উল্লাস: রবার্ট মুগাবে পদত্যাগ করার পর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহনসবার্গ-এর রাস্তায় জিম্বাবোয়ের অভিবাসী নাগরিকদের উচ্ছ্বাস। ছবি: রয়টার্স
রবার্ট মুবাগে পদত্যাগ করেছেন। জিম্বাবোয়েতে ক্ষমতার এই পালাবদল উদযাপন করতে হারারে ও বুলাওয়ের রাস্তায় নেমেছে মুখরিত জনতা। অভিবাদন জানাচ্ছেন সেনাবাহিনীকে। দৃশ্যগুলি নিঃসন্দেহে মর্মস্পর্শী। কিন্তু একুশ শতকের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীকে শাসন ক্ষমতা থেকে দূরে রাখাটাই যেখানে দস্তুর, সেখানে সেনাবাহিনী হঠাৎ গণতন্ত্র রক্ষা ও ক্ষমতার পালাদলের নায়ক হয়ে দাঁড়াল এবং জনগণ তাকে দু’হাত তুলে সমর্থন জানাল, বিস্ময়ের কথা বইকি।
মুগাবের উত্থান ও পতনের ইতিহাসটি উনিশ শতকের ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের বিখ্যাত ‘প্যাট্রিয়ট’ কবিতার সেই লাইনটি মনে করিয়ে দেয়: ‘দাজ আই এন্টার্ড, অ্যান্ড দাজ আই গো’! কবি দেশপ্রেমিক নগরীতে পুষ্পবর্ষণের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন, কিন্তু পরে কর্মদোষে তাঁকে ইষ্টক বর্ষণের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়। ১৯৮০ সালে মুগাবে যখন প্রথম ক্ষমতায় আসেন, তাঁর পরিচিতি ছিল এক জন আদর্শবাদী রাজনীতিক। তিনি ছিলেন জিম্বাবোয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নায়ক, বামপন্থী নেতা, প্যান-আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী ধারার আইকন। ক্ষমতায় এসেই তিনি ভূমি সংস্কার, ধনাঢ্য শ্বেতাঙ্গদের কৃষি খামার জাতীয়করণ, খনিজ শিল্পের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণসহ বহু অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রকল্প হাতে নেন।
কিন্তু ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও দম্ভ ক্রমশই তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তিনি হয়ে ওঠেন এক জন আদর্শ স্বৈরাচারী শাসক। তাঁর ৩৭ বছরের শাসনকালে, বিশেষত শেষের দুই দশকে হাজার হাজার মানুষ নিপীড়নের শিকার হয়েছে। কণ্ঠরোধ করা হয়েছে বিরোধীদের। বহু বিরোধী দলনেতা হয় নিখোঁজ, না হয় বিদেশে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যা, জাতীয় সম্পদ লুট, নির্বাচনে কারচুপি ও ভোটচুরির অভিযোগ রয়েছে। শেষে নিজের স্ত্রী গ্রেসকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে পরিবারতন্ত্র কায়েমের পথে হেঁটেছিলেন। এহেন এক শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ এবং তাঁর পতনে উল্লাস স্বাভাবিক। প্রশ্ন হল, সামরিক বাহিনীর হাত ধরে ক্ষমতার এই পরিবর্তন কী দেশটিতে গণতান্ত্রিক রাজনীতির নতুন যুগের সূচনা করবে?
অভ্যুত্থানের পরে দেশটির সংবাদমাধ্যমও নাগরিকদের কাছে এই প্রশ্ন রেখেছিল। জরিপে অংশ নেওয়া এক হাজার মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশের উত্তর ছিল ইতিবাচক। এটা জনমতের সার্বিক প্রতিফলন কি না, তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। কিন্তু ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, সামরিক অভ্যুত্থান মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীত পরিণতিই বয়ে নিয়ে আসে। ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফ্রান্সের ক্ষমতা দখল করেছিলেন। যা ‘ফরাসি বিপ্লবের’ বিজয়রথকে কার্যত স্তব্ধ করে দিয়েছিল। জীবদ্দশায় নেপোলিয়ান নিজেই স্বীকার করেছিলেন, ‘আমিই বিপ্লব, আমিই বিপ্লবের ধ্বংসকারী’। একই ভাবে, গত শতাব্দীতে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, মায়ানমারসহ তৃতীয় বিশ্বের সেনা অভ্যুত্থানগুলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিল। বস্তুত সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাবানরাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাদের হাতেই কুক্ষিগত হয়ে পড়ে রাজনীতি ও অর্থনীতি। জনগণের সম্মতিহীন এই সব অভ্যুত্থানে মানুষের মুক্তি তো দূরের বিষয়, বরং তারা নজরবন্দি হয়ে পড়ে শাসকের রক্তচক্ষুর ঘেরাটোপে।
ঠিকই যে সেনাবাহিনী নিজে ক্ষমতা দখল করেনি, এই অভ্যুত্থানে কোনও রক্তপাত বা হিংসাও ঘটেনি। গত বছর তুরস্কের মানুষ যে ভাবে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছে, হারারে-র পরিস্থিতি সেই তুলনায় শান্ত ছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী যে ভাবে জনসাধারণের অসন্তুষ্ট অংশ, ক্ষমতাসীন জানু-পিএফ দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে মুগাবেকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তা যথার্থই সেনা অভ্যুত্থানের উদাহরণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথাগত ধারায় সংগঠিত না হলেও, এটি একটি পরিকল্পিত সামরিক ক্যু। যেহেতু এর প্রতিক্রিয়ায় কোনও রকম বিক্ষোভ সমাবেশ হয়নি, তাই তা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও দেশে ও বিদেশে বৈধতা পেয়েছে। মুগাবে যদি সেনাবাহিনীর পছন্দের নেতা এমারসন মানগাগওয়াকে ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ থেকে বহিষ্কার না করতেন, তা হলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত বলেই তাঁদের ধারণা।
মুগাবে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারেননি। গণতন্ত্রের মাথা খেয়ে তিনি নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছিলেন। নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন। মূলত সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু, উত্তরাধিকারী হিসাবে স্ত্রীকে নির্বাচন ও তার পরিপ্রেক্ষিতে মানগাগওয়ার পদচ্যুতিই তাঁর কাল হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সেনাবাহিনী শঙ্কিত হয়ে ওঠে। তাদের প্রভাব হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়।
তবে এই ভুল শুধুমাত্র মুগাবের একার নয়, ক্ষমতাসীন জানু-পিএফ দলটিও যথাসময়ে যথাযথ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তারা তাদেরই সৃষ্টি করা স্বৈরশাসককে সরিয়ে দিতে পারেনি। যার খেসারত দিতে হয়েছে সেনা হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে।
নতুন রাষ্ট্রপতি এমারসন মানগাগওয়া একদা মুগাবের রাজনৈতিক সতীর্থ। মুগাবের জমানায় তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও বিপুল। মুগাবের মতোই তাঁর বিরুদ্ধেও রয়েছে জাতীয় সম্পদের তছরুপ, নির্বাচনে কারচুপি ও প্রতারণার অভিযোগ। আশির দশকে জিম্বাবোয়ে সেনার বিশেষ বাহিনী ‘ফিফ্থ ব্রিগেড’ (উত্তর কোরিয়ার প্রশিক্ষণে তৈরি) যখন গুকুরাহুন্ডি অভিযানে সংখ্যালঘু ‘এনদেবেলে’ জনগোষ্ঠীর ২০ হাজার মানুষকে হত্যা করে, তিনিই ছিলেন গোয়েন্দা সংস্থাগুলির তদারকির দায়িত্বে। তারও দুই দশক পর, ২০০৮ সালে, জোরপূর্বক একটি খনি অঞ্চল দখল করতে গিয়ে সেনার হাতে নিহত হয়েছে প্রায় এক হাজার শ্রমিক। তাঁর হাতেই দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা— সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স অর্গানাইজেশন একটি বিভীষিকাময় সংগঠনে পরিণত হয়।
সুতরাং, মুগাবের পতনে দেশটিতে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটবে, এ আশা অলীক। কেননা, এর ফলে দেশটির শাসক বদল হলেও শাসনক্ষমতার ভরকেন্দ্র ও তার নিপীড়নমূলক কাঠামোটা থাকছে একই। নতুন রাষ্ট্রপতি মানগাগওয়া, সেনাবাহিনী বা জানু-পিএফ দলটি তাদের কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব পরিত্যাগ করবেন, এমন সম্ভাবনাও কার্যত নেই।
ইংরেজিতে ‘ক্যাকিস্টোক্র্যাসি’ বলে একটা কথা আছে। বাংলা তরজমা করলে যার অর্থ দাঁড়ায়: বাজে, অদক্ষ, অপদার্থ ও অসহিষ্ণু লোকদের শাসন। সপ্তদশ শতকের শাসন ব্যবস্থায় এই ধারার শাসকদের প্রায়শই দেখা যেত। গত আড়াই দশক জুড়ে জিম্বাবোয়ের নাগরিকরা দেশে এই ক্যাকিস্টোক্র্যাসির চর্চা দেখে এসেছে। যতক্ষণ সেনাবাহিনী চালকের আসনে থাকবে তত দিন এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব। তা ছাড়া এক জন নির্বাচিত স্বৈরশাসকের পরিবর্তে সামরিক স্বৈরশাসন কোনও ভাবেই বিকল্প হতে পারে না। জিম্বাবোয়ের জনতা ১৯৮০ সালে ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত মুক্ত গণতন্ত্রের স্বাদ পেতে তাদের এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
সর্বোপরি, জিম্বাবোয়ের ঘটনা তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে শিক্ষণীয়। প্রথমত, দলের তুলনায় ব্যক্তিকে অপরিহার্য বিবেচনা করলে তা স্বৈরাচারী শাসনের পথকেই প্রশস্ত করে। দ্বিতীয়ত, ঠিক সময়ে ঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে শুধু ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান হিসাবে দলকেও চরম মূল্য চোকাতে হয়। তৃতীয়ত, সেনাকে রাজনীতির অংশীদার করলে সময় বুঝে তারা তার মালিকানা দাবি করতে পারে। আধুনিক গণতন্ত্রের অনুশীলনের জন্য এই পাঠটুকু কিন্তু খুবই জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy