ্রামমুখরতা লাভ করে। এ জন্য ১৯৬৩-তেই সরকারি ভাষা আইনে ১৯৬৫-এর পরেও সেই ধারা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। আবার ১৯৬৪-তে সরকারি ভাবে ইংরেজি তুলে দেওয়ার প্রয়াসও সে ক্ষেত্রে প্রতিবাদে সাফল্য লাভ করেনি। তাতে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে উত্তর ভারতের একাধিক রাজ্যও যোগ দিয়েছিল।

১৯৮৬-তে কেন্দ্রীয় শিক্ষা নীতিতে নবোদয় বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনা অন্যত্র বাস্তবায়িত হলেও তামিলনাড়ুতে সম্ভব হয়নি। সেখানে বাংলা দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষার অধিকারী হলেও বাঙালিমানসে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে সে ভাবে আন্দোলন দানা বাঁধেনি। উল্টে হিন্দি ভাষাকে জাতীয় স্তরে প্রাধান্য লাভের ক্ষেত্রেই বাঙালির উদারতা প্রথমাবধি সচল রয়েছে।

হিন্দি ভাষার বিস্তারে বাঙালির ভূমিকা অবিস্মরণীয়। বিহারের বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে সাহিত্যিক ভূদেব মুখোপাধ্যায় সাধারণ লোকের সুবিধার্থে ফারসির পরিবর্তে হিন্দি ভাষা প্রচলনের জন্য রীতিমতো আন্দোলন করেছিলেন। তাঁর জন্যই বিহারে হিন্দি ভাষা যথাযোগ্য মর্যাদা লাভ করে। ভূদেব মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ (১৮৯২)-এ লিখেছেন: ‘ভারতবাসী চলিত ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দী-হিন্দুস্থানিই প্রধান এবং মুসলমানদিগের কল্যাণে উহা সমস্ত মহাদেশে ব্যাপক। অতএব অনুমান করা যাইতে পারে যে, উহাকে অবলম্বন করিয়াই কোন দূরবর্তী ভবিষ্যকালে সমস্ত ভারতবর্ষের ভাষা সম্মিলিত থাকিবে’।

সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ও অনুরূপ বিশ্বাস করতেন। এ জন্য তিনি ওড়িশায় হিন্দি প্রচলনে ‘বাঙ্গালা উঠাইয়া দিয়া’র কথাও ব্যক্ত করেছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সরকারি কাজের ভাষা হিসেবে হিন্দিকে সুপারিশ করেছেন। আবার ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের হিন্দি ভাষাপ্রেম তো সুবিদিত।

অথচ, বাঙালির এই হিন্দি ভাষাপ্রীতি অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বলতার অবকাশ তৈরি করেছে। হিন্দিভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে বাঙালির ভাষা সঙ্কট তীব্র। মানভূম ভাষা আন্দোলন তারই ফসল। কিন্তু তার পরেও পরিকল্পনামাফিক হিন্দি ভাষার আধিপত্য বিস্তারের সক্রিয়তায় বাঙালিমানসে তাপ-উত্তাপ দেখা যায় না। বাঙালির মধ্যে নিজের মাতৃভাষার পরিবর্তে হিন্দিকে আপন করে ভারতীয় হয়ে ওঠার প্রয়াস সক্রিয় হয়ে ওঠে।

অন্য দিকে, ইংরেজির সঙ্গে হিন্দিকে মেলালে চলবে না। ইংরেজি অনেক দিন পূর্বেই আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা হয়ে উঠেছে। সে দিক থেকে হিন্দির জাতীয়তাবোধে ইংরেজিকে বিজাতীয় করে তোলাও সমীচীন নয়।

দেশে হিন্দির মতো আরও ২১টি সংবিধান স্বীকৃত ভাষা বর্তমান। সেগুলিকে উপেক্ষা করে শুধু কল্পিত জাতীয়তাবোধের তীব্রতায় হিন্দিকে ‘রাজভাষা’ বা রাষ্ট্রীয় ভাষায় উন্নীত করার পরিকল্পনা কেন? এমনিতেই বলিউডি সিনেমার জনপ্রিয়তা হিন্দি ভাষার বিস্তার সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে তার ছায়ায় প্রাদেশিক ভাষাগুলিও অস্তিত্ব-সঙ্কটে পড়েছে।

বাঙালিদের হিন্দির একনায়কত্ব মেনে নেওয়ার মধ্যে শুধু স্বাভিমানের অভাববোধই প্রকট হয়ে ওঠে না, স্বকীয় অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে। ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধর্মও সেখানে ব্যাহত হয়ে ওঠে। সকলের প্রাধান্যেই দেশের গণতান্ত্রিক পরিসর আদর্শায়িত হয়েছে। সেখানে ভাষা শেখায় অসুবিধা নেই, এক ভাষাকে উচ্চকিত করতে গিয়ে অপর ভাষাগুলিকে নিম্নগামী করাতেই আপত্তি। ভাষার ধর্ম প্রকাশ করা। সে দিক থেকে ভাষা শিক্ষা হোক মুক্ত, ঐচ্ছিক এবং আবেদনক্ষম।

লেখক শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

অন্য বিষয়গুলি:

Language Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy