Advertisement
E-Paper

গণতন্ত্রকে বাঁচাতে চাইলে

কতিপয় ক্ষমতাশালীর হাতে গণতন্ত্র বন্দি হলে তার চেহারা কেমন দাঁড়ায়, আজকের ভারতের দিকে তাকালেই তো বোঝা সম্ভব।

রোহণ

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:০৫
Share
Save

গণতন্ত্র নাগরিকের কাছ থেকে অনেক কিছু প্রত্যাশা করে— যুক্তিবাদী চিন্তা, ধৈর্য, সহনশীলতা। কিন্তু, সংখ্যাগুরু নাগরিকের মধ্যে তা নেই। তাঁরা এর চর্চাও করতে চান না। তাঁরা চান ‘শক্তিশালী নেতা’র হাত ধরে ঝটপট সমাধান। তা যদি স্বাধীনতা হারানোর বিনিময়েও হয়, তা-ও তাঁরা মেনে নেন। আর এই নাগরিক মেনে নেওয়ার অভ্যাসের ফাঁক গলে গণতন্ত্রের প্রকৃত মূল্যবোধগুলিকেই ছেঁটে ফেলতে থাকেন ক্ষমতাভোগীরা। এই কথাগুলো মনে করিয়ে ২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া আরউইন-এর রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানী শন ডব্লিউ রোজ়েনবার্গ বলেছিলেন, অচিরেই ভেঙে পড়বে গণতন্ত্র।

গণতন্ত্রের এমন ভেঙে পড়া চেহারা সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ছিলেন রবীন্দ্রনাথও। ১৯২৪ সালে বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি-তে ‘সিটি অ্যান্ড ভিলেজ’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, মানুষের লোভকে অবাধ প্রশ্রয় দিতে দিতে গণতন্ত্র হয়ে যায় এক হাতির মতো— যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হল ক্ষমতাবান আর বিত্তবানদের ‘জয় রাইড’ দেওয়া। এই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, তথ্য আর মত প্রকাশের সব রাস্তা, এবং তার সঙ্গে প্রশাসনিক যন্ত্রও, খোলাখুলি বা গোপনে চালনা করেন গুটিকতক সুবিধাভোগী। এই প্রবন্ধ লেখার বহু আগেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, নৈতিকতার বোধ ছাড়া গণতন্ত্র আদতে লোভের হাতিয়ার। এবং প্রকৃত ‘গণতন্ত্র’ কেবল একটি শাসনব্যবস্থা নয়— তা সমগ্রের মিলিত দায়িত্ব হওয়া উচিত।

কতিপয় ক্ষমতাশালীর হাতে গণতন্ত্র বন্দি হলে তার চেহারা কেমন দাঁড়ায়, আজকের ভারতের দিকে তাকালেই তো বোঝা সম্ভব। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি শাসকের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সংখ্যালঘুদের অধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, যে-কোনও বিরোধিতা— সব কিছুই মারাত্মক ভাবে দমন করা হচ্ছে। ২০১৮ সাল থেকে ভি-ডেম’এর খাতায় ভারত একটি ‘ইলেকটোরাল অটোক্র্যাসি’। রোজ়েনবার্গ দেখিয়েছেন, সংখ্যাগুরু জনগণ জটিলতাকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। তখন তারা গণতন্ত্রের প্রকৃত আদর্শগুলিকে ত্যাগ করে একক নিয়ন্ত্রণ বা স্বৈরতান্ত্রিক সমাধানকে বেছে নিতে একটুও দ্বিধা করে না। হিন্দুত্বে ভর করে ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি যে ভাবে দেশ চালাচ্ছে, তা গণতন্ত্রের প্রাথমিক নীতিগুলিকেই কি ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিচ্ছে না? কিন্তু তাতেও ফের জিতে মসনদে বসতে বেগ পেতে হয়নি নরেন্দ্র মোদীর দলকে।

গণতন্ত্র আসলে নাগরিকের কাছে কিছু ক্ষমতা প্রত্যাশা করে— অনিশ্চয়তাকে সহ্য করার ক্ষমতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ইত্যাদি— যা বেশিরভাগ নাগরিকের নেই, তাঁরা সেগুলির চর্চাও করতে চান না। জটিলতাকে এড়িয়ে চলাই তাঁদের স্বভাব। তাই তাঁরা সহজ উত্তর খুঁজে নেন— কোনও দেশে সেই উত্তরের নাম ট্রাম্প, কোথাও নেতানিয়াহু, কোথাও এর্দোয়ান, কোথাও আবার নরেন্দ্র মোদী। এই ‘শক্তিশালী’ নেতাদের ‘গণতন্ত্র’-এই সংখ্যাগুরুর মুগ্ধতা। রোজ়েনবার্গের মতে, ‘গণতন্ত্র’-এর প্রকৃত চেহারাকে টিকিয়ে রাখতে হলে, চাই এমন শিক্ষা যা নাগরিককে শেখায় যুক্তিবোধ, সহানুভূতি আর নৈতিক পরিপক্বতা। না হলে, জনতা ধরা পড়ে সস্তা সমাধানের ফাঁদে। তাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সঙ্কট বাইরের আক্রমণে নয়, বরং নাগরিকদের ভিতরের চিন্তার অভাব আর নৈতিক বিচ্ছেদের মধ্যেই।

ইতিহাস সাক্ষী, নাৎসি জার্মানির ইহুদি গণহত্যাই হোক বা বর্তমান ইজ়রায়েলের প্যালেস্টাইনে গণহত্যা, কিংবা ভারত-বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচার— সব ক’টিই প্রমাণ করে, নৈতিকতা ছাড়া গণতন্ত্র শুধু দমন-পীড়নের এক বৈধ উপায়। হিটলার ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন, আইন পাশ করেছিলেন, আর গণহত্যাও চালিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতর দিয়েই। ইজ়রায়েলেও জারি আছে ‘গণতন্ত্র’। আর বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘গণতন্ত্র’ ভারত, যেখানে নিয়মিত ভোট হয়, আদালত, সংবাদমাধ্যম আছে, সেখানে কী ঘটছে? সিএএ, এনআরসি, ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল পাশ করিয়ে মুসলমান সমাজকে বিশেষ ‘বার্তা’ দেওয়া, অবাধে ঘৃণা ছড়িয়ে যাওয়া, নাগরিক সমাজের প্রতিবাদীদের চুপ করিয়ে দেওয়া— সবই ঘটছে গণতন্ত্রের আঙিনাতেই। গণতন্ত্রকে ব্যবহার করেই— নাগরিকের নৈতিকতা বোধের শিথিলতার ফাঁক গলে।

‘গণতন্ত্র’ কোনও চূড়ান্ত সুরক্ষাকবচ নয়। কেবল একটি কাঠামো। আর সেই কাঠামো জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি মাত্র। জনতার সেই কামনা যে ন্যায়সঙ্গতই হবে, তার কোনও নিশ্চয়তা থাকে না সেখানে। যখন অপরের প্রতি ঘৃণা, অপরকে দেখে ভয়, দেখানো দেশপ্রেম-জাতীয়তাবাদ আর ধর্মীয় আধিপত্য কায়েমের উল্লাস নাগরিকের যুক্তিবাদী, সহনশীল, নৈতিক মনের দখল নেয়, তখন সেই দুর্ভাগা দেশে ভোট, সংসদ, আইন, গণতন্ত্রের কাঠামোটুকুই টিকে থাকে কেবল। আত্মাটা মরে যায়।আমরা যদি যুক্তি দিয়ে ভাবা বন্ধ করে দিই, সহজ পথ ছেড়ে কঠিন পথকে বেছে না নিই, শক্তিশালী নেতায় মুগ্ধ হয়ে মানুষ-ধর্মকে অবহেলা করি— এই আত্মঘাতী গণতন্ত্রের মৃত্যু ঠেকানো মুশকিল। গণতন্ত্রের সত্য শাসনের যদি সত্যিই কোনও রূপ থাকে, তাকে স্থাপন করার সবচেয়ে বড় ভার— শাসক নয়— তার নাগরিকের উপরে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Democracy Citizens

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}